চরণচিহ্ন
পুলককান্তি কর
স্বামীর মৃত্যু সংবাদটা শুনেও তেমন একটা কষ্ট অনুভব করলেন না লতা। বিরাশি বছর বয়সে মারা গেলেন তিনি৷ হয়তো এতদিনের দাম্পত্যে সম্পর্ক সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল; নতুবা মন হয়তো অনেক দিন থেকে তৈরি হয়েই ছিল এই রকম একটা খবর কোনও না কোনও দিন শুনবে বলে। শরীরটা যে হরিসাধনের খুব একটা বেগড়বাঁই করছিল, তা নয়। ওই সাধারণ বয়স জনিত সমস্যা। গত পরশু বিকেলের দিকে বুকে একটু চাপ অনুভব করছিলেন তিনি৷ সাধারণ গ্যাস অম্বলের ওষুধে কাজ না হতে পাড়ার নার্সিংহোমে ভর্তি করে দিয়েছিল লাল্টু। সেখান থেকেই সকাল সাতটা নাগাদ ফোন এসেছিল, খবরটা দিতে। এ কান-ও কান হতে হতে পাড়া প্রতিবেশীরা যখন ঘরে এসে ভিড় জমাল, তখন আটটা বাজে। অগত্যা পড়শি সমবয়সিনীদের সাথে বিলাপে মনোযোগ দিলেন তিনি।
-- হ্যাঁ রে চাঁপা, মৃত্যুর সঠিক সময়টা কইতে পারস ?
চাঁপা ওঁদেরই প্রতিবেশী লাল্টুর বউ। বলল, ‘ও তো গেছে ওখানে। এবার যখন ফোন করবে জেনে নেব।‘
-- পাঁজিতে লিখসে, ছয়টা বিয়াল্লিশ পর্যন্ত ভালো টাইম। মরলে দোষ নাই। ওরা তো আমারে সাতটা নাগাদ ফোন করসিল, মনে হয় দোষ পাইসে। পুরুত মশাইরে একটা খবর দিতে পারস ?
-- ওনার ফোন নাম্বারটা দিও। খবর দিয়ে দেব।
-- ওসব তো ওই রাখতো ! কোথায় সব নাম্বার রাখসে ক্যাডায় জানে? আবার বিলাপ করে উঠলেন তিনি।
-- ঠিক আছে৷ ওকে বলে দেব, ফেরার সময় ওনার বাড়িতে গিয়ে খবর দিয়ে আসবে। শুনেছি তো মারা যাবার চারঘণ্টা পরে বডি ছাড়ে। তা মিনিমাম সাড়ে দশটা এগারোটার আগে যে বডি আসবে না, তা তো বোঝাই যাচ্ছে৷
-- ঠিক আসে৷ তুমি ততক্ষণ যারা আইসে তাদের চা-বিস্কুটের বন্দোবস্ত একটু দেইখ্যা দ্যাও। আমি বিনুর মা'রে চায়ের জল বসাইতে কইয়া দিসি।
-- ব্যস্ত হয়ো না মাসি। ওদিকটা আমি দেখছি।
দ্রুত রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল চাঁপা। এই বয়স্ক মানুষ দু'জনের দেখাশোনা এক প্রকার তারাই করত। যাকে বলে রক্তের সম্পর্ক, সেরকম কিছু তাদের মধ্যে নেই, তবু পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকতে থাকতে কখন যেন এঁদের সুখে-দুঃখে জড়িয়ে গেছে ওরা।
-- কেমন আছেন মাসিমা ? ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বেরিয়ে এসে প্রণাম করল লতাকে।
-- আস বাবা মোহিত, আস, বস।
-- খবরটা শুনলাম। কী হয়েছিল ? যথা সম্ভব কাঁচুমাচু মুখ করে বলল লোকটি।
-- কইত্যাসে তো হার্ট-অ্যাটাক। তা তোমাগো কতদিন থিক্যা ও কইতাসিল বউমারে লইয়া আমাগো বাড়ি আসতে। সেই আইলাই, কিন্তু দেখা পাইলা না।
-- সত্যি, অনেক দিন থেকেই আসব আসব করছিলাম, কিছু হয়ে ওঠেনি।
-- ঠিক আসে, একটুখানি বস। প্রথমবার বাড়ি আইলা, একটু মিষ্টিমুখ কইরো। চাঁপা, ও চাঁপা...
