তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব
৩৯তম পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
শ্রীকৃষ্ণের মর্ত্যধাম ত্যাগের সাথে সাথেই কিন্তু এই আখ্যান শেষ হলো না। কারণ তখনো পর্যন্ত দ্বাপর যুগ শেষ হয়নি। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং সর্বোপরি একান্ত সুহৃদ, অভিভাবক শ্রীকৃষ্ণের দেহত্যাগের শোকে হস্তিনাপুরে পান্ডবদের আর ভালো লাগছিল না। যুধিষ্ঠিরের পরামর্শে পঞ্চপান্ডব সিদ্ধান্ত নিলেন রাজ্য শাসনের ভার অভিমন্যুর পুত্র পরীক্ষিতের হাতে সমর্পণ করে তাঁরা মহাপ্রস্থানে যাবেন। দ্রৌপদীও এই মহাপ্রস্থানের পথে তাঁদের সাথে যাবার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে সিদ্ধান্ত নিলেন। পঞ্চভ্রাতা বিভিন্নভাবে দ্রৌপদীকে সেই বিপদ সংকুল পথের কথা বলে নিরস্ত করতে চাইলেন, কিন্তু দ্রৌপদী নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেন। অগত্যা তিনিও মহাপ্রস্থানের পথে চললেন।
পরীক্ষিতের হাতে রাজ্যভার দিয়ে স্বর্গপথে রওনা হলেন। পূর্বমুখে তাঁরা অগ্রসর হলে অগ্নিদেব এসে পথ রোধ করে কিছু খাদ্য চাইলে অর্জুন তাঁর গান্ডীব ধনুসহ সব দিব্য অস্ত্র অগ্নিকে প্রত্যর্পন করলেন। একটি কুকুর তাদের সঙ্গ নিলো সেখান থেকে। সবাই হিমালয় পথ ধরে এগিয়ে চললেন কিন্তু কেউ দেখলেন না এক কুকুর তাদের সাথী হয়ে পিছনে চলছে।
তারপর কত বন, কত পর্ব্বত, কত নদী অতিক্রম করে মেঘনাদ পর্ব্বতে গেলেন। সেখানে দানবদের যুদ্ধে পরাস্ত করে তাঁরা কেদার পর্ব্বতে আরোহন করলেন। এবার উত্তরমুখে রওনা হলে পথে এক ভীষণা রাক্ষসী তাঁদের পথ আটকালে ভীম অবলীলাক্রমে রাক্ষসীকে নিপাত করেন।
🍂
এবার পান্ডবরা ভদ্রকালী পর্ব্বতে এলে এখানকার কালীমূর্ত্তি ভদ্রকালী যুধিষ্ঠিরকে বর প্রার্থনা করতে বললে যুধিষ্ঠির জোড়হাতে কালীর নিকট কলিকালে জাগ্রত থাকার বর চাইলে মা কালী বললেন তথাস্ত্ত।
এরপর তাঁরা হরিপর্ব্বতে এলে এখানকার হিমশীতলতায় দ্রৌপদী কিছুক্ষণের মধ্যেই দেহত্যাগ করলেন। ভীম ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করলেন কোন পাপে দ্রৌপদীর মৃত্যু হলো। ধর্মরাজ বললেন, পঞ্চ স্বামীর মধ্যে অর্জুনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বেশি থাকার পাপে দ্রৌপদীর মৃত্যু হলো।
আবার শুরু হলো পথচলা। বদরিকাশ্রমে গিয়ে তাঁরা দেখা পেলেন দ্রোনপুত্র অমর অশ্বত্থামার। সেখানে কিছুকাল বিশ্রামের পর সহদেবের মৃত্যু হলো। ভীমের প্রশ্নে যুধিষ্ঠির বললেন, জ্যোতিষীরূপে ভাই সহদেবের ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান সবই জানা ছিল। পাশা খেলায় আমার হার হবে জেনেও সে আমাকে সাবধান করে নি। বারণাবতে আমাদের পুড়িয়ে মারা হবে জেনেও আমাদের সতর্ক করে দেয়নি — এই তার পাপ।
