জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় / নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় 

     
নির্মল বর্মন

কথাসাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিত্ব।তবে সমালোচকও বটে। সময় সম্ভবত বিশ শতকের ত্রিশের দশক। কথাসাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়  মনন ও চিন্তনের ক্ষেত্রফল মূলতঃ সাহিত্য সংস্কৃতি, অর্থনীতি,ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, ও সংগীত। তাঁর কথাসাহিত্যের পাতায় স্থান পেয়েছে সুতীক্ষ্ণ মননশীলতা ও সুবিন্যস্ত স্টাইল এবং সুচিন্তিত স্বকীয়তা।
কথাসাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছোটগল্পের একমাত্র সংকলন ''রিয়ালিস্ট'' (১৯৩৩)। স্বভাবতই 'রিয়ালিস্ট' নামক  সংকলনে পাঁচটি গল্প স্থানলাভ করেছে---''একদা তুমি প্রিয়ে'', ''ভূতের গল্প'', "প্রেমপত্র'' ''রিয়ালিস্ট'' ও "মনোবিজ্ঞান"। 
''রিয়ালিস্ট''বর্তমান সময় ও সমাজে  দাম্পত্য সম্পর্কের চরিত্রচিত্রণ তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ বিদ্রুপের মাধ্যমে চিত্রিত । 
সাহিত্যিকের ''একদা তুমি প্রিয়ে'' গল্পটিতে-- 
             ''লেখক এক সুপরিচিত গানের মনোভাবমূলক প্রতিবেশ কল্পনা'' জনপ্রিয় করার জন্য একটি রোমাঞ্চকর কাহিনি রচনা করে জনগণ কে উপহার দিয়েছেন। 
''রিয়ালিস্ট'' গল্প সংকলনের   গল্পগুলিতে সাহিত্যিক প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরীর বুদ্ধিদীপ্ত বাগবৈদগ্ধ্যকে পাথেয় করলেও তাতে সম্পূর্ণ সাফল্যের যাদু স্পর্শ  করতে পারেননি। সুতরাং বুদ্ধির সঙ্গে হৃদয়ের মেলবন্ধন গল্পগুলিকে স্বতন্ত্র মর্যাদা ও কালজয়ী ভাবনায় উত্তীর্ণ  করেছে। বস্তুতঃ তাঁর তথা সাহিত্যিকের কাছে"মূলত‌' ''গল্প লেখার শিল্প-খেলা''।
কথাসাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস সম্ভার:-''অন্তঃশীলা'' (১৯৩৫), ''আবর্ত'' (১৯৩৭), ''মোহানা'' (১৯৪৩)। 
কথাসাহিত্যিকের উপন্যাসে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি,মৌলিকতা অনুভূত । ত্রয়ী উপন্যাসের প্রথম দু'ভাগের সমালোচনায় কবি বিষ্ণু দে'র মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:-  
   ‌     "লেখকের পুরুষার্থ ও তাৎপর্যার্থের আবশ্যিকতায় যে ছন্দ সমগ্র রচনার অস্থিমজ্জায় ছড়িয়ে পড়ে, সেই ছন্দের নির্দেশে, ভাষা ব্যবহারে, প্লট গতিতে, গল্পের বিকাশেই পাত্র-পাত্রীর আবির্ভাব। শুধু চরিত্রই যদি উপন্যাসের উৎস হত, তাহলে টলস্টয়ের সমর ও শান্তি, হোমারের ওডিসি বা রবীন্দ্রনাথের গোরা, এমন কি প্রুস্তের অতীতের অন্বেষণের মত ব্যক্তিমনসর্বস্ব উপন্যাসের কার্যকারণ নির্ণয় করা যেত না। সুখের বিষয় ধূর্জটিবাবু পুরুষার্থ যে তাৎপর্যার্থে অস্তিত্ব পায় একথা বোঝেন।"

