জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—রাশিয়া (এশিয়া)রাজহাঁসের হাত থেকে রেহাই/ চিন্ময় দাশ

চিত্র- শুভম দাস 
দূর দেশের লোকগল্প—রাশিয়া (এশিয়া)
রাজহাঁসের হাত থেকে রেহাই 
চিন্ময় দাশ


একটা কুঁড়েঘরে থাকে একজন লোক আর তার বউ। আর থাকে তাদের দুটো ছেলেমেয়ে। মেয়েটা বড়, তার ভাইটা বেশ ছোট। 
সেদিন মা তার মেয়েকে ডেকে বলল—আমরা কাজে বেরোচ্ছি। ভাইকে লক্ষ্য রাখবি। বান রুটি নিয়ে আসব ফেরার সময়। 
বান রুটি ভারি প্রিয় দুই ভাইবোনেরই। মেয়েটা বলল—আর কিছু আনবে না, মা?
--আচ্ছা, ঠিক আছে। ফিরে এসে জামা সেলাই করে দেব। মাথার রুমালও এনে দেব দুজনকে। কিন্তু ভাইকে চোখে চোখে রাখবি। ঘরের বাইরে যাবি না কিন্তু।
বান রুটি, জামা,মাথার রুমাল—কত কিছু পাওয়া যাবে, মেয়েটা সেই আনন্দে মশগুল। বাবা-মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মা কী বলে গেল, সে কথাটাই বেমালুম ভুলে গেল মেয়ে। ঘরের বাইরে চলে এল ভাইকে নিয়ে।
ভাইকে উঠোনে বসিয়ে দিয়ে, নিজে রাস্তায় বেরিয়ে গেল খেলা করতে।
এক ঝাঁক রাজহাঁস উড়ে উড়ে যাচ্ছিল সেদিক দিয়ে। তাদের চোখে পড়ে গেল বাচ্চাটাকে। ঝুপ করে নেমে এসে, বাচ্চাটাকে তুলে ডানায় চাপিয়ে নিয়ে, চলে গেল হাঁসগুলো। 
খেলা সেরে, মেয়েটা যখন ঘরে ফিরে এলো, উঠোন ফাঁকা। ভাই নাই কোথাও। কোথায় গেল ভাই আমার? এদিকে খোঁজে। ওদিকে খোঁজে। সামনে ছোটে। পিছনে ছোটে। কোত্থাও নাই! চিৎকার করে ডাক পাড়ে ভাইকে। গাল ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে। বাবা-মা ফিরে এলে, যে কী দুর্গতি হবে, ভাবতেও পারছে না। 
এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। ছুটতে ছুটতে খোলা মাঠে এসে পড়েছে। এক ঝাঁক রাজহাঁস উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। মেয়েটার মনে পড়ে গেল—আরে, এই হাঁসগুলোর নামে তো অনেক কথা শোনা যায়। মওকা পেলে, এরা ছোট ছোট বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যায়। 
নিশ্চয় এটা হাঁসগুলোরই কীর্তি। ওরাই আমার ভাইকে চুরি করেছে। মেয়েটা চলল হাঁসগুলোর পেছন পেছন। কতদূর গিয়েছে, একটা উনুনের সাথে দেখা। মেয়েটা জিজ্ঞেস করল—উনুন দিদি, রাজহাঁসগুলো কোন দিকে গেল, বলতে পারো? 
🍂