এরপর তাঁরা এলেন চন্দ্রকালী পর্ব্বতে। এখানে নকুলের মৃত্যু হলো। ভীমের প্রশ্নে যুধিষ্ঠির বললেন — কর্ণের সঙ্গে যখন আমার যুদ্ধ হয় তখন নকুল আমার কাছে ছিল। কিন্তু আমি যুদ্ধ করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম দেখেও আমার সাহায্যে অগ্রসর হয় নি। এই ছিল তার পাপ।
পরবর্তী বিশ্রামস্হল নন্দীঘোষ পর্ব্বতে অর্জুন তনুত্যাগ করলেন। ভীমের প্রশ্নে যুধিষ্ঠির বললেন — অর্জুনের পাপ হলো — সে আমার চেয়ে বেশি ভালবাসতো দ্রৌপদীকে আর সব কিছুকে সে হেয় জ্ঞান করতো।
চলতে চলতে এরপর সোমেশ্বর পর্ব্বতে মৃত্যুবরণ করেন ভীমসেন। হাহাকার করে বিলাপ করতে লাগলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। এক এক করে স্মরণ করতে লাগলেন ভীমের বীরত্ব কাহিনী। তারপর তাঁর মনে হলো ভীম কোন পাপে মারা গেলো। অমনি ধর্মরাজের মনে পড়লো, —পৃথিবীর যাবতীয় খাদ্যবস্তর উপর প্রচন্ড লোভ ছিল তার। ভক্ষ্যদ্রব্য দেখলে সে আর স্হির থাকতে পারতো না। লোভই হলো তার মৃত্যুর কারন।
এবার ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির একা ধীরে ধীরে স্বর্গের পথে অগ্রসর হতে লাগলেন আর পিছনে ছিল তার অনুগামী সেই কুকুর। গন্ধর্ব পর্ব্বত আরোহণের সময় হিমালয়বাসী মুনি ঋষিগন এক এক করে দেখা করতে আসলে তিনি প্রত্যেককে প্রণাম করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন।
এইভাবে চলতে চলতে স্বর্গের দ্বারদেশে উপনীত হলেন। দ্বারপাল দেবরাজ ইন্দ্রকে সংবাদ দিলে ইন্দ্র রথ নিয়ে চলে আসেন। কিন্তু দেবরাজের ইচ্ছা হলো ধর্মরাজকে একবার পরীক্ষা করতে। তাই তিনি এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মনের রূপে যুধিষ্ঠিরের সম্মুখে উপস্থিত হলেন।
বৃদ্ধ ব্রাহ্মনের রূপে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র যুধিষ্ঠিরকে তার পিছনের কুকুরটিকে দেখিয়ে বলল, যুধিষ্ঠির ঐ কুকুরটিকে ত্যাগ করে তুমি স্বর্গে প্রবেশ করতে কিন্তু তিনি কুকুরকে কিছুতেই প্রবেশ করতে দেবেন না। তখন যুধিষ্ঠির করজোড়ে বললেন, এই অবলা জীবটি আমার মতনই কষ্ট করে এই স্বর্গের দ্বারে পৌঁছিয়েছে। তাই হয় আমাদের দুজনকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হোক। নয়তো আমরা এইখানেই থাকবো।
তখন সেই কুকুর নিজমুর্তি ধারণ করেন, তিনি ছিলেন ধর্ম। তিনি বললেন হে যুধিষ্ঠির। আপনি সত্যই ধর্মের এক রূপ। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তৎক্ষণাৎ লুটিয়ে পড়লেন তাঁর চরণে। ধর্ম বললেন, বৎস তুমি আমার পুত্র। আমার ঔরসে কুন্তীর গর্ভে তোমার জন্ম।
ধর্ম পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধ ব্রাহ্মনের দিকে চেয়ে বললেন, ইনি দেবরাজ ইন্দ্র। ইনি রথ নিয়ে এসেছেন তোমাকে স্বর্গে নিয়ে যাবার জন্য। পদব্রজে অনেক ক্লেশ সহ্য করেছ পুত্র। এবার রথে আরোহণ কর। দেবরাজের ইঙ্গিতে সারথী রথ নিয়ে এলে সকলে তাতে আরোহণ করে স্বর্গাভিমুখে অগ্রসর হলেন। স্বর্গপুরে বিরাট সম্বর্ধনার মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে স্বাগত জানানো হলো।