🍂

প্রখ্যাত সমালোচক সাহিত্যিক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় , ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস তিনটির নামকরণ সম্পর্কের মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ ;--
                "... গ্রন্থ ত্রয়ের নামকরণ খগেনবাবুকে লক্ষ্য করেই হয়েছে বললে ভুল হবে না। খগেনবাবুর অন্তঃশীলা জীবন-পিপাসা সংসারের নানা অভিজ্ঞতার, আত্মনিরীক্ষার জটিল আবর্তগুলি পেরিয়ে মোহানায় উপনীত হয়ে খুঁজে পেয়েছে মানুষের জন্য বেঁচে থাকাতেই সার্থকতা।" 
আবার কিংবদন্তি সাহিত্যিক সুকুমার সেন বলেছেন:-                                                                "পোলিটিক্যাল ও সামাজিক আবেষ্টনে দুই সমসাময়িক নরনারীর আত্মজিজ্ঞাসার ও প্রেম-উপলব্ধির ইতিহাস ইহাতে বর্ণিত। বাঙ্গালা উপন্যাসের টেকনিকে এ বস্তু আনকোরা না হইলেও অপরিচিত বটে।" 
বিখ্যাত সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরস মন্তব্য স্মরণীয়:-
"উপন্যাস ত্রয়ীতে তীক্ষ্ণ মননশক্তির সহিত খাঁটি ঔপন্যাসিক উৎকর্ষের সমাবেশ হইয়াছে। খগেনবাবুর আত্মসন্ধান ও জীবন সমালোচনার ফাঁকে ফাঁকে তাহার দাম্পত্য বিরোধের যে খণ্ড খণ্ড দৃশ্য ও হ্রস্বসংকেত মিলে সেগুলি বর্ণোজ্জ্বল্যে ওনির্বাচন-সার্থকতায় এক সম্পূর্ণ চিত্রে সংহত হইয়াছে।" 
সাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় উপন্যাস ত্রয়ী-তে জীবন যাপনে সামগ্রীক রূপ,রস-কে অনুসন্ধান ও সুনিবিড় ভাবনাকে আলোচনা করেছেন। উপন্যাসের থিম '                       'সাবিত্রী ও  রমলার সঙ্গে খগেনবাবুর  সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ও জটিল রহস্যময় আবেগ লক্ষ্য করা গেছে। খগেনবাবুর ভ্রমন সংক্রান্ত জীবন ও দক্ষতা গড়ে ওঠার প্রেক্ষিতে পরিপূর্ণ । অন্যত্র ' আবর্ত' ,'অন্ত্যশীলা  উপন্যাসের উপসংহার। 'আবর্ত'-উপন্যাসে  'পূর্বের ঘটনা' ও চরিত্রচিত্রনে বিশ্লেষণ পরস্পরের পরিপূরক। 'মোহানা'-উপন্যাসে  মাসীমণি'র  মৃত্যুতে খগেনবাবু ও রমলার মিলনে শখের লৌকিক অন্তরায়কে সরিয়ে দিয়েছে। বস্তুতঃ থিম  দ্বিধা বিভক্ত হয়েছে--- একদিকে খগেনবাবু  ও রমলার সম্পর্কের মানবিক আন্তরিক আবেদন, অন্য দিকে কানপুরে শ্রমিক ধর্মঘটের অশান্তি।  ধর্মঘট তথা মজুর বিক্ষোভ সমাবেশ খগেনবাবু ও রমলার মধ্যে ব্যবধানকে বাড়িয়ে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। রমলাদেবীকে খগেনবাবু একসময় সহধর্মী রূপেই ভেবেছিলেন। কিন্তু ঘটনা পরম্পরায় খগেনবাবু উপলব্ধি করলেন রমলাদেবীর তুলনায় যথেষ্ট জীবন বড়।
        খগেন ও রমলার ভালোবাসার টানাপোড়েন অনেকটা রবীন্দ্র উপন্যাস 'চতুরঙ্গ'-এর শচীশ-দামিনীর সম্পর্কের দ্বন্দ্বমূলক করণকৃতি।
কথাসাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় 'অন্তঃশীলা' উপন্যাসে রমলা-র চরিত্রচিত্রন জীবন্ত ও বাস্তবানুগ । রমলার সংযম, শালীনতাবোধ  কীভাবে নগ্ন বাস্তবতা ও অভিঞ্জতায় হারিয়ে যায়, সেদিকটি 'আবর্ত'- উপন্যাসে বর্ণিত।  সুজন, সাবিত্রী চরিত্র ভাবনা বাস্তব রেখায় চিত্রিত। ঔপন্যাসিক উপন্যাসগুলোতে চেতনাপ্রবাহ রীতির  সঠিক প্রয়োগ করেছেন ।  ফলতঃ খগেনবাবুর চিন্তা-
চেতনা  বুদ্ধি, শিক্ষাদীক্ষা, রুচিবোধ এবং বিচারশক্তির উৎর্বগামিতা চেতনাপ্রবাহ রীতির মাধ্যমে প্রকাশিত। সাবিত্রী'র "আত্মহত্যা, দাহ দৃশ্য, রমলাদেবীর আতিথেয়রা, সুজন-বিজনের ঘনিষ্ঠতা, বিষয়ান্তরে যাত্রা, স্মৃতি থেকে বাস্তবে ফিরে আসা প্রভৃতি stream of consciousness", কেই সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।

কথাকার ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়''অন্তঃশীলা'' সম্পর্কে সরস মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:-- 
''অন্তাশীলা' আমি ভাবের বসে লিখিনি”, 
তাসত্ত্বেও খগেনবাবু সম্পর্কে কঠিন প্রশ্ন ওঠে:-
"খগেন চরিত্র হিসেবে কেবল impossible না, futile' বাংলা উপন্যাসে চেতনাপ্রবাহ বৃত্তে উপন্যাস ত্রয়ী ব্যতিক্রমী উদাহরণ লেখকের সাঙ্গীতিক বোধের জন্যে"।
          ‌অবশেষে "আবর্ত'' উপন্যাসের সংলাপ :-  খগেনবাবুর অনুন্নতির প্রেক্ষিতে:- 
"ভোর ভৈঁ-সানাই বেজে ওঠে, অতি কোমল রেখাতে, শুদ্ধ গান্ধার স্থায়ী হয় না, একেবারে মধ্যমে আশ্রয় নেয়, তারপর মধ্যম থেকে মীড় টেনে অতি কোমল রেখাতে অবরোহণ করে...। 
বুদ্ধিজীবী কথাসাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় আধুনিক মানববন্ধনের চেতনা ও মননশৈলী , নগরকেন্দ্রিক জীবনদর্শনের  অন্তর্দ্বন্দ্ব ও হৃদূযন্ত্রণা ও  টানাপোড়েন' ভাবনা কে চেতনাপ্রবাহ রীতিতে যেভাবে দেখানোর সুযোগ করে দিয়েছেন  তা কথাসাহিত্যে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে চিরস্মরণীয় করে রাখার কথা থাকলেও বর্তমান সময় ও সমাজের কাল চেতনায় বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments