জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব- ১৬ /স্বপন কুমার দে

চিত্র- শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ১৬

স্বপন কুমার দে


অফিসে সম্পূরকের কাজের চাপ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অল্প বয়স এবং খুব এফিসিয়েন্ট বলে বড়সাহেবের খুব প্রিয় পাত্র। তিনি এটা ওটা অতিরিক্ত কাজের দায়িত্ব দেন সময়ে সময়ে। সম্পূরক না করতে পারে না। এখন আবার নতুন ছোটসাহেব অসীমবাবু এসেছেন। এমনিতে সম্পূরককে খুব একটা গুরুত্ব দেন না কিন্তু কাজের বেলায় তিনি চোখের সামনে সম্পূরককেই দেখতে পান।

গত মাসে বরুন সাহা অবসর নিলেন কিন্তু সে জায়গায় নতুন কোন কর্মী নিয়োগ হয়নি। অসীমবাবু করলেন কী, না বরুনবাবুর পুরো দপ্তরটাই সম্পূরকের ওপর চাপিয়ে দিলেন। সম্পূরক আপত্তি করেছিল, এমনকি বড়সাহেবও ঐ দপ্তরের কাজ দু'তিনজনের মধ্যে ভাগ করে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু অসীমবাবুর জেদের কাছে তাদের হার মানতে হয়। কাজেই অফিস থেকে বেরোতে সম্পূরকের প্রায়দিনই দেরি হয়। বেশিরভাগ দিনই রূপসা তার আগেই বেরিয়ে পড়ে।

পৃথিবীতে কেউ কেউ আছে, যারা গায়ের জোরে সবকিছু কেড়ে নিতে চায়। তার নিজের পছন্দ অপছন্দ অপরের ওপর চাপিয়ে দেয়। কোনো যুক্তি এরা মানে না, অন্যের সেন্টিমেন্ট এরা বুঝেও অগ্রাহ্য করে। অসীমের সঙ্গে রূপসার কেবলমাত্র পূর্ব পরিচয় বা বন্ধুত্ব ছিল, পূর্ব প্রণয় নয়। সব বন্ধুত্ব প্রণয়ের রূপ পায় না। কিন্তু এতদিন পর তার হঠাৎ মনে হল, রূপসার উপর যদি কারও বেশি অধিকার থাকে তবে সেটা অসীমের। রূপসা তার স্বাভাবিক অধিকার, স্বাভাবিক প্রেম। এর বাইরে অন্য কিছু থাকতে পারে না। রূপসা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। না ছাড়তে পারে সম্পূরককে, না ফেরাতে পারে অসীমকে। অসীম তার ধুরন্ধর বুদ্ধিতে বুঝতে পারে তার পথের কাঁটা সম্পূরক। কাঁটা উপড়ে ফেলতে চায় সে।
সম্পূরক মাপতে চেষ্টা করে অসীমকে। তার হাবভাব, রূপসার প্রতি গায়ে পড়া অন্তরঙ্গতা সে লক্ষ্য করে। এমনকি সম্পূরকের প্রতি অসীমের কথাবার্তাও দৃষ্টিকটূ ধরনের। অফিসে বা সিঁড়িতে বা রাস্তায় দেখা হলে সম্পূরক হয়তো সৌজন্য দেখিয়ে, মৃদু হেসে, 'গুড মর্নিং স্যার', বলে অভিবাদন জানাল,তখন তার উত্তরে বিন্দুমাত্র প্রতি সৌজন্য না দেখিয়ে শুধুমাত্র ঘাড় হেলিয়ে চলে যায়। যেন অধস্তনের প্রতি সৌজন্য দেখানো করুণার পর্যায়ে পড়ে। অসীম প্রতি মুহূর্তে সম্পূরককে বোঝাতে চায় যে সে সুপিরিয়র।

রূপসার আচরণে আঘাত পায় সম্পূরক। সে কি বোঝেনা সম্পূরকের মনের কষ্ট। তাহলে কেন সে বলতে পারে না অসীমকে তাদের সম্পর্কের কথা? কেন এড়াতে পারে না অসীমের যখন তখন গায়ে পড়া অন্তরঙ্গতা। মনের যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়তে থাকে।

সেদিন অফিস থেকে বেরিয়ে ভালো লাগছিল না সম্পূরকের। কেমন যেন মনখারাপ মনখারাপ। সারাদিন কাজের ঝামেলায় রূপসার সঙ্গে কোনো কথা বলা যায় না, এমনকি টিফিন টাইমেও না। তখন অসীম ডেকে নেয়। অদ্ভূত একটা বেদনা বোধ হয়। কিছুদিন আগে পর্যন্ত একসঙ্গে বাড়ি ফেরাটাই ছিল তাদের প্রতিদিনের অভ্যাস, আর আজ তাকে একা একাই বাড়ি ফিরতে হয়। এই নিঃসঙ্গতা তার পাওনা ছিল না, অথচ এখন সেটাতেই অভ্যস্ত হতে হচ্ছে। কখনও কখনও মনে আশা জাগে, হয়তো রূপসা কোথাও তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। হয়তো কৃত্রিম রাগ দেখাবে কিম্বা হয়তো হেসে বলবে, " কী সম্পূরকবাবু খুব জব্দ হয়েছেন তো?" তখন সম্পূরক হাজারও অতৃপ্তির মাঝেও একটু হাসবে। মনের মাঝের জমানো অনুভূতিগুলো প্রকাশ করবে,দিনের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে যাবে। কিন্তু সে সৌভাগ্য অধরাই থেকে যায়। ভুল করেও অন্য কিছু ঘটে না।
মনের মধ্যে খটকা লাগে। অসীম কি রূপসার শুধুমাত্র বন্ধু, না আরও অন্য কিছু? সন্দেহ ক্রমশ গভীরতর হয়। রাস্তার পাশে চা দোকানে চা খায়। ভাবতে থাকে। কতকিছু। মনের কল্পনায় হতাশা জাগে, ক্ষোভ জমতে থাকে। কার ওপর? রূপসার ওপর, অসীমের উপর, নাকি নিজের ওপর? কেন এমন হয়? এতদিন তো ছিল না। হয়তো অসীম না এলে এই ঘটনা ঘটতই না। সেখান থেকে উঠে গিয়ে আবার হাঁটতে থাকে।একটি পরিচিত মুখ সামনে এসে যায়, -- মন্টির অংকের ম্যাডাম। মুখোমুখি হতেই সৌজন্য প্রকাশ, মুচকি হাসি। পেরিয়ে যেতেই সামনে দোকান, ফার্স্ট ফুডের স্টল। এইসব জায়গায় কম বয়সি ছেলেমেয়েদের ভিড়। বিকেল বা সন্ধ্যের দিকে এখানেই ভিড় ঠেলে পেরোনো যায় না। তর ওপর মোটর বাইকের হেডলাইটের তীব্র আলো চোখ ঝলসে দেয়। আর বেশিক্ষণ হাঁটতে না পেরে টোটোয় উঠে বসে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যায়।

🍂

হাত মুখ ধুয়ে সম্পূরক নিজের রুমে চলে যায়। যাবার আগে মাকে বলে," মা,আমার শরীর আজ খুব ক্লান্ত, আমি রেস্ট নিচ্ছি। খাওয়ার সময় ডেকে দেবে। " বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল ঘাটতে লাগল।
একটু পরে মা ঘরে ঢুকলেন। ছেলের পাশে বসে সস্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
" কিরে, ভালো লাগছে?"
" আর একটু বেশিক্ষণ হাত বোলালে আরও ভালো লাগবে।"
" ওরে, আমার দুষ্টু ছেলে রে! এবার তাহলে ছোট বৌমাকে নিয়ে আয়। মা আর কতদিন?"
" মা, ভালো হবে না বলছি।" মাকে জড়িয়ে ধরে ছেলে বলল, " তোমাকে ছাড়া আমি একদিনও বেঁচে থাকতে চাই না মা।"
" বালাই ষাট। তুই হাজার বছর পরমায়ু নিয়ে বেঁচে থাক বাবা। আমরা বুড়ো হয়েছি, আমাদের কাজ আর আয়ু দুটোই শেষের দিকে। তোর মাকে তুই চিরকাল কি ধরে রাখতে পারবি বাবা? পারবি না। থাক ঐসব কথা। তা, রূপসাকে বলেছিস, আমি যা বলতে বলেছিলাম। ও কী বলল? আমরা কি এরপর ওর বাবা মা'র সঙ্গে কথা বলতে পারি?"
" থাক না মা ওসব কথা। তুমি শুধু আমার পাশে বসে থাকো, আর মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।"
" কেন রে, তোদের মধ্যে কিছু গন্ডগোল হয়েছে? দ্যাখ, মায়েরা কিন্তু সব বুঝতে পারে। আমাকে বল, কী হয়েছে।"
"না মা তেমন কিছুই হয়নি।"
" আমাকে বলবি না তো?"
" মা, রূপসা আরও কিছুদিন সময় চেয়েছে।"
" ও মা! সে কী কথা? এই চার বছর ধরে এখনও সময় করতে পারল না। একদিন আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিবি তো, দেখি।"
" ঠিক আছে।"
বড় বৌমা বাইরে থেকে ডাক পাড়ল," রান্না হয়ে গেছে  মা। সবাইকে খেতে আসতে বলুন।"
" ঐ বড় বৌমা ডাকছে, চল্ খেতে চল্।" বলে সেখান থেকে বেরিয়ে স্বামীর ঘরে তাঁকে ডাকতে গেলেন।

ডিনার সেরে বেডরুমে ঢুকল সম্পূরক। এরপর ফোন করল রূপসাকে।
" কী করছো?"
" এই আর কি। কী আর করবো? টিভি দেখছি। তুমি কখন বাড়ি ফিরলে?"
" সাড়ে সাতটায়।"
" ওঃ"
সম্পূরক অনুভব করল রূপসার রিয়েকশন্। কোনও সহানুভূতি নেই। নিজে সাড়ে পাঁচটায় বাড়ি ফিরছে, অসীম অনেক ফ্যাসিলিটি দিচ্ছে যে। মনে মনে গজরাতে লাগল। মুখে বলল," অনেকদিন হলো,আমরা একসঙ্গে বাড়ি ফিরিনি। কাল একসঙ্গে বেরোলে হয় না?" সম্পূরক কথাটা বলে রূপসার কাছ থেকে সফ্ট রিপ্লাই এক্সপেক্ট করছিল। কিন্তু উত্তরটা অন্যভাবে এল," আমার কাজ হয়ে গেলে তোমার জন্য এক দেড় ঘণ্টা বসে থাকাটা কি ভালো দেখায়? ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করো।"
" তাহলে আমাদের আর একসঙ্গে কোনও দিনও ফেরা হবে না। শয়তান অসীমটাই সব শেষ করে দিল।" তারপর মরিয়া হয়ে সম্পূরক বলল," কাল কাজ থাকলেও আগে তোমার সঙ্গেই বেরবো। তুমি আমার সঙ্গে থাকবে তো?"
" ঠিক আছে, তাই হবে। "
আর কথা না বাড়িয়ে সম্পূরক ফোন রাখল।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments