জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—জর্জিয়া (এশিয়া)একজন মুচি আর দুটি পুতুল /চিন্ময় দাশ


চিত্র- শুভম দাস
দূর দেশের লোকগল্প—জর্জিয়া (এশিয়া)
একজন মুচি আর দুটি পুতুল
চিন্ময় দাশ


ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর। একজন মুচি তার বউকে নিয়ে থাকে সেটাতে। তবে থাকে মানে, কোনরকমে ঠেসেঠুসে জড়াজড়ি করে থাকা। তাছাড়া, উপায়ই বা কী?
ঐটুকুনই তো একটা কুঁড়ে। কতটুকু আর জায়গা। তাতেই সামনে আলাদা করেএক্টুখানি যায়গা বের করেছে। সেটাতে বসেই জুতো বানায়। সেটাতে বসেই বিক্রিবাটা। বাকি রইল পেছন দিকে এক ফালি জায়গা। কোন রকমে মাথা গুঁজে থাকে দুটিতে। 
ঘরে বউ আর অভাব—এই নিয়ে সংসার মানুষটার। তবে, ভারি ভালোমানুষ তারা দুটিতে। অভাব আছে, তা বলে কোন খেদ নাই দুজনের। অভিযোগ নাই কোনও। কেবল একটি কথাই জানে তারা—অভাবের জীবন। কাজ করে যেতে হবে। না করলে, চলবেই বা কী করে। দু-দুটো পেট। রুটি জুটবে কোথা থেকে?
তেমন পূঁজিও নাই, বেশি বেশি চামড়া কিনে আনবে। বেশি বেশি জুতো বানিয়ে ফেলবে। নিত্যদিন একজোড়া জুতো বানায়। সেটা বেচে, যা টাকা (সে দেশের টাকার নাম-- লারি) হাতে আসে, তা থেকে দুজনের রুটি জোগাড় করতে হয়। তার পর যা হাতে থাকে, তাতে এক জোড়া জুতোর চামড়াি কোন মতে কেনা যায়। 
এভাবেই কোন মতে দিন কেটে যায় দুজনের। 
একদিন ভারি অবাক করা একটা ঘটনা ঘটে গেল তাদের। আগের দিন শরীরটা একেবারে ভালো ছিল না। কাজ করবার মত দম ছিল না মানুঢটার। জুতো বানাবার চামড়া টেবিলে রেখে, শুয়ে পড়েছিল। 
সকালে উঠে, একেবারে ভোজবাজির মতো ব্যাপার। আকাশ থেকে পড়ল দুটিতে! এমনটা হোল কী করে? চোখ ছানা বড়া। যেখানে চামড়া রাখা ছিল, এখন টেবিলের উপর সেখানে ঝকঝকে জুতো একজোড়া। ভোজবাজি ছাড়া, আর কী বলা যায় একে? 
আকাশ পাতাল ভেবে সারা হোল দুজনে। কিন্তু কিছুতেই কিছু এলো না মাথায়। বউ বলল—প্রভু যীশুর দয়া। আমরা ভেবে মরব কেন? 
লোকটা হাটে চলল জুতোজোড়া নিয়ে। বিকোলও ভালো দামেই। খাবার-দাবারে না খুইয়ে, সেদিন বাড়তি রুবলে বেশি চামড়া কিনল লোকটা। 
ঘরে ফিরে বউকে বলল—জানো, বেশি পয়সা পেলাম কিছু আজ। বেশি চামড়া কিনেছি তা দিয়ে। দু’জোড়া জুতো বানানো যাবে এই চামড়া । 
বউ ভারি খুশি। বলল-- ভারি ভালো কাজ করেছ। দু’ জোড়া জুতো বানাবে কাল। 
পরের দিন সকালেও সেই একই ব্যাপার। চামড়া উধাও। দু’জোড়া জুতো হাজির টেবিলের উপর। দেখে আনন্দেরসীমা নাই দু’জনের। শুধু তো বানানো জুতো পাওয়া যাচ্ছে তাই নয়। কী বাহার সেসব জুতোর! যেমন রঙ, তেমনই সেলাই, তেমনই গড়ন জুতোগুলোর। এমন বাহারি জুতো কেউ কোনদিন দেখেনি এ তল্লাটে।
হাটে গিয়ে হাজির হতে না হতেই, খদ্দেররা হামলে পড়ে। দেখতে না দেখতে জুতো বিকিয়ে যায়। দাম দেয় তারা ভালোই।
এভাবেই চলতে লাগল। প্রতিদিন বেশি বেশি করে জুতো হাজির থাকে তাদের টেবিলে। এখন আর হাটে ছুটতে হয় না মুচিকে। তার বাড়িতেই চলে আসে খদ্দেররা। এখানেই বিকিয়ে যায় জুতোগুলো।
এভাবে অনেক রূবল জমা হয়ে গেল মুচির ঘরে। অভাব বলে আর রইল না কিছু। মুচি সারাদন বসে বসে জুতো বেচে। আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে জুতোগুলোকে। কেমন ভাবে বানানো হয়েছে। সেলাই-ফোঁড়াই হয়েছে কীভাবে—এই সব। 

🍂

একদিন মুচির খুব মুখ ভার। তার বউ বলল—কীগো, কী হয়েছে? এমন মুখ ভার কেন?
লোকটি বলল—আমার কিন্তু মনে হয় না, এসব প্রভু যীশুর কাজ। প্রভু  কি আর নিজের হাতে জুতো বানাতে বসবেন? আর কোন কাজ নাই তাঁর? দুনিয়া জোড়া লক্ষ্য কোটি মানুষের দাবী তাঁর কাছে। তিনি কি আর আমার মতো মানুষের জন্য জুতো বানিয়ে রাত কাবার করে দেবেন?
বউ বলল—তা হলে কার কাজ এটা? কে এতো দয়া করছে আমাদের? কেউ না কেউ তো বানিয়ে দিচ্ছে জুতোগুলো!
--সেটাই খুঁজে দেখতে হবে আমাদের। কার এতো করুণা আমাদের উপর? লোকটির মুখ গোমড়া হয়ে উঠছে একটু একটু করে।
সেদিন রাতে খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়ল দুটিতে। যেমন প্রতিদিন করে থাকে। কিন্তু দু’চোখের পাতা এক করল না। জেগে রইল সারা রাত। 
রাত নিঝুম হয়েছে। কে যেন ঘরে ঢুকেছে। বর-বউ তো জেগেই আছে। সব দেখছে চোখ বড় বড় করে। একজন নয়, দু’জন। ছোট্ট ছোট্ট চেহারা। হাতের চেটোর মত ছোট। একটি ছেলে একটি মেয়ে। যেন গোলগাল পুতুল দুটি। তারা ঢুকতেই ঘর আলো হয়ে গিয়েছে। চটপট জুতো বানাতে লেগে গিয়েছে দুজনে। 
কী খর হাত তাদের। চামড়া কেটে ফেলল। সেলাই-ফোঁড়াই করল। রঙ বুলিয়ে দিল চটপট। কাজ সারা হলে, টেবিলের উপর সব জুতো সুন্দর করে সাজিয়ে, বেরিয়ে গেল দুটিতে।
সকালে উঠে, লোকটা বসে বসে পুতুল দুটোর জন্য জামা-জুতো বানাতে লাগল। কিছু বুঝতে না পেরে, বউ অবাক হয়ে বলল—কী করছো গো?  
আলো জ্বলে উঠল লোকটার মুখে—ছেলেপুলে নাই আমাদের। কোন দিন কিছু করিনি তাদের জন্য। আজ এই পুতুল দুটোর জন্য পোষাক বানাব। কত উপকার করছে আমাদের। 
শুনে বউ ভারি খুশি। বলল—এক কাজ করলে হয় না? এখন তো বলতে গেলে বড়লোকই হয়ে গেছি আমরা। আর কেন ছোট্ট দুটকে দিয়ে কাজ করাব? এবার বিরাম দাও ওদের। অভাব তো ঘুচে গিয়েছে আমাদের। 
লোকটারও বেশ মনে ধরল কথাটা। সুন্দর করে একজোড়া পোষাক বানাল দুজনের জন্য। জামা হোল। জুতো হোল। মাথার টুপি হোল। শীতের দেশ, তাই হাতের দস্তানাও বানানো হোল। 
টেবিলের ওপর প্রতিদিন চামড়ার স্তুপ সাজানো থাকত। আজ এক্টুকরো চামড়াও রাখা হোল না। যত্ন করে জামা-জুতো সাজিয়ে রাখা হোল টেবিলের ওপর। এক দিকে ছেলেপুতুল আর একদিকে মেয়েপুতুলের জন্য। 
সেদিন রাতেও দু’চোখ এক করল না তারা। জেগেই রইল। কী ঘটে, দেখবার জন্য। 
যেই রাত নিঝুম হোল, অমনি হালকা থুপ-থুপ আওয়াজ। পুতুল দুটি ঘরে ঢুকেছে এসে। ঘর এখন আলোময়। টেবিলের সামনে গিয়ে তো ভারি আনন্দ তদের। টুক টুক করে পরে ফেলল পোষাকগুলো। তারপর শুরু হোল তাদের নাচ। তার সাথে গানও। 
দুটি পুতুল আনন্দে নাচছে আর গাইছে। পরণে তাদের জন্য বানানো পোষাক। চোখে মুখে আলো যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। দেখে আনন্দে বুক ফেটে যেতে লাগল বর-বউয়ের। পুতুল নয়, নাচ-গান করছে যেন তাদের নিজেরই ছেলেমেয়ে দুটি।
পরদিন থেকে আর আসে না পুতুল দুটি। অভাবি মানুষ দুটিকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তারা। তাছাড়া, আসবেই বা কেন? মুচি যে আর এক টুকরো চামড়াও রেখে দেয় না টেবিলের ওপর। নিজের কাজ নিজের হাতেই করে নেয় সে।

Post a Comment

0 Comments