জ্বলদর্চি

রোহিনীনাথ মঙ্গল (শিক্ষক, লোকগবেষক, জাড়া, চন্দ্রকোনা) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১০৫
রোহিনীনাথ মঙ্গল (শিক্ষক, লোকগবেষক, জাড়া, চন্দ্রকোনা) 

ভাস্করব্রত পতি

"কি করে বললি জগা জাড়া গোলোক বৃন্দাবন? 
যেথায় বাউন রাজা চাষী প্রজা চারদিকে তার বাঁশের বন।
কোথায় রে তোর শ্যামকুণ্ডু?
কোথায় রে তোর রাধাকুণ্ডু?
সামনে আছে মাণিককুণ্ডু করগে মূলা দরশন। 
তুই বাজিয়ে যাবি ঢুলির ঢোল।
কেন রে তোর গণ্ডগোল,
কবি গাইবি পয়সা নিবি খোসামুদির কি কারণ? 
কি করে বললি জগা জাড়া গোলোক বৃন্দাবন?"---
বাবুপাড়া হাপরের বড় শীতলা পূজা উপলক্ষে সরকার পাড়ার অন্তর্গত বেনেগোঠে চন্দ্রকোনার যজ্ঞেশ্বর দাসের সঙ্গে গোষ্ঠগানের আসরের পর বকশিশ নেওয়ার সময় জাড়াকে কেন্দ্র করে এই কবিগান গেয়েছিলেন ঘাটাল পুরসভার গড়প্রতাপনগরের হরিবোল দাস। এর অনেক পরে ১৮৬৯ সালে এই জাড়ার জমিদার রায় পরিবারের পক্ষ থেকে এখানে কবিগানের আসরে আনা হয়েছিল বাগবাজারের বিখ্যাত ভোলা ময়রাকে। তাই কবিয়াল ভোলা ময়রা এই গানের গায়ক বা রচয়িতা নয়। অথচ জাড়া নিয়ে বিভিন্ন গবেষক সংগ্রাহক লেখকদের বক্তব্য ছিল এই বিখ্যাত গানের রচয়িতা ছিলেন কবিয়াল ভোলা ময়রা। সেই চরম তথ্যভ্রান্তি দূর করতে পেরেছেন জাড়ার গবেষক রোহিনীনাথ মঙ্গল। তিনিই এখানকার বিখ্যাত গান 'কি করে বললি জগা জাড়া গোলোক বৃন্দাবন' সম্পর্কে মেদিনীপুরবাসীর কাছে প্রথম বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। আসলে জাড়া গ্রামের খ্যাতি ছিল কবিগানের জন্য। সেই অজানা কাহিনী ও ইতিহাস তাঁর কলমে উঠে এসেছে প্রাঞ্জলভাবে। রোহিনীনাথ মঙ্গল সম্পর্কে তাই প্রাবন্ধিক তথা নজরুল গবেষক আজহারউদ্দিন খান বলেছিলেন 'রোহিনীনাথের বুদ্ধিদীপ্ত রসস্নিগ্ধ সরল রচনাভঙ্গি পাঠকের স্বীকৃতি লাভ করেছে'। 

রোহিণীনাথ মঙ্গল জন্মগ্রহণ করেন চন্দ্রকোণা থানার জাড়া গ্রামে ১৯৩৮ এর ১৭ ই জুন। বাবা ডাঃ যতীন্দ্রকুমার মঙ্গল এবং মা ইন্দুরেখা মঙ্গল। বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক পাশ করেন হুগলির শ্রীরামপুর কলেজ থেকে। এরপর সেখানে এক বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। কিন্তু পরে বুঝলেন যে, মেয়েদের বিদ্যালয়ে পুরুষ শিক্ষকদের স্থায়ীকরণ হয়না। মাত্র এক বছর তিন মাস এখানে চাকরি করার পর ছেড়ে দেন। সংসার চালানোর জন্য ঢুকলেন কোন্নগরে একটি পোশাক তৈরির কারখানায়। কিন্তু সেখানে বারংবার বাম আন্দোলনের নিরিখে 'স্ট্রাইক' চলছিল কারখানায়। বেতন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় এবং স্থায়ী উপার্জনের আশায় কারখানার চাকরিটা ছেড়ে দেন। এখানে প্রায় পাঁচ বছর কারখানার শ্রমিক হিসেবে থাকার পর ১৯৬৫ সালের মে মাসে যোগ দিলেন হুগলির হাজিপুর ইউনিয়ন হাইস্কুলে। বিজ্ঞান শিক্ষক হয়ে এখানে দীর্ঘদিন অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে শিক্ষকতা করার পর অবসর নেন ২০০০ সালে। শিক্ষকতা পেশা থাকলেও তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল জেলার গর্ব করা বিষয়গুলো তুলে ধরা সর্বসমক্ষে। তাই আজও সচল রেখেছেন তাঁর কলম। এ পর্যন্ত লিখে ফেলেছেন প্রায় ছয় শতের বেশি নানা ধরনের প্রবন্ধ। যা নানা দিক থেকে উদ্ভাসিত করেছে মেদিনীপুরকে। মেদিনীপুর সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক এই মানুষটিই। কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্র পত্রিকাতেও লিখেছেন অসংখ্য প্রবন্ধ। 
জাড়া রাজবাড়িতে রোহিনীনাথ মঙ্গল

পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েও কিভাবে আঞ্চলিক ইতিহাস এবং লোকসংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ তৈরি হল? তিনি জানান, সেসময় জাড়া হাইস্কুলের শতবার্ষিকী চলছিল। তিনি হয়েছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট। তাঁরই উদ্যোগে প্রকাশিত হল বিদ্যালয়ের ইতিহাস নিয়ে বিশেষ স্মরণিকা। সেখানে জাড়ার ইতিহাস নিয়ে প্রথম তুলে ধরলেন অনেক অজানা কাহিনী। যা পড়ে বহু বিদগ্ধ মানুষ এ সম্পর্কে আরও তথ্য তুলে ধরে লিখতে বলেন। সকলের চাহিদা পূরণের জন্য শুরু করেন নিরন্তর প্রচেষ্টা। ব্যাস, আর থেমে থাকেনি তাঁর কলম। শুরু করেন নিরলস ক্ষেত্র সমীক্ষা এবং তথ্যানুসন্ধান। নিবিড় গবেষণার মাধ্যমে তুলে আনেন জাড়ার সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং অজানা কাহিনী। 
জাড়া রাজবাড়ি

যদিও প্রথমেই লেখেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ডাঃ যতীশচন্দ্র ঘোষকে নিয়ে বই -- 'যতীশচন্দ্র ঘোষ : এক অনন্য ব্যক্তিত্ব' (১৩৯৮)। যতীশচন্দ্র ছিলেন ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের খুব কাছের মানুষ। ১৯৫২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থীকে পরাজিত করে জয়ী হন। এই সময়ে ঘাটালে জনসভায় বক্তৃতা দিতে আসেন জ্যোতি বসু। সেখানে তিনিও বক্তব্য রাখেন। হুগলির নকুণ্ডা গ্রামে জন্মগ্রহণ করা (১৮৯৮) সেই বিখ্যাত ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা বইটি ব্যপক সাড়া ফেলে। অনেক অজানা তথ্য সমৃদ্ধ বইটি লেখককে প্রতিষ্ঠিত করে ইতিহাসকার হিসেবে। এরপর লিখলেন 'বিদ্রোহী রাজা শোভা সিংহ' নামে ইতিহাস আশ্রিত একটি গবেষণাধর্মী বই (১৪০৬)। আনুমানিক সতের শতকের শেষ দিকে দুর্জয় সিংহের জেষ্ঠ্য পুত্র শোভা সিংহ চেতুয়া বরদা মহালের জমিদার হন। তাঁর রাজধানী ছিল রাজনগরে। ১৬৯৫ সালে তিনি মোঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। বরদায় দেবী বিশালাক্ষীর মন্দির তাঁরই প্রতিষ্ঠিত। ১৬৯৬ সালে বর্ধমানের রাজকুমারী সত্যবতীর হাতে তাঁর মৃত্যু হয়। এহেন তাবড় ব্যক্তিত্ব কিন্তু উপেক্ষিত ব্যক্তির জীবনের নানা কাহিনী তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর বইতে। সবশেষে লেখেন 'জাড়া গোলক বৃন্দাবন' (৯ ই কার্তিক,১৪১০)। 
জাড়া রাজবাড়ি

জাড়ার রায় পরিবারের সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলনের বহু নেতার গভীর সংস্পর্শ ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের আঁতুড়ঘর ছিল এই পরিবার। স্বাধীনতা সংগ্রামী কিশোরীপতি রায়, সাতকড়িপতি রায়, সনাতন রায় এই পরিবারের বীর সন্তান। শোনা যায় এই পরিবারে রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগরের নিত্য যাতায়াত ছিল। একসময় এই রায় পরিবারের সঙ্গে কলকাতার ঠাকুর পরিবারের তুলনা করা হত। সেই পরিবারের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরেছেন একজন যথার্থ ইতিহাসকার এবং পণ্ডিত ক্ষেত্রসমীক্ষক হিসেবে। জাড়ার রায় পরিবারের প্রাচীন সেই প্রাসাদের স্থাপত্য ক্রমশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। রোহিনীনাথের বক্তব্য, এইসব পুরাকীর্তিকে সংরক্ষিত করতে হবে। তবেই পাওয়া যাবে আরও নানা ধরনের তথ্য। তাঁর লেখা 'জাড়া গোলোক বৃন্দাবন' বইটিতে সেই সব তথ্য আর পরামর্শই লুকিয়ে আছে থরে থরে। 

হুগলী ও পশ্চিম মেদিনীপুরের সীমান্তবর্তী এলাকার এই লোকগবেষক বারবার তুলে এনেছেন সীমান্ত বাংলার সংস্কৃতিকে। লৌকিক উপাদান, উৎসব, বিভিন্ন পার্বণ, গ্রাম্য মেলা, ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস সহ নানা বিষয়ে লিখেছেন রচনা। তাঁর লেখা বই বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ বেঙ্গল স্টাডিজের জন্য রেফারেন্স বই হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি কখনো কোনো পুরস্কার বা সম্মাননা প্রাপ্তির কথা ভাবেননি। আশাও করেননি। নিরলস এবং নিশ্চুপ ভাবে কাজ করে গিয়েছেন একান্তে। স্বপ্ন ছিল, কিছু সদর্থক কাজ করার। সেই কাজ তাঁকে অচিরেই 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে বলা যায়।

🍂

Post a Comment

1 Comments

  1. রোহিনীবাবুকে আলোকিত করা খুবই প্রয়োজন ছিল।

    ReplyDelete