জ্বলদর্চি

দেহতত্ত্বে জগন্নাথ ও রথযাত্রা /প্রথম পর্ব /পি.শাশ্বতী

দেহতত্ত্বে জগন্নাথ ও রথযাত্রা

প্রথম পর্ব

পি.শাশ্বতী


হিন্দু ধর্মের প্রাচীন ধর্ম সাহিত্য হল বেদ ও পুরাণ। আমরা জানি বৈদিক যুগের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা কারণে এবং লৌকিক উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পুরাণ লিখিত হয়েছে। এর একটিই কারণ— মানবকুলের ঐহিক জীবনের প্রাত্যহিক যাপনের আত্মিক এবং আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের ঘটনাবলির বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে মানবকুলকে সংযত হওয়ার উপায় নির্দেশ করা। আরও একটি কারণ, আধ্যাত্মিক ভাবে মানুষের জীবনে  সুসংহত ও সুচিন্তিত ধর্মীয় প্রভাব সৃষ্টি করা। আর এইসব শাস্ত্রীয় তথ্য সাধারণ জনমানসের উপযোগী করে তোলার জন্য বিভিন্ন পুরাণের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে কিছু রূপকধর্মী গল্প, লোককাহিনির মাধ্যমে। যেমন আষাঢ় মাসের শুক্লা তিথিতে বিশ্বনন্দিত যে রথযাত্রার নির্দেশ পুরাণে বর্ণিত আছে, সেখানে এই রথ ও তার রথী সম্পর্কে অত্যন্ত বাস্তবমুখী একটি উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।

কঠোপনিষদে বলা হয়েছে:

আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু ।

বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মন: প্রগ্রহমেব চ।। ১/৩/৩ 

অর্থাৎ, এই দেহই রথ আর আত্মা দেহরূপ রথের রথী। আর ঈশ্বর থাকেন অন্তরে। যা আত্মার মাধ্যমে উপলব্ধ হয়। রথযাত্রার রূপক অর্থ কিন্তু এমনই।

এ নিয়ে একটু অন্যরকম ভাবে ভাবতে গেলে বলতে হয় ঈশ্বর আমাদের অন্তরে থাকেন। তাঁর সেই অর্থে কোনো রূপ নেই। তিনি সর্বত্র বিরাজিত। অর্থাৎ ঈশাব্যাসমিদং। বেদ বলছে আবাঙমানসগোচর— যা মানুষের বাক্য এবং মনের অতীত। আমরা মানুষ বলেই তাঁকে মানুষের মতো করে নিজের অন্তরে সাজিয়ে তুলি  এ বিষয়ে কৃষ্ণ যজুর্বেদীয় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে: 

অপাণিপাদো জাবানো গ্রহীতাপশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্নঃ ।

স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তাতমাহুরগ্র্যং পুরুষং মহান্তম্ ।।

এই শ্লোকের বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: তাঁর লৌকিক হস্ত নাই, অথচ তিনি সকল দ্রব্য গ্রহণ করেন। তাঁর পদ নাই অথচ সর্বত্রই চলেন। তাঁর চোখ নাই অথচ সবই দেখেন। কান নাই কিন্তু সবই শোনেন। তাঁকে জানা কঠিন, তিনি জগতের আদিপুরুষ। এই বামনদেবই বিশ্বাত্মা— তাঁর রূপ নেই, আকার নেই ।

🍂
উপনিষদের এই বর্ণনার প্রতীকী রূপই হল পুরীর জগন্নাথদেব। আগেই বলা হয়েছে পুরাণ মানেই ধর্মকথাকেই গল্পচ্ছলে বা রূপকের মাধ্যমে প্রচার করা। 

পুরাণ থেকে রথযাত্রা এবং জগন্নাথদেবের মূর্তি সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া  যায়, সেটিও গল্পের মতো করেই বলা হয়েছে। স্কন্দ পুরাণে উৎকল রাজ্য নামের এক দেশে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে এক রাজার কথা জানতে পারা যায়। যেটি বর্তমান উড়িষ্যার অন্তর্গত ছিল। এই রাজা ছিলেন পরমেশ্বরের এক পরম ভক্ত। তিনি একদিন এই পরমেশ্বরের কাছ থেকে স্বপ্নাদিষ্ট হন একটি মন্দির নির্মাণের জন্যে। এই স্বপ্ন দেখার পর তিনি যখন মন্দির নির্মাণের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন সেখানে এসে দেবর্ষি নারদ জানান, স্বয়ং ব্রহ্মারও এই রকমই ইচ্ছা। তিনি নিজে এসে সেই মন্দিরের অভিষেক করতে চান। নারদ রাজাকে বললেন, “আপনি নিজে গিয়ে ব্রহ্মাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আসুন।” 

নারদের পরামর্শ মতো রাজা ব্রহ্মলোকে গিয়ে ব্রহ্মাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে যখন নিজের দেশে ফিরে আসেন, তখন দেখলেন তাকে কেউ চিনতে পারছে না। পৃথিবীর অনেক কিছুই বদলে গেছে। আসলে ব্রহ্মলোকের সময়ের সঙ্গে তো পৃথিবীর বিস্তর ফারাক। পৃথিবীতে তত দিনে কয়েকশো বছর পার হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে তিনি আবার সব কিছু নতুন করে শুরু করলেন। মন্দিরও প্রতিষ্ঠা হল। আর তখনই তিনি আবার একটি দৈববাণীর মাধ্যমে জানতে পারলেন সমুদ্র সৈকতে একটি নিম কাঠ ভেসে আসবে, সেটা দিয়েই তৈরি হবে দেববিগ্রহ।

স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একজন বৃদ্ধ কারিগরও এলেন সেই বিগ্রহ তৈরি করতে। কিন্তু সেই নির্মাতা শর্ত দিলেন তিনি মন্দিরের অভ্যন্তরে দ্বার রুদ্ধ করে নিভৃতে কাজ করবেন। আর বিগ্রহ তৈরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না। বৃদ্ধ বেশে সেই মানুষটি ছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা।

এদিকে মূর্তি তৈরি হয়েই চলেছে। সময় ক্রমশ পার হয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছু দিন অপেক্ষা করার পর উৎসুক রাজা কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে মন্দিরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখেন সেখানে সেই কারিগর নেই। পড়ে আছে অর্ধ সমাপ্ত এক মূর্তি। রাজা তাঁর কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে সেই মূর্তিই প্রতিষ্ঠা করেন দেব মন্দিরে।  

পরবর্তীকালে শ্রীকৃষ্ণ এবং জগন্নাথদেবকে একই সত্তায় চিন্তা করে ওই একই আদলে তাঁর পাশে ভাই বলরাম এবং আদরের বোন সুভদ্রার মূর্তি স্থাপন করা হয়। পুরীর মন্দিরে তার পর থেকে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ সেই মূর্তিই দর্শন করে ভক্তি নিবেদন করে চলেছে। যদিও এই বলরাম ও সুভদ্রার একই সঙ্গে জগন্নাথের পাশে অবস্থান নিয়ে বেশ কিছু পুরাণ মত আছে। পরে সে বিষয়ে আসছি। 

উপনিষদে বর্ণিত এই কাহিনির অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায়, দৈবক্রমেই জগন্নাথের মূর্তিকে অসমাপ্ত রাখা হয়েছে কারণ তাঁর অবাঙমানসগোচর রূপ তৈরিতে আমরা অক্ষম। তাঁকে শুধু অন্তর দিয়েই উপলব্ধি করা যায়। চোখের সামনে তাই শুধুমাত্র একটি প্রতীকী রূপ রেখে তাঁর ধ্যান করতে বলা হয়েছে। যাতে শূন্যতার অন্ধকারে মানবমনের একাগ্রতায় বিচ্যুতি না ঘটে যায়।  

মূর্তি প্রতিষ্ঠার অনেক বছর পরে ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে পুরীতে তিনটি রথে পৃথক ভাবে রথযাত্রার প্রচলন করেন রাজা ভীম অনঙ্গদেব। সেখানে প্রথমে বলরাম, তারপর সুভদ্রা এবং সব শেষে জগন্নাথকে রথে চাপানো হয়। যে বিষয়টি নিয়েও পড়ে আলোচনায় আসছি।

(ক্রমশ) 

আরও পড়ুন 

বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

0 Comments