সপ্তদশ পর্ব
মলয় সরকার
আরাসিয়ামা মন্দিরের প্রবেশপথের একপাশে রয়েছে Sogenchi Garden। তবে সব ঘোরা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে আর সারা দিনেও কুলোবে না , আমাদের শক্তিতেও কুলোবে না।
ভিতরে গিয়ে দেখি ,মন্দিরের বাইরে রয়েছে একটি জাপানী রীতিতে তৈরী জলাশয়, যার মধ্যে ধারে ধারে সুন্দর পাথর দেওয়া আছে। এটির নাম Sogen Pond,এটি তৈরী করেন Muso soseki।
Taho Den নামে একটি হল রয়েছে, সেখানে একটি কাঠের মূর্তি রয়েছে , যেটি নাকি সম্রাট Go Daigoর। এটি ১৯৩৪ সালে তৈরী হয়েছিল, অর্থাৎ এটি অপেক্ষাকৃত নতুন।
এরকম বেশ কিছু কাঠের ঘর রয়েছে এখানে, যেগুলো ভক্তদের কাছে নিশ্চয়ই বিশেষত্ব আছে। সবটা আমরা বুঝি নি। তবে সবাই যে খুব ভক্তিভরে আসছেন, তা বুঝতে পারি। শুধু বয়স্করা তো নয়, অনেক তরুণ তরুণীরাও আসছেন এখানে। এখানে খাওয়ার জায়গাও আছে। পুকুর বা বাগানের ধারে বসলে প্রশান্তিতে মন ভরে যায়।
আরাশিয়ামার রিক্সাওয়ালা
এখান থেকে বেরিয়ে দেখি বাইরে রাস্তায় টানা রিক্সার ছড়াছড়ি। এগুলো ঢোকার সময় দেখি নি। তখনও তো এত ভিড় হয় নি। বেলা বাড়তে ভিড় বেড়েছে। তবে টানা রিক্সাগুলি দেখে মনে হল, এগুলি বেশির ভাগই টুরিস্টদের আনন্দ দেওয়ার জন্য শখের রিক্সা। রিক্সাগুলি সব ঝাঁ চকচকে, সুন্দর ,নতুনের মত।যাত্রী উঠলে বা নামলে রিক্সাওলা নামার জন্য যত্ন করে একটা টুল পেতে দিচ্ছে ,যাতে যাত্রীর নামতে সুবিধা হয়।এ ছাড়া রিক্সায় উঠলে ওরা সবাইকে পা থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে দিচ্ছে একটা লাল মখমলের চাদর দিয়ে। রিক্সা ওয়ালাদেরও একটা ড্রেস কোড রয়েছে মনে হচ্ছে। সবাই হাফ প্যান্ট পরা, খুব ধূসর সাদা রঙের টাইট গেঞ্জি বা জামা পড়েছে সবাই। আর প্রত্যেকের পায়ে নরম জুতো , বোধ হয় হাঁটার সুবিধার জন্য।এরা যে খুব বেশি দূর যাচ্ছে এমন নয়।মনে হল এগুলি ঐ একটু নিছক আনন্দের জন্য মানুষ চড়ে। ঠিক যেমন কলকাতায় ভিক্টোরিয়ার সামনে লোকে ঘোড়ার গাড়ি চাপে।রিক্সাওয়ালা ছেলেগুলির ভাবভঙ্গী দেখেও তাই মনে হল। এর ভাড়াও বেশ বেশি। রাস্তার পাশে রয়েছে রিক্সার ওঠা নামার জন্য বা রিক্সা থাকার জন্য আলাদা জায়গা।প্রত্যেকটি রিক্সাওয়ালাই তরুণ ছেলে , বেশ শক্তপোক্ত। এর আগে টোকিওর রাস্তায়, কয়েকটা হাতে টানা রিক্সাওয়ালা দেখেছি।এই রিক্সার আদি জন্মই যে এখানে, সেই ইতিহাসটা মনে পড়ল। তাই এর জন্মভূমিতে একে সেই প্রাচীন রূপে দেখে বেশ লাগল।
সোগেঞ্চি বাগান
এখান থেকে বেরিয়ে আমরা যেটি শুনে এখানে এসেছি, সেই বাঁশের জঙ্গল দেখতে গেলাম। এটি একেবারে পাশেই। বাঁশের জঙ্গল দেখতে সবাই আসেন, এটি খুব বিখ্যাত দ্রষ্টব্য আরাশিয়ামার। দেখলাম ,একটি সরু রাস্তা চলে গেছে বড় রাস্তা থেকে ভিতর দিকে।তার দুপাশে সরল মোটা বাঁশের জঙ্গল। এরকম বাঁশ ঝাড় যে আমাদের দেশে নেই তা নয়, অনেক আছে, শয়ে শয়ে আছে। এর চেয়ে ভাল বাঁশ আছে, আমাদের আসাম, অরুণাচল, নাগাল্যাণ্ডে। ভাবলাম, কিন্তু আমরা তো সারা পৃথিবীর লোককে ডেকে দেখাতে পারি না, ওগো আমাদের দেশের বাঁশ দেখে যাও।কিন্তু ওরা পারে।তাই আমাদের মত দেশের মানুষকেও সুদূর জাপানে গিয়ে বাঁশঝাড় দেখতে হচ্ছে, আর বলতে হচ্ছে সবার সাথে গলা মিলিয়ে, বাঃ কি সুন্দর।
🍂
