জ্বলদর্চি

ইস্কুল ফিস্কুল -১/ সৌমেন রায়

ইস্কুল ফিস্কুল 

সৌমেন রায় 

মুখবন্ধ

শিক্ষক নয়, সমগ্র স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থাই কোন একটি জাতির মেরুদন্ড। কারণ স্কুল শিক্ষা শুধুমাত্র বিষয়গত জ্ঞান সরবরাহ করে উচ্চ শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করে না। সেই সঙ্গে  সহমর্মিতা,সমানুভূতি মূল্যবোধ গড়ে তোলে, সামাজিকতা শেখায়, আত্মবিশ্বাসী করে, আত্মমর্যাদা বোধ গড়ে দেয়, প্রকৃতির শুশ্রুষা করতে শেখায়। এইসব গুনই তাদের ভবিষ্যতের সুনাগরিক করে তোলে। পশ্চিমবঙ্গে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী পড়ে সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলে। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের মেরুদন্ড যদি বলতে হয় তাহলে তা হল বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়। কেমন চলছে এই বিদ্যালয়গুলি? ঝকঝকে পরিকাঠামোর অন্তরালের খবর কি?  গভীরে গিয়ে সেসব অনুসন্ধান করাই এই লেখাগুলির উদ্দেশ্য। কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে আক্রমণ করা, অসম্মান করা কোন ভাবেই এই লেখাগুলির অভিপ্রায় নয়।

লেখাগুলিকে বোধহয় ‘কথকতা মূলক প্রবন্ধ’ বলা উচিত। প্রথম তিনটি লেখা আশি দশকের স্কুল নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক লেখা। পরের লেখাগুলি বর্তমান অবস্থার বিশ্লেষণ। লেখাতে সচেতন ভাবে আগের সময় ও এখনের সময়ের মধ্যে তুলনা করা হয়নি। কারণ দুটি ভিন্ন সময়ের উপাদান ভিন্ন, চাহিদা ভিন্ন। তাই তাদের মধ্যে লিখিত তুলনা করা অনুচিত। পাঠক চাইলে মনে মনে সে তুলনা করতে পারেন ।সেই কারণে প্রথম তিনটি লেখায় অতীতের কিছু তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে গল্পের ছলে। শেষের দিকে অন্ধকারের মধ্যে আলোক বর্তিকা সন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে। বেঁচে বর্তে থাকতে গেলে যা করতেই হয়। লেখার মধ্যে যে ঘটনাবলীর উল্লেখ আছে সেগুলি সম্পূর্ণ সত্য। কোথাও কোনো অতিরঞ্জন নেই। তবে বিড়ম্বনাএড়াতে স্থান, কাল পাত্র কখনো উহ্য আছে, কখনো বা পরিবর্তনকরে দেওয়া হয়েছে।

জানি এ লেখার ক্ষমতা নেই কোথাও কোন তিল মাত্র পরিবর্তন করার। সর্বজনীন শিক্ষা এখন এতটাই গুরুত্বহীন যে কেউ হয়ত এ লেখা পড়েই দেখবেন না। তাহলে লিখছি কেন?  আসলে লেখকও এই ব্যবস্থারই অংশ। বহমান পরিবর্তনের সাক্ষী। তাই এইগুলোকে লেখা না বলে আত্ম সমালোচনা বলতে পারেন বা আর্তনাদও বলতেপারেন!

আশি দশকের স্কুলবেলা 

(পর্ব – ১)

ধনী-দরিদ্র, নির্বোধ-বুদ্ধিমান নির্বিশেষে স্কুলবেলা সকলের কাছেই আনন্দদায়ক। তবে অর্বাচীন ব্যক্তি রসে স্মৃতি কন্ডুয়নের সুযোগ পাওয়া অভাবনীয়। স্মৃতির মাধ্যমে এক কিশোরের চোখে দেখা কালকে তুলে ধরতে গিয়ে আনন্দে দু-এক ফোঁটা নাল ঝরে পড়তেও পারে। ক্ষমা করে দেবেন। স্কুলটি উপলব্ধি করতে হলে গ্রামটি সম্পর্কে দু-চার কথা জানা দরকার। পশ্চিম মেদিনীপুরের অন্তর্গত গ্রামটির নাম রসকুণ্ডু। ছোট বেলাতেই প্রথম সে গ্রাম থেকে একটি বাস সদর শহরে যাওয়া আসা শুরু করল, তার আগে কাঁচা রাস্তা আর গরুর গাড়ি ছিল ভরসা। এছাড়া বিদ্যুৎহীন গ্রামে যন্ত্র সভ্যতার একমাত্র প্রতীক ছিল একটি ধান ভাঙানোর কল। একক যন্ত্রের আওয়াজ বলেই হয়তো যান্ত্রিক মনে হতো না, দূরাগত কুবো পাখির ডাকের মতই সেটিকে মধুর লাগত। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার এমন একটি গ্রামে প্রায় একশত বছরের পুরানো( ১৮৯৩) একটি বিদ্যালয় ছিল। আরছিল একটি শিব মন্দির। গ্রাম্য জীবন সেই বিদ্যালয় আর মন্দিরকে ঘিরে আবর্তিত হত।

দুয়ারে স্কুল- সহজ পাঠের সময় কালে জীবন ছিল খুব সহজ। মন তখনও আবিল হয়নি। তাই কোনো অপ্রাপ্তি আনন্দদ্বার রুদ্ধ করতে পারেনি। আমাদের বিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি ছিল আক্ষরিক অর্থে দুয়ারে স্কুল। মানে দুটি ঘরে ক্লাস হত তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির আর তার সামনে দুয়ারে ক্লাস হত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর। মাটিতে চট পেতে পড়তে অসুবিধা হয়নি। বরং জীবজন্তুর ছবি সম্বলিত আমার জলের বোতলটি ছিল বিসদৃশ। কারণ সেটি ছিল স্কুলের একমাত্র জলের বোতল, বাকিরা জল খেত ব্যক্তি মালিকানাধীন কুয়া বা ইদারা থেকে তুলে। ইদারায় ছিল ব্যাঙের বসবাস। মাঝে মাঝে বালতিতে উঠে আসতো। আশ্চর্যের ব্যাপার স্কুলের নিজস্ব জলের ব্যবস্থা ছিল না।বালতিতে ব্যাঙ তুলতে পারাটা এত আনন্দের ছিল যে বোতলের ব্যবস্থাটা  বেশিদিন টেকেনি। 'আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে' পড়াতে পড়াতে অরুণ মাস্টার বললেন শুকদেবের নিজের বাড়ি এমনই এক নদীর ধারে। সেদিন থেকে শুকদেবকে আমরা সব ভাগ্যবান বলে মনে করতাম। অরুণ মাস্টারমশাই আমাদের মনটি অধিকার করে নিয়েছিলেন কখনো ফুটবল খেলিয়ে, কখনো অমল ও দইওয়ালা অভিনয় করিয়ে, কখনো বীরসিংহ বেড়াতে নিয়ে গিয়ে। বিশ্বম্ভর বাবুর গল্প, আব্দুল মাঝির গল্প, শিবাজীর গল্প, মহেঞ্জোদারোর কথা এসব পড়তে বেশ লাগতো।আব্দুল মাঝি সারা জীবন ধরেই ঘুরে ফিরে এসেছে কখনো গোফুর মিয়া হয়ে কখনো বা মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী হয়ে। গ্রীষ্মকালীন সকাল স্কুলের ব্যবস্থা ওই দুয়ারেরই উল্টো দিকে নিম গাছের নিচে। সেখানে না ছিল দুয়ার, না ছিল মাথার উপর ছাউনি। পাশেই ছোট্ট ডোবা,জলজ আগাছায় ভর্তি। নিমগাছে নিত্য পাখির আনাগোনা। টুপটুপ করে নিমফুল ঝরে পড়ত বই খাতায়। অদূরে শ্যাওড়া গাছের গা ছমছমে আহ্বান মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করত। আমাদের যখন ক্লাস ফোর তখন ক্লাসের মধ্যে তৈরি হল দেওয়ালবোর্ড। রাজমিস্ত্রিকে ইট বয়ে দিয়ে সাহায্য করেছিলাম সবাই। শিশুশ্রম বলে কোন পক্ষ থেকে আপত্তি ওঠেনি। সেই বোর্ড তৈরি হওয়ার পর আমরা লিখতে চাইলাম। কিন্তু মাস্টারমশাইরা বললেন নতুন বছর থেকে সেটি ব্যবহার হবে। ওইটুকু বয়সেই বিদ্রোহের বাতাস আমাদের মনে কিভাবে লাগল জানিনা। আমরা পুরানো বোর্ডের দিকে পিছন ফিরে নূতন বোর্ডের দিকে বসলাম। অনেক টাল বাহানার পর আমাদের দাবি পূরণ হল। ফোরে তখন ছিল সরকারি বৃত্তি পরীক্ষা। সে পরীক্ষার জন্য শিক্ষক মহাশয়রা বিনা পয়সায় কোচিং করিয়েছেন। সেই রকমই এক ক্লাসে ফেব্রুয়ারি বানান বলতে না পারায় বেতের বাড়ি খেয়েছি। তবে সে প্রহারেরসঙ্গে এতখানি স্নেহের পরশ যুক্ত ছিল যে তা পিঠ থেকে মনে প্রবেশ করেনি।

তখনো মিড ডে মিল চালু হয়নি। টিফিনে আমাদের পাউরুটি দেওয়া হতো। ঝড়-বৃষ্টির দিনে আমরা স্কুল যাবই যাব। কারণ সেদিন ভাগে  রুটি বেশি পাওয়া যেত। প্রার্থনার সময় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা গুনে নেওয়া হত। একবার আমার দায়িত্ব পড়েছিল গোনার। ছেলেদের সারি গুনলাম। মাস্টারমশাই বললেন নিজেকে ধরেছিস? যা ! নিজেকে ধরা হয়নি তো। আবার এক যোগ করে বললাম। তারপর মেয়েদের সারি, এবার কিন্তু আর ভুল করিনি। নিজেকে যোগ করে বললাম। সবার সে কি হাসি!

