জ্বলদর্চি

রঘুনাথ মাইতি (আয়ুর্বেদাচার্য, ভগবানপুর) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১০৬
রঘুনাথ মাইতি (আয়ুর্বেদাচার্য, ভগবানপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমার ভগবানপুরের (পরবর্তীতে ভূপতিনগর) মাণিকজোড় গ্রামে ১৯০২ সালের ১৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন আয়ুর্বেদাচার্য রঘুনাথ মাইতি। বাবা রামমোহন মাইতি এবং মা সুশীলা দেবী। রঘুনাথ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও ছাত্রবৃত্তি প্রাপ্ত। নিম্নবিত্ত পরিবারের রঘুনাথ প্রাথমিক ও বুনিয়াদী পরীক্ষায় স্কলারশিপের পাশাপাশি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষাতেও স্কলারশিপ পান। হরিপুর ও মুগবেড়িয়ার পরে কাঁথি হাইস্কুল থেকে বর্ধমান বিভাগে প্রথম স্থান দখল করে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। রঘুনাথের পিতা ছিলেন অত্যন্ত সহজ সরল ও সাধাসিধে জীবনে বিশ্বাসী। 

এরপর ১৯২১ সালে বঙ্গবাসী কলেজে আই এস সি পড়াকালীন মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে আয়ুর্বেদ ছাত্র হিসাবে তিনি কলকাতার শ্যামাদাস বাচস্পতির বৈদ্যশাস্ত্রপীঠে পড়াশোনা করেন। লাভ করেন 'বৈদ্যশাস্ত্রী' উপাধি। সেই সময় সংস্কৃত শিক্ষার প্রয়োজনে বিভিন্ন টোলেও পড়াশোনা করেন। সংস্কৃতের নানা শাখায় পাশ করে 'কাব্যতীর্থ' উপাধি লাভ করেন। 

ছাত্রাবস্থাতেই বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসেন রঘুনাথ। তিনি স্বামী সারদানন্দের কাছে দীক্ষা নেন। রামকৃষ্ণ মিশনের তৎকালীন সন্ন্যাসী স্বামী ভূতেষানন্দ, স্বামী জগদীশ্বরানন্দ সহ অনেক মহারাজদের সঙ্গে তাঁর সক্রিয় যোগাযোগ ছিল। রঘুনাথ মাইতি বিয়ে করেননি। সারাজীবন অকৃতদার হয়ে সন্নাসীসুলভ জীবনযাপনে অভ্যস্থ ছিলেন। 

কলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে কাঁথিতে এসে এখানকার জাতীয় বিদ্যালয়ে অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেন। সেইসাথে কবিরাজী ঔষধ দোকান খুলে কর্মজীবনের সূচনা করেন। আসলে তিনি নিজের খরচ জোগাড় করতে এই পন্থা অবলম্বন করেন। সেখানে তিনি নিজের হাতে উন্নতমানের কবিরাজী ঔষধপত্র তৈরি করে রোগীদের দিতেন। ১৯৩০ সালে কাঁথির এই জাতীয় বিদ্যালয় এলাকার স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়। ফলে রোষানলে পড়তে হয়। ব্রিটিশ্রিটিশ পুলিশের আক্রমণে জাতীয় বিদ্যালয়ের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে হয়। সেইসাথে রঘুনাথ মাইতির আয়ুর্বেদ শুশ্রুষাকেন্দ্র ধ্বংস করে দেয় বৃটিশ সরকার।