হ্যাঁ , সুন্দর তো বটেই। ওরা সাজিয়ে গুছিয়ে পরিচ্ছন্ন করে রেখেছে ।সুন্দর তো হবেই। পাশাপাশি বেশ কিছু সরু গলি রয়েছে এরকম, যার চারপাশে বাঁশের জঙ্গল।১৬ বর্গমিটার জুড়ে এই mōsō bambooর যে বাগান তাকে সরকার থেকেও বেশ প্রাধান্য দেওয়া হয়।
এই বাঁশের জঙ্গলের ভিতরের রাস্তা দিয়ে এগোলে একটু দূরেই রয়েছে একটি ছোট শিন্টো শ্রাইন বা মন্দির, যার নাম Nonomiya Shrine ।এটি ছোট বটে তবে এর আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে।এই নোনোমিয়া শ্রাইন কথাটির অর্থ হল দেশের মন্দির। এখানে যে পুরোহিতেরা আসেন দায়িত্ব নিতে তাঁদের বেশ কিছুদিন কঠোর আত্মশুদ্ধির ব্রতের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তবেই এখানে পূজা করার অধিকার লাভ করেন।
মন্দিরে ঢোকার মাদুর বিছানো রাস্তা
অতীতে একসময় রাজ্যের রাজকুমারীদের এক বছর এখানে কঠোর আত্মশুদ্ধির ব্রতের মধ্যে থেকে নিজেকে শুদ্ধ করে তবে রাজপরিবারে সকলের সাথে একই গোত্র ভুক্ত হওয়ার অধিকার লাভ করতে হত। অবশ্য বিপরীতভাবে রাজপুত্রদের জন্য এমন নিয়ম নির্দিষ্ট ছিল বলে শুনি নি।
আসলে সারা পৃথিবীতেই মনে হয়, কঠিন পরীক্ষাগুলো মেয়েদের উপরেই চাপানো ছিল, আর ছেলেরা সব ধোয়া তুলসীপাতা! তাই আমাদের দেশেও সীতাকে অগ্নি পরীক্ষা দিতে হয়েছিল।
এটি একটি ছোট মন্দির। তবে অনেকেই আসছেন এখানে ভক্তিভরে শ্রদ্ধা জানাতে।আমার অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় খুব বিশেষ কিছু আকর্ষণীয় মনে হল না।
আমার আর এর বেশি বাঁশের বাগান দেখার আগ্রহ হল না।আমরা চলে এলাম। তবে, একটা কথা ঠিক , এখানে এত শান্ত পরিবেশ তাতে আবার শান্ত বাঁশের জঙ্গল , মন নিজে থেকেই শান্ত হয়ে যাচ্ছিল। রাস্তার পাশে পাশে ছোট ছোট মেমেন্টোর দোকান রয়েছে। তবে নিতে গিয়ে একটু উলটে পালটে দেখলাম, সব চীনের তৈরী। আমি তাই ভাবলাম, রোমে গিয়ে মেমেন্টো কিনেছি, তাও চীনের তৈরী , ভারতে কিনেছি তাও চীনের তৈরী, প্যারিসে কিনেছি, তাও চীনের তৈরী, আর এই জাপানে কিনতে গিয়ে দেখি তাও চীনের তৈরী। অর্থাৎ যে কোন দ্রষ্টব্য স্থানে, সেই দেশের যা যা মেমেন্টো পাওয়া যায়, সারা পৃথিবীতে, সব চীনের তৈরী। আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিলাম। কি ভাবে চীনের ব্যবসা কোথায় সারা পৃথিবী দখল করেছে।
এখান থেকে আমরা আবার গাড়ি ডেকে চললাম Ryoanji Temple এ।Ryoanji Temple কথাটির অর্থ (Dragon Peace Temple) ।
এটি সঠিক অর্থে বোধ হয় মন্দির নয়, আসলে জেন বৌদ্ধধর্মের উপাসনার স্থান এটি।এখানে যে রীতিতে বাগান সাজানো আছে তা এক অভূতপূর্ব শুকনো ল্যাণ্ডস্কেপ, যা জাপানের এক বিশিষ্ট বাগান সাজানোর পদ্ধতি। এখানে যে পাথর গুলি সাজানো আছে তা সযত্নে সংগ্রহ করে তাকে পালিশ করে বিশেষ পদ্ধতিতে সাজানো হয়েছে,।এখানে ঢুকে যাতে মন শান্ত ও সমাহিত হতে পারে, তারই ব্যবস্থা। এটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ আখ্যায়ও ভূষিত। এখানে প্রথম মন্দির তৈরী হয় ১৪৫০ সালে।
আরাশিয়ামা মন্দিরে যাওয়ার করিডোর , পিছনে মাউন্ট আরাশিয়ামা
এলাম তো এখানে, কিন্তু মন্দিরগুলিতে টিকিটের দাম যথেষ্ট, বেশ গায়ে লাগার মত।সে যাক, আসল কথা হল, আমাদের ক্যাশ শেষের পথে অথচ, কাছাকাছি এটিএম দেখতে পাচ্ছি না। কি করব তাই ভাবছি।
এনারা আবার ক্যাশ ছাড়া আর কিছু নেন না, সেটাই সমস্যা।
দেখা যাক, কি করা যায়। আর আপনারা তো রয়েছেনই সঙ্গে। কাজেই–
ক্রমশঃ-
0 Comments