-- না, মাসিমা। আজ থাক। অন্য দিন এসে খাব। বিব্রত মুখে বলল মোহিত।
-- ঠিক আসে। বারো তারিখে কাজ। বউমারে লইয়া আইস কিন্তু। বাবু তোমারে ফোন করব। এখন তো বোঝই, তোমার বাড়ি গিয়া ডাকনের মতো লোকবল আমাগো নাই।
-- না, না মাসিমা, ওসবের দরকার নেই। আমি নিশ্চয়ই আসব।
সময় দ্রুত যেতে লাগল। বডি নিয়ে যেকোনও সময় ওরা চলে আসতে পারে। লতা ভাবলেন, হরিসাধনের দেহটা, উনি দিনের বেলা নীচের যে ঘরটি ব্যবহার করতেন, সেখানকার ছোট খাটটাতেই রাখা ভালো।। ওঁর ব্যবহারের তোষক আর শেষ যে চাদরটা ওটায় পাতা ছিল, ওই দুটোও সঙ্গে দিয়ে দিলে হয়। সেই ব্যবস্থা করতেই উঠলেন তিনি৷ চাঁপাকে দেখে বললেন, 'হ্যাঁ রে, বউমা আর গাব্বু আসে নাই ? '
-- বৌদি তো এসেছে অনেকক্ষণ ! তুমি কারও সাথে কথা বলতে ব্যস্ত ছিলে, তাই ওপরের ঘরে গিয়ে বসেছে।
-- তা গাব্বু আইল না ?
-- ও নাকি টিউশানিতে গেছে। ফিরেই আসবে।
- অ।
হরিসাধনের বসার ঘরটায় এলেন লতা। বড় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিলেন মানুষটা। তাঁর চেয়ার টেবিল এখনও যেন নতুনের মতো ঝকঝক করছে৷ ছোট সেল্ফটায় তাঁর ব্যবহারের ওষুধ, নস্যির ডিবে, সুপুরির কৌটো, কাগজ-কলম-- সব নিপুণ করে সাজানো। বছর কয়েক আগেও অবসর সময়ে মাঝে মাঝে ছবি আঁকতেন তিনি। দীর্ঘদিন ব্যবহার হয় না; তবু তুলি, রঙের প্যাস্টেল, ট্রে সব যেন এখুনি ব্যবহার হবে বলে শিল্পির প্রতীক্ষায় বসে আছে মনে হয়। হরিসাধনের আঁকা দু'টো পেন্টিং মুখোমুখি দু'টি দেয়ালে টাঙানো আছে বহুদিনই। একটা রাজা দুষ্মন্ত- শকুন্তলার, আর একটা বাগানের মাঝে একটি সুন্দর ঘর। এসবের কদর লতা কোনওকালেই করতেন না; সুতরাং তাঁকে দেখিয়ে সময় নষ্ট করার বিলাসিতাও হরিসাধনের কখনও ছিল না। আজ লতা নতুন করে ছবিগুলো দেখলেন। তাঁর মতো এইসবে নিরস লোকও মনে মনে ভাবলেন, বাঃ, আঁকার হাতটা তো ওঁর ভালোই ছিল ! শকুন্তলার পায়ের কাছের হরিণটা যেন এক্ষুনি শিং নাড়িয়ে খেলতে নেমে আসবে তাঁর কাছে। আর ওই বাড়িটা যেন বসত করার আমন্ত্রণ নিয়ে দাড়িয়ে আছে অনন্তকাল ! হঠাৎ একটা জরুরি কথা মনে এল তাঁর। মৃত্যুর আগে হরিসাধন তাঁকে বেশ কয়েকবার জানিয়েছিলেন, তুমি যদি আগে যাও, তাহলে তো কথাই নেই; কিন্তু আমি যদি আগে মরি, তবে আমার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ামাত্রই এই টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে দেখো।
-- ক্যান, গুপ্তধন রাইখ্যা গ্যাছ নাকি ?
-- খুললেই দেখতে পাবে।
-- মুখেই কও না শুনি !