দুজনে মিলে যখন স্বর্গে প্রবেশ করলেন যুধিষ্ঠির দেখলেন যে সেইখানে কৌরবরা রয়েছেন। কিন্তু পাণ্ডবদের তিনি দেখতে পেলেন না। তাঁরা কোথায় তা জানতে চাইলে যমরাজ বললেন তাঁরা সবাই নরকে। যুধিষ্ঠির অবাক হয়ে জানতে চাইলেন কৌরব স্বর্গে আর পাণ্ডবরা নরকে কেন? যম জবাব দিলেন যে কুরুক্ষেত্রের পুণ্যভূমিতে সত্যিকারের ক্ষত্রিয়ের মতন প্রাণ বিসর্জন দিয়ে কৌরবদের অক্ষয় স্বর্গলাভ হয়েছে। যুধিষ্ঠির আকুল হয়ে নিজ প্রিয়জনকে দেখতে চাইলেন। যম বললেন তবে চলুন।
তাঁরা নরকে এসে পৌঁছতে যুধিষ্ঠির নরক দর্শন করে শিউরে উঠলেন। অর্ধগলিত সব, পুঁতিগন্ধ, ঘোর অন্ধকার, শৃগাল আর ভয়ানক প্রাণী প্রেতাত্মাদের কামড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। কাউকে গরম তেলে ভাজা হচ্ছে। কাউকে শূলে চড়ানো হয়েছে। শূলবিদ্ধ অবস্থায় তাঁরা হাহাকার করে কাঁদছে।
প্রেতদের এই দুরবস্থা দেখে যুধিষ্ঠির আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি ফেরত যেতে চাইলে অনেকগুলি আওয়াজ ভেসে এলো - হে মহারাজ ! দয়া করে কিছুক্ষন দাঁড়ান। আপনার গা থেকে আসা সুগন্ধ আমাদের তৃপ্তি দিচ্ছে। আমরা নরক যন্ত্রণার মধ্যে একটু শান্তি পাচ্ছি। যুধিষ্ঠির জিজ্ঞেস করলেন - কিন্তু আপনারা কে ? সেই অন্ধকার থেকে ভেসে এলো ! "আমি কুন্তী ! আমি ভীম ! আমি অর্জুন ! আমি কর্ণ ! আমি পাঞ্চালি ! আমি ভীষ্ম ! আমি ধৃতরাষ্ট্র !"
যুধিষ্ঠির বিস্ফোরিত নেত্রে দেখলেন পাঞ্চালির জিভ দুইটি ইঁদুর অল্প অল্প করে খাচ্ছে, যম বললেন "পাঞ্চালি দুর্যোধনকে অন্ধপুত্র বলে অপমান করেছিলেন ! এটি শুধু দুর্যোধনের নয়, বরং ধৃতরাষ্ট্রেরও অপমান ! এটি তারই পরিণতি।"
তারপর হতবাক হয়ে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে দেখলেন জ্বলন্ত কয়লার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে ও যন্ত্রনায় চিৎকার করতে। যম বললেন - "খাণ্ডব বন জ্বালাবার সময় বহু নিরীহ প্রাণী অর্জুন হত্যা করেছিলেন, এটি তার শাস্তি !"
স্তব্ধ হয়ে যুধিষ্ঠির দেখলেন, ভীমসেন কে - তার হাত এবং পা দুইজন অতি ভয়ঙ্কর যমদূত মুচড়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে। "প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্ষমতা দেখতে গিয়ে ভীম নিষ্ঠুর হয়ে শত্রুহত্যা করতেন, এটি তার শাস্তি !" তারপর তিনি যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞেস করলেন। "বাকীদের দেখতে চাও" ?
পরবর্তী অংশ ৪০তম পর্বে..............
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
0 Comments