উদয়ের পথে
বিংশতি পর্ব
মলয় সরকার
আমরা এসে পৌঁছালাম নারাতে।এই সেই নারা যেখানে ৮ই জুলাই ২০২২ এ Tetsuya Yamagami নামে এক ব্যক্তি তৎকালীন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে , ঘরে তৈরী দেশীয় বন্দুক দিয়ে , প্রচারকার্য চলা কালীন হত্যা করে।
আমরা স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে, কাছেই , হেঁটে একটু উঁচুতে Kōfuku-ji মন্দিরে পৌঁছালাম।যদিও এটির প্রাথমিক সুত্রপাত ৬৬৯ সালে, তবু তারপর বহুবার এটি ধ্বংস, আগুনে পুড়ে যাওয়া, স্থানান্তরিত ইত্যাদি হয়ে শেষ বারের মত কাজ শেষ হয়েছে ২০১৮ সালে ।
এখানে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, প্রায় সবাই , অন্ততঃ শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ মুখে মুখোস পরে। তবে না পরলে যে কেউ কিছু বলবে এমন নয়।আর সবাই অসম্ভব নিয়মনিষ্ঠ। জানিনা , একে রবীন্দ্রনাথ ভাল বলতেন না ,তাসের দেশের মত যান্ত্রিক বলতেন। তবে আমার ধারণায় ওরা দুটোকেই একসাথে মিশিয়ে তার এক নতুন সুন্দর রূপ দিয়েছে।
আলস্যের বাবুয়ানীর পায়রা ওড়ানো বাইজী গানের চর্চা বা পট পাঁচালীর চর্চা নয়, আবার আরব দুনিয়ার মত কট্টরও নয়।দুয়ের মিশ্রণে যে সৌন্দর্য হয় তারই সাধনা করেছে এরা। জানে, কি করে নিজের আত্মশক্তিকে জাগ্রত করতে হয়, জানে কি করে সমাহিত হয়ে সুন্দরের ধ্যান করতে হয়। তাই এদের চিত্র বা আর্টে একটা হাল্কা সৌন্দর্যের ছোঁয়া, যেন হাল্কা মেঘের এক ওড়নার আবরণের ছোঁয়ানো সৌন্দর্য।এদের ধর্মবোধ বা জীবনচর্চাতেও পাওয়া যাবে এই সৌন্দর্যের ছোঁয়া।
তাই এখানে জন্মান, কেবলমাত্র হারুকি মুরাকামি নয় , দুজন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত সাহিত্যিক ইউসুনারি কাওয়াবাতা এবং কেঞ্জাবুরো ও। বর্তমানের সাহিত্যিক নাটসুকো ইমামুরা কিংবা আকিরা ওতানিরাও যথেষ্ট কৃতী।
মন্দিরের সামনে প্রথানুযায়ী রয়েছে পাঁচতলা টাওয়ার
যাক, আমরা টিকিট কেটে ঢুকলাম মন্দিরে। অনেকখানাই ফাঁকা জায়গা নিয়ে ঘেরা এই মন্দির চত্বর। তার মধ্যে মূল মন্দির( Tokondo)একটু ভিতরে , যার ভিতরে রয়েছে বড় এক বুদ্ধের মূর্তি।সেটি আবার ঘেরা রয়েছে কাঠের এক বাউণ্ডারী দিয়ে। বাকী চত্বরটিতে দূরে দূরে সব নানা হল রয়েছে ছড়ানো ছিটানো।মাটিতে রয়েছে সুন্দর পাথর ছড়ানো।তাতে অবশ্য একটি পাতা বা কাগজের টুকরোও প্ড়ে নেই। সামনেই রয়েছে একটি পাঁচতলা টাওয়ার। এই টাওয়ার জাপানে প্রায় অনেক বুদ্ধমন্দিরের একটা অঙ্গ।আগেই বলেছি, এই পাঁচতলার কি অর্থ।
এ ছাড়া রয়েছে বেশ কয়েকটি হল। তবে এখানে সব জায়গাতেই আমার কিন্তু মন্দিরগুলির ঢং, গঠনশৈলী সব একই রকম লাগছে। হয়ত সেটা আমার বিবেচনার বা দেখার চোখের ভুল। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা ভাল বলতে পারবেন।
