জ্বলদর্চি

বিদ্বেষে--বিষাদে --রবীন্দ্রনাথদ্বিতীয় পর্ব--বিপিনচন্দ্র পাল ও অন্যান্যরা /তনুশ্রী ভট্টাচার্য

বিদ্বেষে--বিষাদে --রবীন্দ্রনাথ

দ্বিতীয় পর্ব--বিপিনচন্দ্র পাল ও অন্যান্যরা

তনুশ্রী ভট্টাচার্য 



     পোয়েট টেগোর কে হন তোমার  
জোড়াসাঁকোতেই থাকো?
বাবার খুড়ো হন যে শুনিয়াছি‌
মোর কেহ হয় নাকো।

তাঁকে পরিজন হিসাবে অস্বীকার করার চূড়ান্ত নিদর্শন পাই সুভো ঠাকুরের এই বহুল প্রচলিত ছড়ায় এবং অবশ্যই সেটি ব্যক্তিগত অসূয়া প্রসূত।চার অধ্যায় উপন্যাস রবীন্দ্রনাথের মৌলিক রচনা নয় এটি কারো একটা লেখার কাছে আপাদমস্তক ঋণী --এই অপবাদ দিয়েছিলেন কবির  বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথের চতুর্থ পুত্র সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম পুত্র সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন হেমেন্দ্রনাথের পৌত্র সুভগেন্দ্রনাথ  ঠাকুর (সুভো ঠাকুর)।  মনে রাখা যেতে পারে শেক্সপিয়ারের ছত্রিশ  টি নাটক কোন না কোন পূর্ব ঘটনা বা সূত্র বা কোন পূর্বজ লেখকের লেখা থেকে মাত্রই এক লাইন নেওয়া। তবে নাটকগুলিতে  তাঁর মৌলিকতার কোন ঘাটতি নেই বরং  প্রতিভার স্পষ্ট ছাপে সেগুলি মৌলিক হয়ে উঠেছে। যখন অসূয়া প্রসূত কেউ রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ আনেন তখন সেই মুহূর্তে কবির মনোবেদনা বোঝা যায়। কালের প্রবাহে সেই অসত্য ভাষণ ধূলায় মিশে যায় কিন্তু তার ইতিহাসটি থেকে যায় এবং অবশ্যই অমর সৃষ্টি নিয়ে কবি থাকেন সৃজনশীল মানুষের মনোলোকে।
পরিবারের মধ্যে থেকেই বারবার নিন্দার আঘাত পেয়েছেন কবি। বিরোধ নিন্দা শত্রুতা বন্ধু বিচ্ছেদ রবীন্দ্রনাথের জীবনে বার বার এসেছে এবং এসেছে সবথেকে ঘনিষ্ঠদের থেকে এবং অহেতুক অনেকেই তাতে যোগ দিয়ে একটু ক্ষুদ্র আনন্দ পেয়েছেন। উল্টো দিকে কবি প্রত্যুত্তরে নীরব থাকাকেই শ্রেয় মনে করেছেন। 

🍂

ব্যক্তি জীবন নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি মনে হয় সারা বিশ্বেরই এক কদর্য আনন্দের ক্ষেত্র। রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপিয়ার কেউই রেহাই পাননি। শেক্সপিয়ারের নাটকগুলি যখন চূড়ান্ত সাফল্য পাচ্ছে তখন একদল হিংসুটে মানুষ  বলতে শুরু করল--- নাও উই আর ইন্ট্রোডিউসিং সেক্স সিন! আর কলকাতায় রবীন্দ্রনাথকে শুনতে হয়েছিল তিনি নাকি যৌবনে সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অবতার নামে একটি স্বল্প পরিচিত কাগজ এই উদ্ভট মন্তব্য করে কবিকে কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করেছিল।
সংবেদী মানুষ রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ে এইসব নিন্দা কুৎসিত ইঙ্গিত চূড়ান্ত ক্ষয় ধরাত এবং গড়পড়তা সাধারণ মানুষের থেকে তিনি এগুলিতে বেশি মানসিক আঘাত পেতেন। কিন্তু অনেক কিছু করার অবকাশ থাকলেও তিনি তাঁর দীক্ষিত হৃদয়ের সাধনায় সেগুলি অনায়াসে পাশে সরিয়ে রাখতে পারতেন এবং নিজের সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করতে পারতেন। মানবতা ভালোবাসা ও আরাধনার বিপরীতে নঞর্থক অবস্থান রবীন্দ্রনাথের স্বভাববিরুদ্ধ।  তাই অতি প্রিয় জগদীশচন্দ্র বসু অবলা বৌঠানের সঙ্গেও তাঁর বিচ্ছেদ হয়েছে তাঁদের পালিত ভাইপো অরবিন্দ মোহন বসুর জন্য। বিদ্বেষী হয়েছেন চিত্তরঞ্জন দাসের  মত মানুষও অথচ যাঁর দেহান্ত কালে কবি লিখলেন-- "এনেছিলে তুমি মৃত্যুহীন প্রাণ মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।"
মনে রাখা যেতে পারে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে চিত্তরঞ্জন দাস কে আহবান করেও কবি পাশে পাননি। সারারাত ভেবে পরের দিন তিনি একাই প্রতিবাদ করলেন নাইট উপাধি ত্যাগ করে।

আশ্চর্য এক ঘটনা। কবি দীনেশচন্দ্র সেনের সঙ্গে কবির ছিল হৃদ্যতা । তাঁর ছেলে অরুণ শান্তিনিকেতনের  ব্রহ্মচর্যাশ্রমে যাওয়ার পর এতটাই আত্মমগ্ন হয়েছিলেন যে বাবা দীনেশচন্দ্র সেনের  মতে বিয়ে করতে অস্বীকার করেন । এই ঘটনায় দীনেশচন্দ্র সেন দায়ী করেন কবিকে এবং একটা শত্রুতার পরিবেশ তৈরি হল কবির সঙ্গে।
বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক শত্রুতা বিদ্বেষ অপবাদ তাঁকে  ঘিরে ধরতে  লাগলো।কবির  মেজদার নাতি সুবীরেন্দ্র নাথ কে শ্রীনিকেতন থেকে চলে যেতে হয়েছিল প্রতিষ্ঠানের নিয়ম নীতির কারণে কিন্তু সেখানেও মূল শত্রু হলেন কবি।
একজন দিকপাল রবীন্দ্র বিরোধী ছিলেন বিপিনচন্দ্র পাল। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত রচনা কল্পনা ও সাধনা কে তিনি অনায়াসে ফাঁকি বলে নিন্দামন্দ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনের গভীরতায় ডুব দেওয়ার ইচ্ছাটি  তাঁর ছিল না বা হয়তো সক্ষম ও ছিলেন না। না হলে "স্ত্রীর পত্র " র মতো নারীমন বিকাশ ও  উদ্ঘাটনের  বলিষ্ঠ প্রথম শ্রেণীর  গল্পকে এমন প্রবল নিন্দা ,তুমুল অপযশ, চ্ছি চ্ছিকার  করতেন না। অবশ্য তাঁর সঙ্গে আরো একজন প্রতিষ্ঠিত আলোকিত মানুষও যোগ দিয়েছিলেন।। তিনি চিত্তরঞ্জন দাশ। "স্ত্রীর পত্র"এর প্রতি তাঁর ও তুমুল বিতৃষ্ণা ছিল। ঘরের স্ত্রীকে বাইরে বের করে আনার মতো ঘটনা কে তিনি নিন্দা যোগ্য বলেই মনে করতেন। নারীর অবগুন্ঠন মুক্তির কথাটি তাঁদের মাথায় সে সময় আসেনি ।সেজন্যেই রবীন্দ্রনাথ তাঁদের থেকে অনেক এগিয়ে। বিশ্ব সমাজ যে দিকে এগোচ্ছিল রবীন্দ্রনাথ সেই মূল সুরটি  তাঁর সৃষ্টিতে ধরে রাখতে পারতেন আর সীমাবদ্ধ চিন্তাধারার কিছু মানুষ তার প্রতিবাদ করতেন।কবি  তীব্রভাবে ব্যথিত হতেন কিন্তু নীরব থাকতেন। আধুনিক চিন্তাভাবনার সঙ্গে তাঁদের চিন্তা মিলল না। সুতরাং তাঁরা রবীন্দ্র বিদ্বেষী হয়ে উঠলেন। ১৩২১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণে সবুজপত্র পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের" স্ত্রীর পত্র "প্রকাশিত হবার পর চিত্তরঞ্জন দাস প্রতিষ্ঠিত নারায়ণ পত্রিকায় বিপিনচন্দ্র পাল লেখেন "মৃণালের কথা" নামক গল্পটি। রক্ষণশীলদের পক্ষ থেকে "স্ত্রীর পত্র" র প্রতিবাদ হিসেবে এই সুদীর্ঘ গল্পে বিপিনচন্দ্র পাল রবীন্দ্রনাথের চেহারা কথা বলার ধরন পোশাক এবং তার মানসিকতা কে তীব্র ব্যঙ্গ করেন এবং এই নারীর মুক্তির ব্যাপারটি কে হেয় করেন। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেন চিত্তরঞ্জন দাস। কিন্তু কবির মনে কোন বিদ্বেষ ছিল না। কবির দিক থেকে কোন বিদ্বেষী মনোভাব না পাওয়ার ফলে যেমন অনেকে ক্ষিপ্ত হতেন আবার অনেকেই নিজেদেরকে সংযত করে হয়তো নিজেদের ভুল বুঝতে পারতেন। না হলে প্রবল রবীন্দ্র বিরোধী বিপিনচন্দ্র পাল নোবেল প্রাপ্তির দেড় বছর আগেও যিনি রবীন্দ্রনাথের সাধনাকে ফাঁকি বলেছেন নোবেল পাওয়ার পর কবিকে সংবর্ধনা দিতে যে সভা হয়েছিল  সেখানে তিনি  প্রথম সারিতে উপস্থিত হতেন না । আপাতদৃষ্টিতে এটা মিলনের পরিচয় কিন্তু ততদিনে এই অহেতুক বিরোধীতায় কবির  হৃদয়ের নীরব  ক্ষরণ হয়ে গেছে। তিনি জানতেন নিন্দা ও দ্বেষের সঙ্গে কিভাবে লড়াই করবেন। তাঁর স্পষ্ট আদর্শ ছিল-- বিদ্বেষ হল ভালোবাসা ও আরাধনার বিপরীত তাই বিদ্বেষের বদলে বিদ্বেষ তাঁর জন্য নয়। দেশবন্ধুর  প্রতিও তাঁর একই শ্রদ্ধা ছিল বৈরী সম্পর্ক হওয়ার পরেও। না হলে তিনি তাঁর মৃত্যুর পরে ঐ মর্মস্পর্শী এপিটাফ টি লিখে দিতেন না।  তিনি তাঁর জীবন দর্শনে অটুট রাখতেন নিজের মনোবল। এখানেই রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি নন একজন দার্শনিক একজন ঋষি একজন জীবন বেদজ্ঞ।।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

1 Comments