-- না, এসব আগে বলার জিনিস না।
ড্রয়ারের চাবি রাখার জায়গাটাও দেখিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তবে আজ সকাল থেকে নানান কাজের তাড়ায় ভুলে গিয়েছিলেন লতা। ড্রয়ার খুলে দেখলেন, অনেকগুলো বড় বড় খাম। প্রতিটির উপর কিছু না কিছু লেখা -- যেমন, কোনওটার উপর লেখা “উইল”, কোনওটার উপর “ফিক্সড ডিপোজিট”, কোনওটার উপর “এন-এস-সি'। এই রকম, “ব্যাঙ্ক”, “এল-আই.সি, “বাড়ি'-আরও অনেক কিছু। শেষ যে দু'টোয় তাঁর চোখ পড়ল, তার একটার উপর লেখা, “আমার শ্রাদ্ধ', অন্যটায়, 'লতা”। উইলের কথা লতা কমবেশি জানেন। হরিসাধন তাঁর অধিকাংশ অস্থাবর সম্পত্তিই বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে গেছেন। লাল্টুর নামে পাঁচ লাখ টাকা নগদ আর নাতির নামে পাঁচ লাখ টাকা ফিক্সড করে দিয়ে গেছেন তিনি৷ ব্যাঙ্ক এর সুদ, এল.আই.সির মান্থলি ইনকাম স্কিম থেকে প্রতি মাসে দশ হাজার টাকার মতো লতার হাতে আসবে-- যতদিন তিনি বাঁচবেন। তারপরে এই টাকা রামকৃষ্ণ মিশনে দান হিসেবে চলে যাবে৷ ব্যাঙ্ক, এল.আই.সি, এন.এস.সিগুলোর প্রতিটির জন্য আলাদা ফাইল করে তাদের ম্যাচিউরিটির তারিখ, প্রাপ্য টাকা--আলাদা একটা কাগজে ছকে রেখে গেছেন তিনি, যাতে লতা একঝলক দেখেই সব প্রাপ্য গুলো সহজে বুঝে নিতে পারেন৷ বাড়ির খামে বাড়ির দলিল, খাজনার রসিদ সব পরপর সুন্দর করে সাজানো। বাড়িটা পাড়ার ক্লাবকে দিয়ে গিয়েছেন। লতার মৃত্যুর পরে ওখানে একটা লাইব্রেরি করবে ওরা। সংসার চালানো নিয়ে লতা কখনও কিছু ভাবতেন না। হরিসাধন যে এত নিপুণ করে সব বন্দোবস্ত করে গিয়েছেন কখন, তিনি টেরও পাননি। এবার “আমার শ্রাদ্ধ” খামটা খুলে চমকে উঠলেন লতা। তাঁর মৃত্যু হলে কোন শ্মশানে, কিসে করে নিয়ে যাওয়া হবে তাঁকে- এসব আগেও কথাচ্ছলে লতা আর লাল্টুকে বলে গিয়েছিলেন তিনি। এখানে সেসবের সাথে কাকে কাকে নেমন্তন্ন করতে হবে-- তাদের নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বরের তালিকাও পাওয়া গেল। নেমন্তন্নে কী কী মেনু হবে, কোন ক্যাটারারকে বলতে হবে-- এসব খরচাপাতির জন্য টাকার বন্দোবস্ত, সব খুঁটিনাটি লেখা আছে এতে। ওই খামে একশো টাকার পঞ্চাশখানা নোটও রেখে গেছেন তিনি মৃত্যুর পর আনুষঙ্গিক খরচখরচা বাবদ। সঙ্গে স্পষ্ট নির্দেশ, তাঁর দাহ ও পারলৌকিক ক্রিয়া সংক্রান্ত কোনও কাজে যেন বাবুর বা অন্য কারুর টাকা না নেওয়া হয় এবং মুখাগ্নি যেন লাল্টু করে৷ বুড়োর কী ভীমরতি ধরেছিল মরণকালে ? সব মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু বাবু থাকতে লাল্টু মুখাগ্নি করবে ? লোকেই বা বলবে কী আর তিনিই বা কোনমুখে একথা বাবুকে বলবেন ! এতবড় কী অপরাধ করেছে বাবু ?
