ভাঙা আয়নার মন
পর্ব -১১
মণিদীপা দাস কীর্তনীয়া
আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে...
বিয়ের পর এখানকার স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিল হেম।শ্বশুরবাড়ি গিয়ে কিছুদিন হোমিওপ্যাথি পড়ল। সেটাও ছেড়ে দিয়েছে জেনে মা খুবই ক্ষুদ্ধ। এখন অবশ্য ফুটফুটে মহুলকে কোলে করে এ বাড়ি এলে কাড়াকাড়ি পড়ে তাকে কোলে নেওয়ার জন্য।মা আহ্লাদ করে তাকে ডাকে শাদা খরগোশ।
মহুলের অন্নপ্রাশন হতে হতে শীত এসে গেল। আট মাস বয়স তার। ধুমধাম কিছু না বড়মাসি আর ছোট এসেছিল। রাঙা মেসো, ছোট মেসো আসতে পারেনি। বাপিও ছুটি পায়নি।
শুধু কালীবাড়ি পুজো দিয়ে এসে প্রসাদী ফুল মাথায় ছোঁওয়ালো মা। পায়েস রান্না করে ছোট্ট কাঁসার থালায় সাজিয়ে সামান্য মুখে দেওয়া হলো মহুলের আর দেখি তো আমার শাদা খরগোশ বলে ছোট্ট একটা কৌটোর বেগুনী কাগজ খুলে একটা সোনার হার মা ওর গলায় পরিয়ে দিল। থালায় রাখা টাকার চাইতে কলমটাকেই বেশি মজার খেলনা ভেবে খপ করে সে কলমটা তুলেই জে জে জে বলে ছুঁড়ে দিল উজ্জ্বল প্রদীপের দিকে।হেমের কাছ থেকে গয়নার বেগুনী কাগজ টুকরোটা ঝিনি চেয়ে নিল।চোখ ধাঁধিয়ে যায় এতো উজ্জ্বল ভায়োলেট রং কাগজটার।
নটা'র ফুল বা নাইনো ক্লক নামের ফুলগুলোর মতোই বেশিক্ষণ যেন তাকানোই যায় না ওদের দিকে।যে কৌটোয় লর্ডস লজেন্সের রাংতা জমায় তার মধ্যে ঝিনি কাগজটা রেখে দিল।
হারখানা আনার সময় পরিতোষ স্যাঁকরার দোকান থেকে সে এনেছে কয়েকটা কুঁচফল। খানিকটা লাল আর খানিকটা কালো কী চমৎকার মৌরি লজেন্স থেকে সামান্য বড় এই কুঁচফলগুলো কিন্তু খাও যদি ব্যাস! বাবা তাকে সাবধান করে দিয়েছে কুচ ফলের বীজ খুব নাকি বিষাক্ত।
ওরা রাখে কেন তা'লে?সব কিছুরই পুরোটাতো মন্দ হয় না ঝিনুক মা। যারা গয়নার ব্যবসা করে একটা ফল এক রতি এর'ম একটা হিসেবে এই কুচ দিয়ে ওরা সোনা ওজন করে। এর পাতা বা শেকড় দিয়ে কবিরাজি ওষুধ তৈরি হয়। তারপর হেসে খোলা গলায় বাপি বলে উঠল; "যারা নিত্য যেথায় ধেনু চরায় বংশীবটের তলে/যারা গুঞ্জা ফুলের মালা গেঁথে পরে,পরায় গলে ...
ওরে বিহান হল, জাগো রে ভাই’ ডাকে পরস্পরে
ওরে ওই-যে দধি-মন্থ-ধ্বনি উঠল ঘরে ঘরে
হেরো মাঠের পথে ধেনু চলে উড়িয়ে গো-খুর-রেণু,
হেরো আঙিনাতে ব্রজের বধূ দুগ্ধ দোহন করে।
'ওরে বিহান হল, জাগো রে ভাই’ ডাকে পরস্পরে"...এই কুচ ফুলই হলো সেই গুঞ্জা ফুল। কী সুন্দর ছড়াটা!তুমি বানালে বাপি?না বাবা এটা রবিঠাকুরের কবিতা।আর একটু বড় হলেই পড়বে।
🍂
গুঞ্জা !গুঞ্জা?সে আউড়ে নিলো চমৎকার ফুলের নামটা ।কুচফলও ঝিনি জমিয়ে রেখেছে তার কৌটোয়।
বড়মাসি ভোরবেলা স্নান করে সবার জন্য ভালো রান্না ও মহুলের পায়েস রাঁধছিল। বাড়ির ঠাকুরের পুজো দিচ্ছিল ছোট আর রুবিদি ঘসে মেজে ঝকঝকে করে তুলছিল ঘরদোর।
মহুলের জন্য পুজো দিতে মা'র সাথে ঝিনি চলল কালীবাড়ি।অনেক দিনের পুরনো সে মন্দিরের উঠোনে বিরাট এক কাঠ চাঁপা গাছ অজস্র ফুল ফুটিয়ে মাটিতে ছড়িয়ে দেয় রোজ। উঁচু সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উঠে যেতে হয়
মন্দিরের দোরে। মন্দিরের দেয়ালে ছাদে বট পাকুড় কতকালের শেকড় চারিয়ে দিয়েছে
লাল সিমেন্টের সিঁড়ির সব চে' ওপরের ধাপে কালো পাথরে খোদাই করে লেখা আছে দেবী বাংলা ৯৭৪ সনে ৺মহাদেব ব্রহ্মচারী সনে উপনীতা এবং ১২৯১সালে ৺মহেশ চন্দ্র চক্রবর্তীর পুত্র শ্রী তারিণী চরণ চক্রবর্তীর যত্নায়াশে পাষানময়ী হন।
লেখার মানে মাথায় ঢোকে না কিন্তু মাকে জিজ্ঞেস করলে গম্ভীর মুখে বলে বলে অনেক কালের পুরনো এই মন্দির আর তার চেয়েও প্রাচীন এই প্রতিমা এটুকু জানলেই হবে।মাকে আর কিছু জিজ্ঞেস না করে শুধু মা'র দেখাদেখি ওই লেখা ছুঁয়ে প্রণাম করে সে। মন্দিরের দুদিকের কাঠের জানলা তার লোহার শিকে মানতের অসংখ্য ঢিল বাঁধা। পেছনের দেওয়ালে বট পাকুড় শেকড়েও বাঁধা আছে ঢিল।ভেতরে আবছা অন্ধকার।
প্রতিবার যখন কোনো কোনো সকালে মা বলত স্কুল ছুটি আর আজ ভালো দিন,চ' ঝিনি কালীবাড়ি ডালি দিয়ে আসি। ডালি দেওয়া মানে তাদের পেতলের ফুল কাটা থালা তেঁতুল আর মাটি দিয়ে বেশ করে মেজে ধুয়ে ঝকঝকে করে নিতে হবে। স্নান করে ঝিনিকে বাগান থেকে কিছু জবা নয়নতারা,টগর এসব ফুল তুলে আনতে হবে।থালাটায় কয়েক মুঠো আতপ চাল রাখবে মা। তারপর ফুলগুলো আর একটা দুটো পাকা সবেদা বা আম,পেয়ারা জামরুল যে সময়ে যা ফল বাড়ির গাছের সেই ফল সাজিয়ে ঝিনিকে নিয়ে রওনা দেবে মা।হাটখোলা ছাড়িয়ে পাকা রাস্তা থেকে ডানদিকে কালীবাড়ি যাওয়ার মাটির রাস্তা চলে গেছে ঘন গাছপালার ভেতর দিয়ে।
বাজারে এসে মা কিনবে অল্প করে শুকনো সন্দেশ বা প্যাঁড়া,এক টাকার গুড়ের বাতাসা, এক টাকার নকুলদানা,একটা শসা, একটা আপেল আর দুটো কলা। বাড়ির কলা থাকলে কলা কিনতে লাগবে না। থালার ওপর একটা টাকা রাখতে হবে। তাকে বলে দক্ষিণা।
সব নিয়ে কালীবাড়ি পৌঁছে সিঁড়ি থেকে একটু দূরে চটি খুলে মা প্রথমে সিঁড়িতে হাত ছুঁয়ে প্রণাম করবে। তারপর উঠে গিয়ে মন্দিরের পুরুত ঠাকুরের হাতে থালাটা ধরিয়ে দিয়ে বারান্দার মেঝেতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করবে।ঠাকুরমশাই সব ফল ফুল মিষ্টি চাল আলাদা করে রেখে কুষিতে একটু করে চন্নামৃত হাতের কোষে দেবে ।সে জলে ফুল চন্দন আরও কী মেশানো এক গন্ধ।ঠোঁটে ছুঁয়ে মাথায় দিতে হয়। মন্দিরের ভেতরে বাতাসও ধুপ ধুনো ফুল আর বিমর্ষ অন্ধকার মিশে ভারী হয়ে আছে।
ঝিনির মনে হয় ওখানে সব কিছুই বড্ড ভারী আর অজানা ভয় মেশানো।পুজোয় বসার আগে অবধি পুরুত ঠাকুর, মন্দির থেকে কিছু দূরে শরিকদের ভিটের লোকজন কিংবা পুজো দিতে আসে যারা সবাই ওখানে ঢুকে চুপ করে বসে বা যেটুকু বলে নিচু গলায় যেন স্বাভাবিক গলায় কথাবার্তা বলাই কেউ বারণ করেছে ।
কত বচ্ছর ধরে ধুপ -গুগগুলের, চন্দন আর ধুনোর ধোঁয়ার সাথে ফুল ফলের গন্ধের সাথে, পিদিমের সামান্য আলোয় ইট খসা প্রাচীন দেউলে ভয় আর সুন্দর আলো-অন্ধকারের মতোই একসাথে জমাট বেঁধে আছে কে জানে। ভেতরে কষ্টি পাথরে গড়া প্রতিমা প্রদীপের মিটমিটে আঁধারে মিশে আছে একইভাবে। খাঁড়া হাতে ঠাকুরের দিকে তাকাতে ভয় করে তার এমনকি লাল সুতোয় বাঁধা মানতের ঢেলাগুলোর দিকেও সে ভয়ে ভয়ে তাকায়।কারা বেঁধেছে মনস্কামনার এতো পাথর?ওসব বাঁধলেই ঠিক হয় যায় অসুখ বিসুখ?আর যদি ইচ্ছেরা ভুল হয়ে যায় তাহলে কী হয় তখন?আসা ইস্তক এইসব জিজ্ঞাসার ভয় তাকে পেড়ে ফেলে।
নিরানন্দ কী এক নির্জন ওৎ পেতে থাকে ওখানে।সামান্য কিছুতেই অপরাধ ঘটে যেতে পারে আর তাহলেই রুষ্ট হবে সব,কারও অসন্তোষের কোপে পড়ে সে যেতে পারে সেই সব অনিশ্চয়তার সম্ভাবনায় ধুকপুক বুক নিয়ে মার সঙ্গে ওখানে গিয়ে দাঁড়ায় সে।
পুজোর জন্য কখনো তাদের বসতে হয়।শরিকের পুজো। মন্দিরের কিছু দূরে তাদের আলাদা আলাদা ভিটেবাড়ি।যাদের যখন পালা তাদের কেউ এসে ভারি তালা চাবি আর ঝনাৎ করে দোরের শেকল খুলে ভেতরের প্রদীপ জ্বেলে দেয়। থালা নিয়ে ভেতরে রেখে অপেক্ষা করতে বলে। সিঁড়ির ধাপিতে মা বসে আর সে মন্দির চত্বরের কাঠচাঁপা কুড়োয়।
উঠোনে ছড়ানো এই কাঠ চাঁপা ফুলগুলোই কেবল পরিচিত জগতের সঙ্গে তার যোগাযোগ করে দেয়। হাতে নিয়ে দেখলেই মসৃণ শাদা পাপড়ির মাঝে ডিমের কুসুমের মতো নরম হলুদ রং আর সুগন্ধে ঝমঝম হেসে ওঠে যেন।যত পারে সে ফুল কুড়োয়।ফ্রকের কোচোড় ভরে ওঠে যত ভয় কেটে আনন্দ লাগে। ইলিক চিলিক ল্যাজ নাচিয়ে কিসের বীজ মুখে মস্ত ডালে তরতরিয়ে উঠে যাচ্ছে কাঠবেড়ালি। গাছের খোঁদলে খাবার জমাচ্ছে ওরা। একটা হুপো পাখি মাথার ঝুঁটি খুলে উঁচু ডালে বসে আছে। বাবা বলে চমৎকার এই ঝুঁটির জন্যই নাকি ওর নাম মোহন চূড়া।এইএসব দেখতে দেখতেই প্রসাদ নিয়ে মাও নেমে আসে।
সেবার বসিরহাটের টাউন ক্লাবের মাঠে দ্য গ্রেট অরিয়েন্টাল সার্কাস এসেছিল। মহুলের মুখেভাত মিটে গেলে বিকেলে মা'র সাথে তারা তিন ভাইবোন ,রুবিদি আর ছোট মিলে সার্কাস দেখতে চলল।মহুলকে কোলে নিয়ে হেমও গেল সাথে। বড়মাসি বাড়ি তেই রয়ে গেল।
জ্যান্ত বাঘ হাতি সামনে দেখতে পেয়েই তারা অবাক। তিনটে হাতি আবার নারকেল ফাটিয়ে, ঘন্টা নেড়ে প্রদীপ ঘুরিয়ে পেছনের পায়ে বসে শুঁড় তুলে নমস্কার করে পুজো করল। আগুনের রিঙ লাফিয়ে পার হলো বাঘ।একছড়ি কলা খাইয়ে জলহস্তীর বিরাট মুখে মাথা ঢুকিয়ে দিল পরির মতো সুন্দর এক মেয়ে।আরো ঝলমলে পরিদের ট্রাপিজের খেলা দেখে শিউরে শিউরে উঠল তারা সবাই।
রণ পা লাগানো লম্বা জোকার থেকে থেকেই টমেটো নাক লাগানো ছোট্ট জোকারকে হ্যাল্লো মিস্টার টমেটো বলে ডাকছিল আর বামন তাকে ফাটা ব্যাটে ধাই করে মেরেই ডিগবাজি দিয়ে ধাঁ। দেখে অবধি আর সব ছোটদের সঙ্গে মিলে খিলখিল হাসছিল তারা।বিরাট আ্যরেনা, তাঁবু ঘিরে ঝিকমিক টুনি বাল্ব ,ঝকমকে পোশাকের ব্যালেন্স বার সবকিছুতেই মুগ্ধ হতবাক খেলা শেষে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল।সবার সাথে।মাঠে খুব ভিড়।নানা দোকান পসরাও ।একটা দোকানে দাঁড়িয়ে তারা ক্যাম্পাকোলা নামে বোতলের শরবত খাচ্ছিল। কমলা রঙের বরফ ঠান্ডা মিষ্টি সোডা ওয়াটারের প্রথম ঝাঁঝালো স্বাদে মুখ সরিয়ে নেয় পরক্ষণেই স্ট্র চেপে ধরে ঠোঁটে। ঝলমলে মুখ দাদারা হাসছিল ফুর্তিতে, বিস্ময়কর সেই অভিজ্ঞতায় বুঁদ হয়েছিল ঝিনি। হঠাৎ চিল চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল মহুল।
ওই ওই লোকটা বলে আর্তনাদ করে উঠলো হেম হার নিল হার নিল বলে মহুলকে আঁকড়ে হেম চেঁচাচ্ছিল ।কারা যেন দৌড়ে গেল ধর ধর বলে।
মা মহুলের জামার বোতাম খুলে আগে ভালো করে দেখল গলায় দাগ বসে গেছে কিনা।একটা মিষ্টির দোকানের বেঞ্চে বসিয়ে হেমকে বলল ওকে মাম খাওয়া ওর ঢোক গিলতে লাগছে কিনা দেখি বলে সেজোকে আড়াল করে দাঁড়ালো। ভাই চুপ করে গেল। শুধু ভাইকে কোলে হেম কেঁদেই যাচ্ছিল। চুপ কর সেজো।মা'র খসখসে স্বরে একটু থামল। শুকনো মুখে সবাই দাঁড়িয়ে।
সার্কাসের মেয়েদের ঝিকমিক জামায় অসম্ভব সব কসরতের ম্যাজিক একটু আগের রঙিন টলটলে পানীয়ের স্বাদ মুছে গেছে অতর্কিত ঘটনায়। ফ্যাকাশে কাগজের মতো মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরল তারা।
বড়মাসি সব শুনেই বলিহারি কই তগো।হাউস দেইখ্যা বাঁচি না।এইডুক পোলারে সার্কেস দ্যাখাইতে লইয়া গেছিস আবার বাহার দিয়া সুনার হার পিন্দাইয়া লামছিস।ভাইগ্য গলাখান কাইটা লামে নাই।থো ফালাইয়া তগো গা জ্বালাইন্যা কাইন্দন। কাপড় ছাইড়্যা অরে খাওয়াইয়া ল।
ভাইয়ের ফর্সা গলায় দাগ নেই অবশ্য।মা ডাক্তার জেঠুকে তাও একবার দেখিয়েই এনেছে ।জামার ওপর দিয়ে টান দিয়েছে বলেই গলায় সরাসরি লাগেনি। কিংবা হারের এসটা ভালো লাগানো ছিল না।টান দিতেই খুলে গেছে ভাগ্যিস।তা না হলে কী হতো? মোটাসোটা থপাথপে হলেও এতটুকু বাচ্চা যে ভাই।পেট ভরে খেয়ে অবশ্য আরাম করে ঘুমিয়ে পড়ল মহুল।
