বিস্মৃতপ্রায় কথাসাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী
নির্মল বর্মন
কথাসাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী বিচিত্র ভাবনার প্রাবন্ধিক, ব্যঙ্গাত্মক ও কৌতুকরসাশ্রিত গল্প ও রসরচনায় প্রসিদ্ধি । পরিমল গোস্বামী ১লা সেপ্টেম্বর ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের তথা বর্তমানে বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলয় জন্ম গ্ৰহন করেন। পিতা বিহারী লাল গোস্বামী সাহিত্যিক ও প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ছদ্মনাম "এক কলমী"। যুগান্তর,' 'প্রবাসী' ও 'শনিবারের চিঠি' ইত্যাদি কালজয়ী পত্রিকার সঙ্গে পরিমল গোস্বামীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। ছদ্মনাম ''এক-কলমী'' হিসেবে বেশকিছুদিন 'যুগান্তর' পত্রিকার পাতায় সরস ও ব্যঙ্গাত্মক মনোবিজ্ঞান সৃষ্টি করে সুযশের অধিকারী হন। ২৭ শে জুন ১৯৭৬ সালে কলকাতা তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ছোটগল্পকার পরিমল গোস্বামী'র গল্পগ্ৰন্থ;--
''বুদ্বুদ'' (১৯৩৬), "ট্রামের সেই লোকটি'' (১৯৪৪), ''ব্ল্যাকমার্কেট'' (১৯৪৫)," মারকে লেঙ্গে"'-১৯৫৪,"স্কুলের মেয়েরা'' (১৯৫৪), ''ম্যাজিক লণ্ঠন'' (১৯৫৫), ''বারো ভূতের আসর'' (১৯৬০), "মহামন্বন্তর", " সপ্তপঞ্চ", "পত্রস্মৃতি", "পথে পথে", "যখন সম্পাদক ছিলাম " ইত্যাদি।
🍂
কথাসাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী সমকালীন ও সাবেক জীবনযাপনের বহুবিচিত্র অসঙ্গতি তথা যে কোনো কৌতুকরসের শিল্পী। তাঁর বিচিত্র ভাবনা কখনোই ব্যতিক্রম ছিল না। অন্যান্য কথাশিল্পী থেকে তিনি বিরাট ব্যতিক্রমী, তার কারণ হল "তাঁর গল্প বলার ভঙ্গি ও কৌশল"। বস্তুতঃ কথাকার পরিমল গোস্বামী'র নৈর্ব্যক্তিক ভঙ্গিতে বিবরণ ভাবনার মাধ্যমে গল্পের কাহিনি ও উপকাহিনি প্রসারিত করেছেন , কখন যে চূড়ান্ত আঘাতের চরম বিন্দু আছড়ে পড়বে, তা না এসে পৌঁছলে পাঠকরা বিন্দুমাত্র আগে থেকে অনুমান করা প্রায়ই অসম্ভব। ছোট গল্পের কাহিনি বিন্যস্ত। তথ্যে ভরপুর, কোথাও কোনো জিরো বা ফাঁক বা শূন্য স্থান আপাতত নেই।গল্পপ্রিয় পাঠক সম্মোহিত ও বিশ্লেষণী কাহিনির মধ্যেও নতুন ভাবনা অনুভব করেছিল। কথাসাহিত্যিক পরিমল গোস্বামীর গল্প ও ব্যঙ্গরসের সুনিপুণ কৃতিত্বের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে আর এক কথাকার ও ব্যঙ্গশিল্পী প্রমথনাথ বিশী'র মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য :--
"ইস্পাতের ছোরাখানা লেখকের কোমরবন্ধে কোথায় যে লুক্কায়িত সব সময় দেখিতে পাওয়া যায় না, হঠাৎ প্রকাশিত হইয়া আঘাত করে, আবার বিদ্যুতের চমকের মত মেঘান্তরালে মিলাইয়া যায়। এইজন্যই তাহা ব্যঙ্গের তলোয়ারের চেয়ে বেশি মারাত্মক।"