বাবু তাঁদের একমাত্র সন্তান৷ সরকারি ইঞ্জিনীয়ার। বউমাও ইঞ্জিনীয়ার, তবে বেসরকারি চাকরি তার। ওরা সহপাঠী ছিল। প্রেমের বিয়ে। ওঁদের কোনও আপত্তি ছিল না। ওদের বিয়ের আগেও সংসার যেমন চলছিল, বিয়ের পরও তেমনি চলতে লাগল। শুধু লতার রুটিনটা একটু বেশি ভারি হয়ে গেল। আগে বাবুর জন্য ন’টায় ভাত দিলেই হত; বউমা আসাতে চা-জলখাবার, অফিসের টিফিনের সাথে সাথে বউমার জন্য আটটায় ভাত করে দিতে হল। বিকেলে ওঁদের একদফা চা করলেই চলে যেত, ইদানীং ওদের অফিস-ফেরৎ চা দেবার বাড়তি দায়িত্ব ঘাড়ে এল। ঘোড়া না থাকলে কষ্ট হলেও দূরের রাস্তা দিব্যি হেঁটে যাওয়া যায়, তবে কিনা প্রত্যাশা থাকলে কষ্ট পাওয়া অবধারিত। আর বাড়িতে বউমা থাকলে শাশুড়ির ন্যূনতম প্রত্যাশা হবে না, তাও বা কী করে হয়! রান্নাবান্না নাই করুক, একটু কেটে-বেটে দিলেও প্রবোধ পাওয়া যেত মনে। সেটুকুও শরীরে না দেয় যদি, রান্নার সময়ে একটু রান্নাঘরে এসে দাঁড়ালেও নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জায়গা পেতেন লতা। অফিসের দিনগুলোর সাথে ছুটির দিনগুলোতেও যখন একই রুটিন চলতে লাগল দিনের পর দিন, ক্ষোভ আর পোষ মানল না তাঁর। রাতে একদিন মুখভার করে এলেন শুতে। হরিসাধনের সাথে লতার যতটুকু কথা হতো, তা এই রাতে শোওয়ার সময়েই। মশারি গুঁজতে গুঁজতে তিনি লতার মুখ থেকে শুনে নিতেন পরের দিনের বাজারের ফর্দ। মর্নিংওয়াক শেষ করে বাজার নিয়ে ফিরতেন তিনি। এসেই তাঁর দাবার আসর বসত। লতা থাকতেন রান্নাঘরে। দুপুরে খেতে বসে দু-চার কথার বিনিময়। এরপর লতা দিবানিদ্রা আর টিভি শেষ করে পাড়া-পড়শির তত্ত্ব নিতে বেরোতেন আর হরিসাধন নীচের বসবার ঘরটায় তাঁর সাম্রাজ্য খুলে বসতেন। বউ-এর মুখভার দেখে তাঁর অস্বাভাবিক প্রতিক্রয়া হল, ‘কী ব্যাপার, বউমার সাথে লাগল নাকি ?’
-- ক্যান, চোখ-কান তো খোলাই রাখস, কিছু দেখতে শুনতে পাও না ?
-- কিছু হলে তো চোখ-কান ব্যবহারের প্রশ্ন ! কই, ঝগড়াঝাঁটির আওয়াজ পাইনি তো !
-- ঝগড়াঝাঁটি হইলে না হয় বুঝতাম। আমি তো দাসি-বাঁদি ! আমি কি আর ওসবের জুগ্যি ? ফাইফরমাস খাটলেই হইল।
হরিসাধন সাধারণত বউ-এর কথা এক কান দিয়ে শুনে দ্বিতীয়টি পর্যন্তও নিতেন না, ওই কান দিয়েই বের করে দিতেন। সেদিন কথাটা শুনলেন এবং মাথাতেও গেঁথে নিলেন। দিন দুই পরে রোববার সকালে ছেলেকে ডেকে পাঠালেন, ‘বাবু, বোস একটু, কথা আছে।‘
-- কী হল বাবা ?
-- শোন, আমি খবর নিয়েছি, আমাদের পুর্ণেন্দুর বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাট হয়েছে। ওই চৌমাথা থেকে একটু ভেতরে। একদম রেডি ফ্ল্যাট। তোরা এই মাসেই শিফট করে নে।
-- কেন, হঠাৎ কী হল ?
-- দ্যাখ, এতদিন আমরা আমাদের মতো চলেছি। এভাবে বাকি দিনগুলোও কাটাতে চাই। তোদের জীবন সবে শুরু, আমাদের ছায়ার চাপে তোরা থাকবি কেন ? তাছাড়া প্রতিটি সম্পর্ক দূরত্ব পেলেই ঠিকঠাক বেড়ে ওঠে। আর পূর্ণেন্দুর ফ্ল্যাট তো বেশি দুরেও না। চাইলেই যখন খুশি যাওয়া আসা করা যায়।
-- তোমরা কী রিমার সাথে মানিয়ে নিতে পারছ না ?
