পর্ব ৫। খ্যাপা বিশুর ডেরায়
বাসুদেব গুপ্ত
বে লেক সিটিতে থাকেন অনির্বাণের দাদু বিশ্বপতি । ৮৫ এর কাছে বয়স। এখনও খুব অহংকারী, আত্মনির্ভর। তিনি একেবারে গোড়ার দিকের কম্পিউটার ইন্জিনীয়ার। ১৯৭২ থেকে তিনি এই যন্ত্রগণক বিপ্লবের অংশীদার। তাঁর জীবনকালে তিনি দেখেছেন কিভাবে ধীরে ধীরে কম্পিউটার মানুষের জীবনকে সম্পূর্ণ অধিকার করে নিয়েছে। এআই তো কোন আলাদা যন্ত্র না, কোটি কোটি কম্পিউটারকে বিশেষ কায়দায় সাজিয়ে, বিশেষ সফটওয়্যার দিয়ে বেঁধে এক মহাযজ্ঞ। বিশ্বপতির থেকে যোগ্য লোক কেউ বেঁচে নেই যার নখদর্পণে আছে এই বিবর্তনের সম্পূর্ণ ইতিহাস।
দেশের প্রথম মাইক্রোপ্রসেসর ব্যবহার করে কম্পিউটার বানান তিনি। আবার বানান তিনি দেশের প্রথম ই ভি এম । পরে অবশ্য তাঁর প্রচুর আফশোষ সে মেশিনের দুরুপযোগ ও হ্যাকিং দেখে। তিনি ইন্টারনেটের জন্ম দেখেছেন, ইনটেলের প্রথম সি ই ওর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত প্লেনে ঘুরে দেখেছেন সিলিকন ভ্যালির আবির্ভাব। আবার দেখেছেন তার চূড়ান্ত সাফল্য দ্রুত অবক্ষয় ও সম্পূর্ণ পতন। এখন তিনি তাঁর দিন কাটান একাকী ৫০০০ স্কো ফুটের স্পেশাল ওল্ড মেন্স শেল্টারে। ৫০০০ স্কোয়ার অনেক বেশি জায়গা যা একমাত্র রিটায়ারড বড় অফিসার ছাড়া কেউ পান না। বিশ্বপতি একটু স্পেশাল, তাঁর সম্পদ না থাকুক, পাগলা কম্পিউটার বিশারদ বলে খ্যাতি আছে। তাঁর শহরের পঞ্চাশ শতাংশ এখন নোনা জলের তলায়। এখানে বসে তাঁর বুড়ো বয়সের অবসর বিনোদন এআই নিয়ে খেলা করা। ছোট ছোট রোবট বানিয়ে একটা রোবটের চিলড্রেন্স পার্ক করার ইচ্ছে। পৃথিবীতে জন্মহার এত কমে গেছে, শিশু প্রায় দেখাই যায় না। সেই পার্কে রোবট শিশুরা খেলবে দুলবে লাফাবে আর ভারচুয়াল গার্জেনরা তাদের সংগে খেলতে পারবে। এরকম সব বিটকেল আইডিয়ার জন্যই দাদু তাঁর পরিচিত মহলে খ্যাপা বিশু নামে পরিচিত। সামনে সবাই একটু সম্ভ্রম দেখায়, কিন্তু আড়ালে হাসে। দরকার হলে তাঁর কাছে টুকটাক এলগরিদম বানিয়ে নেওয়া বা ডেটা হান্টিং করে কিছু ডিশিসন যেমন কোন শেয়ার উঠবে বা নামবে এসব তথ্য পাওয়া যায়। অনির্বাণের এসব দরকার নেই। ও চায় কিভাবে এআই প্রথম তৈরী হলো সেটা ভালো করে বুঝতে।
আজকাল নেহাত শখ না হলে কাউকে কোথাও উড়ে যেতে হয় না। জ্বালানী তেল দুষ্প্রাপ্য তাই শুধু নানা রকম মেটিরিয়াল ট্রানসপোর্ট করতে এই ৯০ ভাগ তেল চলে যায়। মানুষ বেশির ভাগ সময় ভার্চুয়ালি চলা ফেরা করে। চিকিৎসা তো অনেক দিনই অনলাইনে হয় এখন বেশীর ভাগ অপারেশানও রোবটরাই করে।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
অনির্বাণ ভার্চুয়াল ড্রোনে লোকেশন সেট করে দিল বিশুদাদুর কিউবের। ৮৮.৩১ বাই ২২.৪৯। নিমেষেই দাদুর ঘরে ঢুকে যায় ড্রোন। পৃথিবীর সব পাকা বাড়ীতেই এখন কম্পালসরী ম্যাজিক আই লাগাতে হয়। যাতে যে কেউ, বিশেষ করে সরকারী অথরিটি যখন ইচ্ছে পৌঁছে যেতে পারে বিনা বধায়, সম্পূর্ণ দৃষ্টির সামনে দেখা ও কথা বলা যায়। গ্যাজেটগুলো সব চীনের আর এলগরিদম সব ইস্রায়েলের। এ দুটো দেশ এখন সি আই ২৪ নামে একটা এলায়েন্স করে সম্পূর্ণ টেকনলজির জগৎটা চালায়। যদিও ভারতভূমির রাষ্ট্রপতি এখন শুধু মার্কেটের বিশালত্বের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক। আসল শক্তি আর এখন টেকনলজিতে নয়, রাজনীতি ও সমাজনীতিতে। ভারতভূমি দিকপাল মনীষী চাণক্যকে অনুধাবন করে নতুন সুত্র তৈরী করেছে, তার নাম স্ব+ অর্থনীতি= স্বার্থ নীতি। আর সেই জোরেই ভারতভূমি আজ সর্বশক্তিমান পৃথিবীর স্পিরিচুয়াল গুরু ও গাইড।
পিছনে বক বক করে যাচ্ছিল আভা। আজকের ভারচুয়াল টুরের গাইড ও। সুঠাম চেহারা, যেমন রোবটদের হয়, তার ওপর হিউমার ইন্ডেক্সটা বেশি করে রেখেছিল অনির্বাণ। নইলে একটু পরেই বকবক শুনে ঘুম পেয়ে যায় ওর। আভার নামকরণ এক্স মেসিনা নামে এক সাই ফাই ছবির রোবটের নামে। খুব জনপ্রিয় হয় এই সিনেমাটি তার সময়ে। আভা সারাক্ষণ মন্তব্য আর বর্ণনা করেই চলেছে। হেডবক্সে প্রিং করে আওয়াজ হতেই সে কায়দা করে ঘোষণা করল অনির্বাণ রাজা পধারিয়ে। বিশুদাদু হাজির?
আভা এখন নতুন মডেলে এচ আর আই ৩.০ হিউমান রিলেশন্স ইনটারফেসে চলে। তারা জানে ‘জোক্স’ করলে পাবলিক খুশি হয়।
অনির্বাণের ফুল এক্সেস বা পূর্ণ অনুমতি থাকলেও প্রাইভেট পার্টি কোন প্রাইভেট ঘরে ঢোকার আগে একটা পারমিশন লাগে। সে মানুষ হোক বা ভারচুয়াল ড্রোন হোক। দাদু সেটা দিতেই একেবারে দাদুর ল্যাবে পৌঁছে যায় অনির্বাণ। দাদু কফি বানিয়ে সবে চুমুক দিতে যাচ্ছে ঠিক সে সময় অনির্বাণের অবতার গিয়ে পৌঁছয় দাদুর ঘরে।
-আয় দাদুভাই। অনেকদিন পরে এলি এবার। এই দ্যাখ, কফি খাচ্ছি কিন্তু অফার তো করতে পারবো না। এই এলগরিদমটা কত চেষ্টা করলাম সিলিকন ভ্যালিকে খাওয়াতে, রিয়েল ওয়ার্লডের থেকে ভারচুয়াল ওয়ার্লডে ভারচুয়াল জিনিস পাঠানো। অনেক বেশি স্বাভাবিক ইন্টারএকশান হত। ওরা গ্রাহ্য করল না। যাক এখন ওরাও চুকে বুকে গেছে। silicon ভ্যালির নাম শেষকালে হয়ে গিয়েছিল silly-con valley. হাঃ হাঃ হাঃ। বল কি ব্যাপার। আবার বিয়ে করার ইচ্ছে হল নাকি ? দেখে নাতবৌকে এপ্রুভ করতে হবে? আমি আর ঐ ঝামেলায় নেই। আবার সে চাঁদে পালিয়ে যাবে, সোনার চাঁদ নাতিকে ছেড়ে।
অনির্বাণ ছদ্ম রাগ দেখায় একটু। কিন্তু অফিসিয়াল ডিউটি, সব মনিটার হচ্ছে। এখন খাজুরে গল্পের সময় নেই। ও সোজা বিষয়ে আসে।
-আমাকে একটু এআইএর গোড়া থেকে বুঝিয়ে দেবে! কি করে এ সব শুরু হলো, কিভাবে এআই তৈরী করা হয় এসব?