('পরিমল গোস্বামীর শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গ গল্প')
পরিমল গোস্বামী বিশেষ করে ব্যঙ্গপরিবেশ সৃষ্টিতে এবং জ্বালা যন্ত্রণাহীন ব্যঙ্গের সুকৌশলী প্রয়োগে তাঁর কৃতিত্ব প্রশংসনীয় ও সৌন্দর্মন্ডিত। কবিশেখর কালিদাস রায় মহোদয় কথাসাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী'র ছোটগল্পের শৈলীর প্রশংসা প্রসংশনীয়:-
"গল্পগুলি পড়িতে মুখ হাসে সামান্যই, মন হাসিতে থাকে বহুক্ষণ এবং মনে হাসির দাগও থাকিয়া যায়।"
('পরিমল গোস্বামীর শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গ গল্পের সমালোচনা')
কথাসাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী পরশুরাম বা ত্রৈলোক্যনাথের মতো ভূতের গল্প লিখেছেন বটে কিন্তু তাঁর ভূতের গল্প সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ; কারণ ভূতের গল্প হলেও তা নির্ভেজাল ও চূড়ান্ত ভূতের গল্প নয়।
পরিমল গোস্বামীর ভূতের গল্প সংকলন:--
"বারো ভূতের আসর"' গল্প সংকলনই প্রমাণ। সংকলনের গল্পগুলির নামকরণের মধ্যেও রয়েছে বিষয় বৈচিত্র্য। দৃষ্টান্ত:- ''ভূতপূর্ব ভূত'', ''গভঃ রেজিঃ ভূত'', ''ভূত দেখা সহজ'', ''ভূতের ডি.ফিল'', ''সব ভুতে গল্প হয় না'', ''পাথুরে ভূতের গল্প'', ''ল্যান্সডাউনের জোড়া ভূত'' ইত্যাদি। গল্পকার পরিমল গোস্বামী ভূতকে কেন্দ্র করে সরস গল্প উপহার দিয়েছেন। উদাহরণ:--"ভৌতিক গল্প''-তে ভূত যে রাম-নাম নিতে পারে না, তা সুন্দর ভাবে ব্যক্ত হয়েছে:-
"ঈশান রুদ্ধ কণ্ঠে ভূতকে বলিল, 'আপনি তো ভূত, ভূত-ভবিষ্যৎ সবই আপনার নখদর্পণে, আপনি আমার একটা উপকার করবেন'।'উপকার'? কি বল।
আমার শুধু এখন জানতে ইচ্ছে, মালতীর বাবা এ বিয়ে ভেঙে দিলেন কেন। ভূত বলল, 'আরে লক্ষ্মণের দাদা, লক্ষ্মণের দাদা, ও কি কর, পায়ে ধরো না' আমি এমনিতেই বলছি"।'
কথাকার পরিমল গোস্বামী শুধু ভূত সর্বস্ব গল্প নয়, সমকালীন কালজয়ী সমাজের নৈতিক স্খলন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাও তাঁর ভাবনার মুল থিম।এই ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ব্যঙ্গের গল্প রচনা করেছেন। কথাকার পরিমল গোস্বামী "সবক্ষেত্রেই ব্যঙ্গের তীব্রতা, আকস্মিকতা ও যথানির্দিষ্টতা" দৃষ্টিভঙ্গি গল্পের মধ্যে থাকলেও পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রেক্ষিতে আজ বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক।
2 Comments
অসম্ভব ভালো দেখা। নজরে এলে এক নিমেষে পড়ে ফেলি। চলতে থাকুক এরকম লেখা। ড. নির্মল বর্মের বিস্মৃত প্রায় সাহিত্যিক পরবর্তী ছাত্রী ছাত্রদের ও বিভিন্ন লেখক দের জন্য পান্ডুলিপি হয়ে থাকলো।
ReplyDeleteলেখা
ReplyDelete