লবণ সত্যাগ্রহের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকায় ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তার করে তাঁকে। মেদিনীপুর জেলে আটক করে রাখা হয়। অবশেষে গান্ধী আরউইন চুক্তিতে ছাড়া পেলেও পরে ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলনে পুনরায় ১৯৩২-এ গ্রেপ্তার হন। তবে এবারে হিজলী ক্যাম্পের জেলে আটক রাখা হয়। সেখানে লাগাতর পুলিশী উৎপীড়নে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গিয়ে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী অবস্থায় কাটাতে হয় তাঁকে। গুরুতর শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে তিনি ১৯৩০ সালে মুক্তি পান। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে কলকাতায় গিয়ে কবিরাজী ঔষধের ব্যবসা শুরু করেন। আসলে সেইসময় নানা ঝড় ঝাপটা ও সামাজিক কর্মকান্ডে তাঁর মাথায় তখন বিপুল ঋণের বোঝা চেপে বসে। সেই ঋণ পরিশোধ করতে তিনি কলকাতায় ঘরভাড়া নিয়ে ফের কবিরাজী পেশা শুরু করেন। কিন্তু লাগাতর কঠিন পরিশ্রম ও অত্যাধিক চিন্তা করার ফলে তিনি উচ্চ রক্তচাপ জনিত অসুখে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পক্ষাঘাতে তার শরীরের বাঁ দিকটা পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। সেই অবস্থায় তিনি কাঁথি চলে আসেন। কাঁথি ফিরে এসে দেশবাসীকে আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মাধ্যমে জনগনকে সেবাদানে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত করেন।

১৯৪২ এর ভারতছাড়ো আন্দোলন পর্বে উনপঞ্চাশের প্রবল সাইক্লোনে বিধ্বস্ত হয় কাঁথি। চারিদিকে হাহাকার। তখন তিনি পঙ্গু অবস্থাতেই ত্রাণসামগ্রী নিয়ে পৌঁছে যান দুর্গত এলাকায়। এক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা স্মরণযোগ্য। সাহিত্য কর্মেও উদ্যোগী ছিলেন। আয়ুর্বেদ চিকিৎসা বিষয়ক আয়ুর্বেদের পুনরুত্থান, আয়ুর্বেদের নানা সমস্যা ও তার প্রতিকার, রোগ চিকিৎসায় আয়ুর্বেদ (৪ খণ্ড), আয়ুর্বেদ প্রদর্শিকা ছাড়াও অনেক কবিতা ও গান, গান্ধীজীর স্বদেশী, জাতির জনক গান্ধীজী ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। এছাড়া তাঁর লেখা কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা নামে একটি বই খুব জনপ্রিয় ছিল।
 
কাঁথি আয়ুর্বেদ কলেজ গঠন তাঁর জীবনের অন্যতম কাজ। তিনি কাঁথি কলেজের পশ্চিমে বৈদ্যক পাঠশালা স্থাপন করেন। যা পরবর্তীকালে কাঁথি আয়ুর্বেদ মহাবিদ্যালয় ও হাসপাতাল নামে পরিচিতি পেয়েছে। কলকাতার বাইরে ফ্যাকাল্টি অনুমোদিত এটিই একমাত্র আয়ুর্বেদ কলেজ। এখানে আমৃত্যু প্রতিদিন তিনি দু'ঘন্টা ধরে বিনামূল্যে রোগী দেখতেন এবং নানা রকম ঔষধ দিতেন। গান্ধীবাদী এই মানুষটির কর্মকাণ্ড দেখতে এসে রতনমণি চট্টোপাধ্যায়, মন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন প্রমুখ অনেকেই এই কলেজে অবস্থান করেছেন। 

স্বাধীনত্তোর যুগে সারা পশ্চিমবাংলায় কেবলমাত্র সরকারি দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া একমাত্র কাঁথির এই আয়ুর্বেদ পাঠশালাতেই আয়ুর্বেদের ডিপ্লোমা কোর্স পড়ানো হত। এখানে বহিরাগত কবিরাজি ছাত্র তথা হবু চিকিৎসক এবং অধ্যাপকদেরও আশ্রয়স্থল ছিল। বহু স্বনামধন্য কবিরাজ এই বৈদ্যক পাঠশালা থেকে পাশ করে সরকারী ও বেসরকারী ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চিকিৎসক হয়েছে। মেদিনীপুরের এই মহান মানুষ রতনটির জীবনাবসান ঘটে ১৯৭৪ এর ২৬ নভেম্বর।

🍂

Post a Comment

0 Comments