এখানে রয়েছে,East Golden Hall (Tō-kondō),Central Golden Hall (, Chū-kondō), Central Golden Hall building , এখন Lecture Hall, হিসাবে ব্যবহার হয়,Five-storied pagoda ( Gojū-no-tō),Three-storied pagoda ( Sanjū-no-tō), North Octagonal Hall ( Hoku'endō), South Octagonal Hall ( Nan'endō), Bath House (Ōyūya) ইত্যাদি।
তবে যে কোন কারণেই হোক, আমরা কোন মন্দিরের ভিতরেই ঢুকে দর্শন পাই নি। সে যাক, বাইরেটা বা পরিবেশই আমার মন ভরিয়ে দিয়েছে।
এ ছাড়া রয়েছে সেই স্বাভাবিক জিনিস, যা না থাকলে এদের চলে না,তা হল বাগান। একটি সুন্দর চেরী গাছ রয়েছে সামনেই। কি যে ফুলে ফুলে ভরা বলে বোঝাতে পারব না। আর তার ফলে সমস্ত পর্যটকরাই, বিশেষ করে তরুণ তরুণীরা সেই ফুলের সামনেই ছবি তুলছে।
মন্দির চত্বরে চেরী গাছের নীচে তরুণতরুণীরা
তবে এখানে একটা জিনিস দেখলাম না, তা হল যেমন প্যারিসের রেল প্লাটফর্মে বা পার্কে দেখেছি,ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় এ দৃশ্যের ছড়াছড়ি ,তরুণ তরুণীর অন্তরঙ্গ প্রকাশ্য উদ্দাম আলিঙ্গন। এখানে তরুণ তরুণীরা প্রেম অবশ্যই করছে, তা কিন্তু অনেক জায়গাতেই দেখলাম, আমাদের সত্যজিত রায়ের সিনেমার মত অর্থাৎ মেয়েরা মাথা নীচু করে পায়ের নখের দিকে চেয়ে রয়েছে কিংবা লজ্জা লজ্জা ভঙ্গীতে তাকাচ্ছে। হয়ত এটাই সব জায়গার দৃশ্য নয়, বা আমি সব দেখি নি। তবে এটা অনেক জায়গাতেই চোখে পড়েছে যে প্রেমের উদ্দামতার বহিঃপ্রকাশ এখানে নেই।
এখান থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম এক জায়গায়, যা আমরা ভুলবনা কোন দিন।তা হল নারা ডিয়ার পার্ক।এই নারা পার্ক অনেকগুলি বিশেষ মন্দির ও দর্শনীয় জিনিসের মাঝে অবস্থিত।যেগুলি হল, Todaiji, Kasuga Taisha, Kofukuji , Nara National Museum. এ ছাড়া রয়েছে প্রায় এক হাজার স্বাধীনভাবে চরা হরিণের বাসস্থান।
🍂
এই পার্কটি আসলে কোনো ঘেরা জায়গা নয়, একদিকে বাস রাস্তা,আর একদিকে মন্দিরের দেওয়াল।আর বাকী দিকে বাঁধানো হাঁটার বা গাড়ী চলার রাস্তা। এক একটি জমির প্লটের মাঝে রাস্তা আবার একটি ফাঁকা জমির প্লট।এইভাবে একটি বিস্তৃত জায়গা , যার মাঝে মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু গাছ।আর তার মাঝে চরে বেড়াচ্ছে ,খাচ্ছে, বসে আছে ইতস্ততঃ বহু হরিণ।আমরা দেখে আশ্চর্য। এর আগে যত হরিণ দেখেছি, সবই হয় বনের ভিতরে বা না হয় ঘেরার মধ্যে, যাকে দূর থেকে দেখতে হয়।