নিরীহ একটা কথা। কিন্তু মানিয়ে নেওয়ার কর্তা হওয়ার দায়টা হজম হল না তাঁর। অন্য সময় এসব কথায় তিনি হয়ত চুপ করে যেতেন, বা এসব কোন্দলের মধ্যে যেতেনই না। কিন্তু আজ তাঁকে ভীষণ ভাবে লতার পক্ষ পেয়েছে। বললেন, ‘ধরো তাই। এ মাসেই চলে যেও তোমরা।‘
-- কিন্তু এখন...
-- ও নিয়ে ভাবতে হবে না তোমায়। পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে ওটা আমি বুক করে দিয়েছি। বাকি আট লাখ টাকা তুমি হাউস বিল্ডিং লোন নিয়ে শোধ দিয়ে দিও। আর এই ফ্ল্যাট তোমার পছন্দ না হলে অন্যত্র অবশ্যই দেখতে পারো।
প্রথম প্রথম সাত-দশ দিনে দেখা-সাক্ষাৎ হত। পরের দিকে মাসে দু'মাসে ফোন। শেষ দিকে বিজয়া, নববর্ষ ছাড়া আর টেলিফোনও আসত না। হরিসাধন অবশ্য কর্তব্যে কোনও ত্রুটি রাখেননি। নাতির জন্মের সময় নার্সিংহোমে রাত কাটিয়েছেন। নাতির মুখ দেখে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটি এককালীন শিক্ষা-বিমা করিয়ে দিয়েছেন। ও যখন কুড়ি বছরের হবে, উচ্চশিক্ষা করার জন্য অনেক টাকা পাবে। লতা নাতির টানে মাঝে মাঝেই ছেলের ওখানে হানা দিয়েছেন যদিও, তিনি নিজে বিশেষ যাননি। অবশ্য লতাকে যেতে বাধাও দেননি। নাতি হওয়ার পরে পরেই ছেলে-বউমা লতাকে খুব করে ধরেছিল একসাথে থাকতে, হরিসাধন রাজি হননি। লতা রাগ করে বলেছিলেন, তুমি কি পাষণ্ড ? পুরোনো কথা নিয়া এখনও প্যাচাল পাড়ো। নাতিটারে দেইখ্যা মায়া হয় না ?
-- তোমার বয়স হচ্ছে লতা। ওরা দু'জন চাকরিতে বেরিয়ে গেলে তুমি সামলাতে পারবে ? ঝক্কি নিতে পারবে সব ? সময় মতো স্কুলে নিয়ে যাওয়া-আসা করতে পারবে ?
-- হ। পারব।
-- তাহলে ওদের ওখানে গিয়েই থাকো। আমি বারণ করব না।
হরিসাধন খুব দৃঢ়চেতা ও আত্মাভিমানী ছিলেন। লতা বুঝেই গিয়েছিলেন, এই চিড়ে কোনও দিনই ভিজবে না। কথায় বলে, আপন থেকে পর ভালো, পরের থেকে জঙ্গল ভালো। আপাতত জঙ্গলে যাওয়া যখন কপালে নেই, তবে লাল্টুই শেষ ভরসা। কাজে-অকাজে লাল্টুর উপরেই অপত্য স্নেহ বর্ষে দিলেন তাঁরা৷ তাই বলে লাল্টু মুখে আগুন দেবে ? না, এ ইচ্ছা লতা কিছুতেই পূরণ হতে দিতে পারেন না।
-- মা, বাবার বডি এসে গেছে। এ ঘরেই আনতে বলি তাহলে ? বাবু কখন ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে।
লতা তাড়াতাড়ি ড্রয়ার বন্ধ করতে করতে বললেন, ‘হ। আর বাবা, পুরুতমশায়ের সাথে একটু পরামর্শ কইরো, কী করতে হইব না হইব। মনে হয় দ্বিপাদ দোষ পাইসে।
-- সে হবে না হয়। আপাতত খাটটা রেডি করো।
-- শোন, পেনেটির ঘাটেই লইয়া যাইস কিন্তু ! তর বাবার ইচ্ছা ছিল তাই। আর লাল্টুরে সকালে কইয়া দিসিলাম স্বর্গরথ আনতে। আনসে ?
-- আমি ঠিক জানি না। তবে ম্যাটাডোরে গেলেই তো ভালো। সবাই সঙ্গে থাকবে।
-- না রে। অর ইচ্ছা ছিল স্বর্গরথেই যাওনের। কইত, “মায়া যখন ছাইড়াই যাইতাসি, তখন অইটুকুই বা সবার সাথে যামু ক্যান? একা আইসি, একাই যাইতে চাই।”
সব ব্যবস্থাই মোটামুটি করে ফেলেছে লাল্টু। ওর হাতে পয়সা ছড়ানোর জন্য খুচরো পয়সার একটা পুঁটলি ধরিয়ে দিলেন লতা। এই নিয়ে যদিও হরিসাধনের কোনও নির্দেশ নেই, তবু নিজের বুদ্ধিতে এটুকু করলেন তিনি৷ চাঁপাকে ডেকে বললেন, লাল্টুরে আলতাটা দ্যাও তো মা, পায়ের ছাপটা তুইল্যা রাখুক।
-- এসব আবার কেন মা ? সব প্রিমিটিভ ব্যাপার। বিড়বিড় করে উঠল বাবু। বলল, ‘এসব রেখে কী করবে ? অযথা তোমার মনের উপর চাপ পড়বে।‘
-- তা কইলে কী কইরা হইব বাবা ! অর তৈরি বাড়ি, সেইখানে অর একটা পায়ের চিহ্ণটুকু থাকব না !
লাল্টু যত্ন করে পায়ের ছাপটুকু নিল। সঙ্গে সঙ্গেই একজনকে দিয়ে পাঠিয়ে দিল বাঁধাই এর দোকানে। ফটোগ্রাফার এসেছে। বিলাপের ফাঁকে ফাঁকে পোজ দিয়ে ফটো তুলল সবাই। টিউশন শেষ করে নাতি ফিরেছে। ঠাকুর্দার সাথে ওর ছবিও তোলা হল। অবিকল হরিসাধনের মুখটা যেন কেটে বসানো। লতা ইতস্তত করতে লাগলেন। চাঁপা আর বউমাকে আলগোছে বললেনও কথাটা। কিন্তু এখনকার মেয়ে। শাঁখা ভাঙা কিংবা সিঁদুর মোছার মতো অমানবিক কাজ করতে এগিয়ে এল না কেউই। অগত্যা তিনি নিজেই নিজের শাঁখা ভাঙলেন। হরিসাধনের পায়ের কাছে বসে তাঁর পায়ের বুড়ো আঙুলটা দিয়ে ঘষে দিলেন কপালের সিঁদুর। ডুকরে কেঁদে উঠলেন, ‘আমি তোমার আগে গ্যালাম না ক্যান !’ কেউ উত্তর দিল না। স্বর্গরথে হরিসাধনের দেহটাকে শুইয়ে দেওয়া হল।
-- বাবা লাল্টু, সব জিনিসপত্র ঠিকমতো আইসে তো ?
-- আপনি একদম চিন্তা করবেন না৷ অসীমদা এসব ব্যাপারে একদম চোস্ত লোক। ওকে দিয়ে দশকর্মার সব বাজার করিয়ে রেখেছি আমি।
লতা উঠে গিয়ে হরিসাধনের ড্রয়ার থেকে তিরিশটা একশো টাকার নোট এনে বাবুকে দিলেন, ‘বাবা, শ্মশান বন্ধুদের মিষ্টি খাওয়াইও। আর যা যা খরচখরচা এইখান থিকাই কইরো।‘
-- এটা রাখো। আমি টাকা নিয়েই এসেছি। আপাতত ওতেই হয়ে যাবে।
-- না বাবা। এটা তার ইচ্ছা। তার টাকাতেই যেন তার শেষ কাজ হয় । তুমি দেইখ্যো, অন্য কেউ যেন এক পয়সাও খরচা না করে।