বড় স্কুল - তারপরে এলাম বড় স্কুলে। সেখানে একটি পাকা বিল্ডিং থাকলেও সে ছিল উঁচু ক্লাসের সৌভাগ্যবানদের জন্য।আমাদের ক্লাস হতো মাটির ঘরে। তার কিছু সুবিধাও ছিল। ভাঙ্গা জানলা দিয়ে ঢুকে ভালো জায়গা বেছে নেওয়া যেত স্কুল খোলার আগেই। তাছাড়া টিনের চালে যখন ধারাপাত হত তখন শিক্ষকও পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হতেন, তার মজাই আলাদা।ক্লাসঘরগুলি অফিস থেকে খানিকটা দূরে হওয়ায় দুটি ক্লাসের মাঝে আমরা বেশ ফাঁকা পেতাম। আর শিক্ষকদের রক্ত চক্ষু থেকে একটু দূরেও থাকা যেত।

তখন স্কুলে অনুষ্ঠান বলতে রবীন্দ্রজয়ন্তী, স্বাধীনতা দিবস আর বার্ষিক ক্রীড়া। রবীন্দ্রজয়ন্তীর সময় ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে‘ কিম্বা ‘ভাঙ ভাঙ কারা আঘাতে আঘাত কর’ শুনে কিছু বুঝতাম বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু কথাগুলো যে মনের গভীরে কোথায় গিয়ে বাজত  জানিনা, একটা ঢেউ উঠত মনের মধ্যে। আজ জীবনের অপরাহ্নে সে সব শুনলে সে লহরি এখনও অনুভব করা যায়। ভরতবাবু একবার বুঝিয়ে দিলেন 'আজি ভারতের মহামানবের সাগরতীরে' তালটা হবে 'গিজজা গিজোর গিজাজা গিজর গিজড় গিজরতাং'। কবিতা হারিয়ে গেলো, মুখে মুখে ফিরতে লাগলো শুধু তাল টুকুই। ভরতবাবু মেরুদন্ড সোজা রেখে বসতেন বা হাঁটতেন। পরবর্তীকালে যতবার মেরুদন্ড বাঁকাতে হয়েছে ততবার ভরতবাবুর কথা মনে পড়েছে। যদিও সে মেরুদন্ড সঙ্গে শারীরিক মেরুদন্ডের কোন সম্পর্ক নেই। রবীন্দ্র জয়ন্তীতেই অশোক আরব কুলের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তারা মানুষ নয়,ফুল বটে।রবীন্দ্র জয়ন্তীতেই একদিন পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া অমরেন্দ্রনাথ হিংটিং ছট অভিনয় করে একদম মাতিয়ে দিয়েছিল। স্বাধীনতা দিবসে বিপ্লবীদের আত্ম বলিদান এর কথা শুনে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যেত। তবে বক্তব্য শেষে বোঁদের লাইনে ঠেলাঠেলি দেখলে সে কথা মনে হওয়ার জো ছিলনা। বোঁদে দিতেন শঙ্করবাবু। তার ছিল রবীন্দ্রনাথের মতো দাড়ি। প্রতিবছরই আমরা ঈশ্বরের কাছে তার করতলের ক্ষেত্রফল বৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করতাম। বার্ষিক ক্রীড়ার তিনটি দিন ছিল মুক্তির তিনদিন। খেলাতে দক্ষতা না থাকলেও উৎসাহ কম ছিল না। শেষ দিনে হতো বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী। একটা পুরস্কার পেলেই মনে হতো যেন পৃথিবী জয় করে ফেলেছি । সেই দিনই হতো গো এজ ইউ লাইক । সেখানে একবার এক সিনিয়র দাদা জ্যান্ত সাপ নিয়ে এসে সবাইকে চমকে দিয়েছিল।

স্কুলের সরস্বতী পুজোয় একদল ব্যস্ত থাকত জ্যান্ত সরস্বতীদের নিয়ে। সেদিন নিয়মকানুন থাকত একটু শিথিল। আর জড় সরস্বতী যাদের দায়িত্বে থাকত তারা প্রসাদী ফল চুরি করে খেয়ে তাদের হতাশা মেটাতো।

      (পরবর্তী অংশ পরের পর্বে)

🍂

Post a Comment

0 Comments