জ্বলদর্চি

মোহিনীমোহন মণ্ডল (স্বাধীনতা সংগ্রামী, দাসপুর) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১১১
মোহিনীমোহন মণ্ডল (স্বাধীনতা সংগ্রামী, দাসপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

তিনি ছিলেন অকুতোভয় স্বাধীনতা সংগ্রামী। সেইসাথে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায় কমিউনিস্ট পার্টির সূচনাপর্বের অন্যতম একজন শহীদ। পুলিশের কঠিন এবং কড়া নজরদারি এড়িয়ে বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে দেশের কাজ করতেন। একাজ করতে গিয়ে ১৯৪২ সালে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর জেরে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু সেই মৃত্যুর পর সকলের অগোচরে নীরব চোখের জলে তাঁকে বিদায় দেওয়া হয়েছিল রাতের অন্ধকারে। সেদিন কংসাবতী নদীর পূর্ব তীরের পার্বতীপুরে বাঁশরী সানকীর বাঁশবনে তাঁকে গোপনে সমাহিত করে সেদিনে তাঁর সহকারী যোদ্ধারা। তিনি ঘাটাল এলাকার অন্যতম বিস্মৃতপ্রায় স্বাধীনতা সংগ্রামী মোহিনীমোহন মণ্ডল। 

দাসপুর থানার ব্রাহ্মণবসান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বলা যায়, পারিবারিক সূত্রেই মোহিনীমোহন আকৃষ্ট হন দেশসেবার কাজে। বাবা ছিলেন জমিদার কৃত্তিবাস মণ্ডল, যিনি ১৯০৩ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত ঘাটাল পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ফলে, পারিবারিক ভাবে তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের অন্তর্গত। মোহিনীমোহনের বড়দা ললিতমোহন মণ্ডল ছিলেন ৩ নং ইউনিয়ন বোর্ডের সভাপতি। তিনি তাঁর কাজের নিরিখে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। আর মেজদা কিশোরীমোহন মণ্ডল ছিলেন অতি পরিচিত গান্ধীবাদী নেতা। তাই তাঁকে এলাকাবাসী ডাকতো 'দাসপুরের গান্ধী' নামে। মোহিনীমোহন ছিলেন তৃতীয় সন্তান। চতুর্থ সন্তান তথা ছোটভাই মনমোহন মণ্ডল ছিলেন শিল্পী মানুষ। 

সোনাখালি হাইস্কুলে পড়াকালীন তিনি বিপ্লবী কাজকর্মে যুক্ত হয়ে পড়েন। সেইসময় লবণ আইন অমান্য আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। এজন্য ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। এই অপরাধে তাঁর ৬ মাস জেল হয়। ১৯২১ সালে জেলা জুড়ে যে অসহযোগ আন্দোলন চলছিল, সেখানেও তাঁর সদর্প উপস্থিতি ছিল। যেটুকু জানা যায়, তিনি মেদিনীপুর কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করেন।

মেদিনীপুরের কুখ্যাত জেলাশাসক বার্জ হত্যা মামলাতে তাঁর নাম যুক্ত হয়ে যায়। অভিযুক্তদের তালিকায় ছিলেন তিনিও। ১৯৩৩-এ বিচারাধীন বন্দী হিসেবে ৬ মাস ধরে মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় জেলে কাটাতে হয় তাঁকে। ফের ১৯৩৪ সালে BCLA ধারায় অভিযুক্ত হন তিনি। এজন্য মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে ৪ মাস এবং বক্সার ক্যাম্পে ৩ মাস বন্দী থাকতে হয়। ১৯৩৪-এর মাঝ বরাবর সময় থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত বহরমপুর ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন। এই বহরমপুর ক্যাম্প থেকে ১৯৩৭ এর ৮ ই জুলাই পাঠানো হয় ময়মনসিংহ জেলার একটি গ্রামে। সেখানে কয়েক মাস নজরবন্দী থাকার পর মুক্তি পান ঐ বছরের শেষ বরাবর। 

আন্দামান সেলুলার জেল ফেরৎ বন্দীদের মধ্যে কমিউনিস্ট কনসলিডেশনের মাধ্যমে তিনি মার্কসবাদের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হন। এরপরই তিনি ১৯৩৫ সাল থেকে নিজেকে মার্কসবাদী ভাবধারায় ব্যাপৃত রাখতে শুরু করেন। মার্কসবাদের প্রতি তাঁর ঝোঁক এবং ভাবনা বিকশিত হতে থাকে।

স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি তিনি কৃষকদের স্বার্থে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। ১৯৩৮ সালে মেদিনীপুরে সারা ভারত কিষাণ সভার জাগরণ ঘটে। তখন মোহিনীমোহন এই সংগঠনের অন্যতম নেতৃত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। গ্রামে গ্রামে কৃষিজীবী সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষায় কৃষি আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেকে ব্যাপৃত রাখতে শুরু করেন। কিন্তু এই সময় পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়।

কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সংগঠিত করার কাজে আরও আত্মনিয়োগ করতে শুরু করেন। গঠন করা হতে থাকে গ্রাম সমিতি গঠন। ১৯৪১ সালে কলোড়ায় খোলা হয় মার্কসবাদী পার্টি অফিস। সেসময় মোহিনীমোহন এবং মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর সকল কাজে পুলিশের কড়া নজরদারি ছিল। তবুও তিনি পুলিশকে বোকা বানিয়ে মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে দেশের সেবা করতেন।
🍂

Post a Comment

0 Comments