দেহ নিয়ে সবাই বেরিয়ে যেতেই লতা আবার এসে বসলেন হরিসাধনের ঘরে। “লতা” লেখা খামটি এখনও দেখা হয়নি তাঁর। অধীর আগ্রহে ছিঁড়ে ফেললেন খামটি। ভেতরে আর একটি খাম, উপরে লেখা, “আমার শ্রাদ্ধ হলে পড়ো”। তর সইল না তাঁর। এটিও খুলে ফেললেন তিনি। তাঁর উদ্দেশেই লেখা চিঠি। “লতা, জানি কৌতূহল দমন করতে পারবে না তুমি। তোমাদের এই এক দোষ ! ভালোই হল। আগে থেকে মনটাকে বাঁধার সময় পাবে তুমি। আমি জানি, মাছ ছাড়া ভাত তুমি খেতে পারো না। কারোর কোনও প্ররোচনাতেই নিরামিষ খেও না যেন। এমনিতে বাতের ব্যথা, দুধ খাও না, মাছ না খেলে চলবে কেন ? আমি তো চললাম। এইবার বুঝবে কত ধানে কত চাল! এবার থেকে একটু সমঝে বুঝে চলো। সারা জীবনে সংসারের কিছুই তো বুঝতে চাইতে না তুমি ! সারা জীবন মাথা উঁচু করে বেঁচেছ। আজ আর কারোর হাত তোলা হতে যেও না যেন ! অবশ্য আমি উপরে গিয়ে তদ্বির চালাব, যাতে যত তাড়াতাড়ি তোমাকেও নিয়ে যেতে পারি আমার কাছে।” এটা কি রোমান্টিক চিঠি ? যদি রোমান্টিক কিছু হয়ও, ব্যস এইটুকুই। বাকি সব কাজের হিসেব। শ্রাদ্ধের পরের দিন থেকে লতার দায়িত্ব নেবে এখানকার একটি বৃদ্ধাশ্রম। না, ওদের ওখানে গিয়ে থাকতে হবে না তাঁকে। বাড়িতেই চার বেলা খাবার পাঠাবে তারা৷ রোজ দু’বেলা দু'জন আয়া এসে থাকবে। একবার করে ডাক্তার আসবে রোজ চেক আপ করতে। বড় কিছু হলে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া ও তার খরচাপাতি তাদের। এজন্য হরিসাধন আট লক্ষ টাকা দিয়ে ওদের সাথে এগ্রিমেন্ট করে গিয়েছেন। তার দলিলটাও সঙ্গে আছে৷ লতা অত ইংরেজি বুঝবেন না বলে সরল বাংলায়ও মর্মার্থ করে দিয়েছেন তিনি৷ কোনও আপৎকালীন সমস্যার জন্য লতার নামে দশ লক্ষ টাকা তার অ্যাকাউন্টে রাখা আছে৷ লতা মৃত্যুর পরে এই টাকা যাকে খুশি দিতে পারেন। নাতিকে, বাবুকে বা যাকে খুশি। নাতির বিয়ে পর্যন্ত যদি তিনি বাঁচেন, তবে নাত-বৌকে আশীর্বাদ করার জন্য একটি সোনার বালাও গড়িয়ে রেখে গিয়েছেন তিনি৷ আলমারির লকারে। লতা চাইলে, আগে ভাগেও ছেলে বউমাকে এটি দিয়ে যেতে পারেন। সর্বোপরি, বৃদ্ধাশ্রম যদি ঠিক মতো পরিষেবা না দেয়, তবে বিকল্প বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানাও রেখে গিয়েছেন তিনি৷ তবে উকিলবাবুর সাথে এর জন্য পরামর্শ করার দরকার। উকিলবাবুর নাম-ঠিকানাও দেওয়া আছে সাথে। একদম শেষে, লতার মৃত্যু হলে শ্রাদ্ধ-শান্তির জন্য টাকার বন্দোবস্তও করে গেছেন তিনি।
ভেতর থেকে কান্না বেরিয়ে এল লতার। কী অন্যায় করেছেন তিনি! যে লোকটার এতখানি আত্মসম্মানবোধ, যিনি সারা জীবন অন্যের থেকে এক পয়সাও ধার নেননি, যিনি কোনও দিন কারোর কাছে মাথা নোয়াননি - আজ নিছক এক দুর্বলতার শিকার হয়ে সেই মানুষটার শেষ ইচ্ছাটাকে মর্যাদা দিলেন না তিনি ! কী করে এর প্রায়শ্চিত্ত করবেন ? দু'হাতে বুক চাপড়াতে লাগলেন লতা। স্বামীর মৃত্যুর পর, এই প্রথম বার তাঁর মনে হল, মাথার উপর আজ আর কোনও ছাদ নেই। চারপাশটা বড় শূন্য মনে হল তাঁর।
🍂
0 Comments