বড় মাসির দুই মেয়েই মায়ের চাইতে বয়সে বড়।নাম যতই মিষ্টি হোক অল্প বয়সে বিধবা হয়ে দুই মেয়েকে মানুষ করে আর কঠোর বৈধব্যর উপোস টুপোস করে মধুমালা দারুন তেজস্বিনী আর খরখরে হয়ে গেছেন।থাকেন ছোট মেয়ের সঙ্গে বনগাঁয়। জামাই কাস্টমসের বড় অফিসার। তাতে কী ও বাড়িতে সংসারের চাকা বড় মাসির কথাতেই ঘোরে।
রাতে ঘুম ভেঙে ঝিনি শুনল বড় মাসি মাকে বলছে কাইলই এই পুঁতি কয়খান লইয়া স্যাকরারে দিয়া আইবি।হেয়া দিয়া হেমের পোলাডার সরু একখান চেইন হইয়া যাইব।বড়দি আমি ওকে আবার বানিয়ে দেব। বছরখানেক সময় লাগবে। অরুর বাবার সঙ্গে একবার কথা বলি। বুইঝা শুইনা কথা কইবি।কচি পোলা লইয়া বাজন দ্যাখতে গিয়া এই ঘডনা ঘডছে হুইন্যা আমাগো বিবেচনা লইয়া পাঁচ কথা কইবে না হেমের হউর বাড়ি?কাওরে কওন লাগব না।জামাইগো তো কইবাই না।হেমের হউর বাড়ি জিগাইবো না পোলারে দিছে কী? কইবা কী তহন?
কিন্তু তোমার তুলসির মালায় গাঁথা সোনার পুঁতি আমি নিতে পারব না বড়দি।মায় দিছিলো তোমারে।
আ্যতডি পোলাপান লইয়া ফাল দিয়া গেছিলা ক্যান তয়?চুপ মাইরা থাহো।বাইচ্যা আছি মুই।বড়ো বুইনের হামনে মুক লামাইয়া কতা কইবা।
তারপর একটু নরম সুরে বলল,ছোডো হইয়াও দুই বুইনের লাইগ্যা সাইধ্যের অতিরিক্ত করছস তুই।অগো ল্যহাপড়া বিয়া কম তো দ্যাহোস নাই।তর দেওয়া হারখান তো চোরে লইয়া গ্যাছে অহন মুই দিমু। তুলসির মালার সোনার পুঁতি কয়খান লইয়া যদি কামডা হারতে পারো সেইডা দ্যাখো গিয়া।মুইতো চিতায় পা লামাইয়া দিছি। অহন পুঁতি দিয়া হইব ডা কী?
বড়মাসি পা টেনে টেনে মাঝের ঘরের তক্তোপোষে ফিরে যায়। হ্যারিকেনের আলো কমিয়ে দিয়ে মাও শুয়ে পড়ল আবার।
আধো ঘুমে কী তবে নিবে যায় বারবার? কী জ্বলে ওঠে আধো জাগরে?এ ঘরের হ্যারিকেন, মায়ের শুকনো মুখ,মন্দিরের তেলভর্তি পেতলের প্রদীপ নাকি ফিকে রঙ কাঠ চাঁপা ফুলেরা?অনিশ্চিত ভয় আর নানা চমৎকারের মধ্যে ঝিনুক জেগে ওঠে; আবার ঘুমিয়েও পড়ে শুধু জানে না ঘুমের চারপাশে তাকে ঘিরে থাকে মমতার এক আশ্চর্য ভুবন যাকে বুঝতে আর সকলের মতোই কেটে যাবে জীবন অগাধ। অনেক সকাল দুপুর বিকেলের মধ্যে কোন মুহূর্তে মস্ত হয়ে উঠবে আকাশ চোখ তুলে তাকালেই পুরনো নক্ষত্রের তাপ লাগবে গায়ে যেন পিদিমের তাপ হাতের তালুতে নিয়ে ছুঁয়ে দেবে কাছের মানুষ।
মরা তারা চুঁইয়ে আসা আলো হয়ে ঠিক সেই অপাপ দিনের প্রিয় সব মানুষের ভালবাসা ঘিরে নেবে আবার।বিশ্বাস আর ভরসার নিবিড় গভীর আয়নার মতো টের পেয়ে যাবে সে আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে...
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
0 Comments