-কেন রে তুই আবার এআইএর ইতিহাস নিয়ে পড়লি কেন? তোদের তো জন্ম থেকেই এআই আছে, ভারচুয়াল যাওয়া আসা, কষ্ট করে প্লেনে ট্রেনে চড়ে যেতে হবে না দাদুকে দেখতে।
অনির্বাণ বুঝতে পারে ব্যাপারটা ইমোশনাল দিকে যাচ্ছে কারণ ওর ব্রেন লিংক ফলস আই গ্লাসে ওয়ার্নিং আইকন দেখাতে শুরু করেছে। ও তাড়াতাড়ি ম্যানেজ করার চেষ্টা করে,
--আচ্ছা দাদু তোমার মত এত বড় টেকনলজিস্ট, তোমাকেও বোঝাতে হবে আমাদের জ্বালানী ছিল আর মাত্র দশ বছরের। বাধ্য হয়েই বেশিরভাগ যাতায়াত ভারচুয়াল করতে হয়েছে। তোমাদের সময় থেকেই তো সব কিছু ভারচুয়াল করে দাও। কম্পিউটার, স্টোরেজ, ফটো এলবাম, লাখ লাখ ডেস্কটপের ফাইল সব তুলে দিলে ক্লাউডে, নিজের বলে আর কিছু রইল না। একটা প্রাইভেট মোমেন্ট, তার ছবি তুললে সেটাও চলে গেল গুগল ক্লাউডে। গুগল সব দেখত, জানতো। কারো তাতে কোন হেল দোল হয় নি।
প্রবল হেসে ওঠে দাদু।
--বেশ বাবা বেশ, হার মানছি। সব আমাদের দোষ। কিন্তু না হলে লোকে রাখতো কোথায় এত ফটো, লেখা, বই? ফোন আর ল্যাপটপ তো দুদিনেই শেষ হয়ে যেত। তারপর সেটা চুরি হল তো বাস, সব গেল। তুই দাদু নাতি ঝগড়া রাখ, বল তোর হঠাৎ কি দরকার হল এআই নিয়ে।
--সেটা তো ক্লাসিফায়েড। বলা যাবে না।
--গড কে, কেন সে ভয় দেখাচ্ছে সেটা তোকে তদন্ত করতে দেওয়া হয়েছে। তাই তো?
অনির্বাণ উত্তেজিত হয়ে পড়ে, কি করে জানলে?
আবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে দাদু।
--সিম্পল মিঃ ওয়াটসন। আমার তো আর ব্রেন লিংক নেই কিন্তু এই ছোট্ট থট এনালাইজারটা আছে।
আন্গুলে পরা আংটির দিকে তাকিয়ে দাদু চোখ টেপে। তারপর বলে,
-সবচেয়ে পাওয়ারফুল নিউরাল নেটে একে ট্রেনিং দেওয়া। এখন থট প্রসেসিং তো এর কাছে ছেলেখেলা। কি বুঝলি? আসলে তা নয়। এখন তো সারা পৃথিবীতেই গড নিয়ে হই চই চলছে। তুই এখন টপ সিক্রেট পোস্টে আছিস, তোর পারমিশানের সময় যে আলোটা জ্বলল তার রঙ বেগুনী, তাতেই বুঝলাম। তার ওপর তুই এআই নিয়ে খোঁজ করছিস, ব্যাস কিউ ই ডি। হাঃ হাঃ হাঃ
অনির্বাণ তাড়াতাড়ি কথা চাপা দেয়,
-ঠিক আছে নিজের গুণগান বন্ধ করে এবার শুরু কর তো। এআইএর ব্যাপারটা কি বোঝাও দেখি।
-সে তো অনেক কথা। তোর সময় হবে তো? এক দিনে হয়ত হবে না, দু তিনটে সেশান লেগে যাবে। হবে তোর সময়?
দাদুর চোখ দুটো তার দিকে আকুল ভাবে চেয়ে আছে। অবতারের চোখ, তাই দিয়েই অনির্বাণ দেখে, সে চোখ চাইছে যতখন পারে তাকে চোখে চোখে রাখতে। সে মাথা নাড়ায়।
(ক্রমশ)
🍂
0 Comments