এই হরিণগুলিকে ওরা ভগবানের প্রতিভূ বলে মনে করে ও এদের স্বাধীনতায় কোনো বাধা দেওয়া নিষেধ। পাশেই বিক্রী হচ্ছে কিছু ক্র্যাকার জাতীয় খাবার , যা হরিণ খেতে খুব ভালবাসে। বহু মানুষ কিনে খাওয়াচ্ছেন, শিশুরাও খাওয়াচ্ছে। সাধারণতঃ হরিণগুলি খুব শান্ত, আদর খায় , কাছে আসে, মানুষের গায়ে গা ঘেঁসে দাঁড়ায়। তবে যদি বোঝে কেউ খাওয়াবে, ওরা তার কাছে এগিয়ে আসে।তবে কেউ ওদের রাগালে, ওরা আক্রমণও করতে পারে।তাই সাধারণতঃ তা করা উচিত নয়।তবে বহু দিনের অভ্যাসে ওরা অনেকেই মানুষের কাছে প্রণামের ভঙ্গী করতে শিখে গেছে এবং ওরা সেভাবে মাথা নীচু করে প্রণাম করে খাবার চায়।আমি ব্যাপারটা প্রথমে বিশ্বাস করি নি।পরে নিজের চোখে দেখে আশ্চর্য হয়ে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি।
এদের খাদ্যাভ্যাসের বিচারে , দু শ্রেণিতে ভাগ করা হয়, "Park deer," যারা পার্কের সমতল অংশে থাকে আর "Mount Wakakusa deer." যারা একটু উঁচু স্থানে থাকে। তবে উভয়ের প্রধান খাদ্যই ঘাস। এদের শিং প্রায় নেই.।তবে কিছু হরিণের বড় শিঙও রয়েছে।এরা এতই যত্নের ও আদরের যে, এদের হত্যা অমার্জনীয় অপরাধ। তার জন্য মৃত্যুদণ্ড পর্যন্তও হতে পারে।এরা জাপানের একরকম প্রতীক বলা যায়। বলা হয় এরা এখানে এইভাবে প্রায় এক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে (৭১৬ সাল থেকে) রয়েছে।এরা স্বচ্ছন্দে রাস্তা ঘাট বাস মোটর বাঁচিয়ে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথাও কোন বাধা বাঁধন নেই এদের জন্য।যেহেতু বলা হয় এরা শিন্টো দেবতার বাহন বা প্রতীক, এরা দেবস্থানেও যথেচ্ছ ঘুরে বেড়ায় বাধাহীন ভাবে।
অনেকদিন আগে একবার দেখেছিলাম বারাণসীর মন্দিরে স্বাধীন ভাবে বিচরণ করা ষাঁড়েদের ঘুরে বেড়াতে।কেউ বাধা দিতে নাকি পারবে না, কারণ ওই একই, বাবা মহাদেবের বাহন বলে কথা!
যাই হোক আমরাও এদের সঙ্গে অনেক সময় কাটালাম বেশ মজায়। এবার দেখলাম, কাছেই রয়েছে , হাঁটাপথে মিউজিয়াম ও তোদাইজির মন্দির।
হাঁটতে হাঁটতে চললাম। বেশ ভালই লাগছিল, রাস্তার পাশ দিয়ে স্কুল ফেরত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে পথ চলতে।
যেতে যেতে দেখলাম রাস্তার পাশেই রয়েছে সুন্দর ন্যাশনাল মিউজিয়াম, যেটি ১৮৫৪-১৯১৭ সালের মধ্যে তৈরী হয়েছিল এবং সম্পূর্ণ পাশ্চাত্য ঢঙে তৈরী এটি। এটি তৈরী হয়েছিল মেইজি যুগে।
এখানে বহু সুন্দর প্রাচীন জিনিসপত্র রাখা আছে। তবে আমাদের এবার সময় কম থাকায় একটি মিউজিয়ামে ঢোকারও সময় হয় নি। বাইরে থেকেই দেখা হল এই মাত্র।
অনেকটা পথ চলেছেন বন্ধুরা। দেখাও হল বৈকি অনেক কিছু। সঙ্গে থাকুন , দেখতে থাকি আর কি কি দেখা যায় এই দেশের—
ক্রমশঃ
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী
0 Comments