--পারব না কেন? অবশ্যই পারি। উনুন বলল—তবে, একটা শর্ত আছে। তুমি যদি আমার রাইশাকের তৈরি কেক খাও একটা, তবেই বলব। 
মেয়েটা বলল—রাইশাকের কেক? না, না। আমাদের বাড়িতে গমের কেকও খাওয়া হয় না।
মেয়েটা কেক খেলো না। উনুনও মুখ খুলল না। মেয়েটা এগিয়ে চলল।
যেতে যেতে একটা আপেল গাছের সাথে দেখা। মেয়েটা বলল—গাছ দাদা, গাছ দাদা! রাজহাঁসগুলো কোন দিকে গেল, বলতে পারো? 
--পারব না কেন? অবশ্যই পারি। আপেল গাছ বলল—তবে, একটা শর্ত আছে। তুমি যদি আমার একটা আপেল খাও, তবেই বলব। 
মেয়েটা বলল—না, না। তোমার তো ঐ বুনো আপেল! মিষ্টি আপেলও আমরা খাই না। 
মেয়েটা আপেল খেলো না। আপেল গাছও মুখ খুলল না। মেয়েটা এগিয়ে চলল আবার। যেতে যেতে একটা নদীর সাথে দেখা। সেটা আবার দুধের নদী। ফেনাগুলো সব পুডিং। মেয়েটা বলল— হ্যাঁগো, দুধের নদী! রাজহাঁসগুলো কোন দিকে গেল, বলতে পারো? 
--পারব না কেন? অবশ্যই পারি। নদী বলল—তবে, একটা শর্ত আছে। তুমি যদি আমার খানিকটা দুধ আর একটা পুডিং খাও, তবেই বলব। 
মেয়েটা বলল—না, না। তোমার এই সাধারণ দুধ আর পুডিং আমি খাবো না। সত্যি বলতে কী, বাড়িতে মিষ্টি ক্রীমও খাই না আমরা। 
মেয়েটা পুডিং খেলো না। মুখ খুলল না নদীও। মেয়েটা এগিয়ে চলল। কতক্ষণ একটা মাঠের মধ্যে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াল। কোথাও দেখা নাই হাঁসগুলোর। ঘুরতে ঘুরতে বনের মধ্যে ঢুকেছে। খুঁজে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। 
বনের মধ্যে হঠাত একটা শজারুর সাথে দেখা। সারা গায়ে বড় বড় সুঁচালো কাঁটা। দেখে দারুণ ভয় মেয়ের। এ কাঁটার খোঁচা খেলে, আর রেহাই নাই। মেয়েকে কিছু বলতে হোল না। শজারুই জিজ্ঞেস করল—কীগো মেয়ে, এই বনের মধ্যে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছো কেন?
এবার বেশ সাহস এলো মনে। মেয়ে বলল—শজারু দাদা, একদল রাজহাঁস উড়ে এলো। কোন দিকে গেল, দেখেছ তুমি? ওরা আমার ভাইকে চুরি করে এনেছে। 
শজারু বলল—তাই না কি? চলো, দেখিয়ে দিচ্ছি। আমি জানি, ওদের ডেরা কোথায়। 
শজারুর পিছন পিছন খানিকটা এগিয়ে, একটা কুঁড়েঘর দেখা গেল।  সেই ঘরের খুঁটিগুলো মুরগির পায়ের মত। তার ভিতরে এক খিনখিনে বুড়ি বসে আছে। শজারু ফিসফিস করে বলল—খুব সাবধান। ভয়ঙ্কর জিনিষ এই বুড়ি। 
খুব সন্তর্পনে কুঁড়েটার এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে উঁকি মারতে লাগল মেয়ে। এক সময় দেখতেও পেয়ে গেল তার ভাইকে। কুঁড়েটার ভিতরে একটা চারপায়ায় বসে আছে ছেলেটা। 
শজারুও দেখেছে বাচ্চাটাকে। সে বলল—একটা ফন্দি করা যাক। আমি যাচ্ছি, বুড়ির সাথে কথা বলতে। তুমি পেছনের দিক দিয়ে ভাইকে নিয়ে পালাও। 
শজারু এই বনেই থাকে। বুড়িও তাকে চেনে। শজারুকে দরজার সামনে দেখে, বুড়ি ছুটে বেরিয়ে এল—কীরে হতভাগা, তুই হঠাৎ এখানে কেন? কী মনে করে?
--না ঠাকুমা, কিছু মনে করে নয়। শজারু জবাব দিল—এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, তোমার একটু খবর নিয়ে যাই। 
এইভাবে বুড়িকে কুঁড়ে থেকে বের করে, আলাপ করতে লেগেছে শজারু। সেই সুযোগে মেয়েটা টুক করে ভাইকে নিয়ে সরে পড়ল। তারপর দৌড়। দৌড় দৌড় দৌড়। বুড়ির নাগাল এড়িয়ে পালিয়ে যেতে হবে। যত তাড়াতাড়ি পারা যায়।
বন থেকে বেরিয়ে এসেছে, কিছুক্ষণ বাদেই বাতাসে শনশন আওয়াজ। তাকিয়ে দেখেই, মেয়ের বুক কাঁপতে লাগল। রাজহাঁসগুলো তাড়া করে আসছে পেছন পেছন। তারা জানতে পেরে গেছে। 
কী করা যায়? কোথাও কোন আড়াল নাই। কোথায় লুকানো যায়? ছুটতে ছুটতে সেই নদীর কাছে এসে পড়েছে। নদীকেই বলল—হ্যাঁগো, দুধের নদী! রাজহাঁসগুলো তাড়া করে আসছে, আমার ভাইকে কেড়ে নেবে বলে। আমাকে একটু লুকিয়ে রাখতে পারবে?
--কেন পারব না? নদী বলল—তবে তোমাকে আমার এই সাধারণ দুধ আর একটা পুডিং খেতে হবে। 
অন্য কোন উপাই নেই এখন রেহাই পাওয়ার। অগত্যা রাজি হতেই হোল। নদীও তার ঢেউয়ের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল তাদের ভাইবোনকে। হাঁসগুলো মেয়টাকে খুঁজে না পেয়ে, ফিরে গেল।
নদীকে ধন্যবাদ জানিয়ে, আবার দৌড়তে লাগল মেয়ে। হাঁসগুলো তো আকাশেই ছিল। খানিক দূর গিয়েছে। চোখে পড়ে গেল তাদের। আবার তাড়া করে এলো।
মেয়েটাও শুনেছে হাঁসেদের ডানা ঝাপটানির শব্দ। দৌড়চ্ছে জোর পায়ে। হাঁসগুলোর হাত থেকে কী করে বাঁচা যায়? ভাবছে আর দৌড়োচ্ছে।
দৌড়তে দৌড়তে আপেল গাছটার তলায় হাজির। মেয়েটা বলল—গাছ দাদা, গাছ দাদা! হাঁসগুলোর হাত থেকে বাঁচতে হবে। একটু আড়াল করে রাখবে আমাদের? নইলে, আমার ভাইকে কেড়ে নিয়ে যাবে দুষ্টু হাঁসগুলো। বাঁচাও আমাদের।
আপেল গাছ বলল—কেন বাঁচাবো না? তবে ঐ একটাই কথা। আমার এই বুনো আপেল একটা খেতে হবে তোমাকে। 
এখন আর মাথা নেড়ে চলে যাওয়ার উপায় নাই। অগত্যা মেয়েটা রাজি হয়ে গেল। আপেল গাছে ঘন পাতার ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া ডাল। তার ভিতরে লুকিয়ে পড়ল মেয়েটি। 
হাঁসগুলো আবার ফিরে গেল খোঁজাখুঁজি করে। মেয়েটাও গাছকে ধন্যবাদ জানিয়ে, দৌড়তে শুরু করল। 
দৌড়চ্ছে, দৌড়চ্ছে। বুকে আঁকড়ে ধরে আছে ভাইকে। 
কিছু দূর গিয়েছে, আবার শোঁ-শোঁ শব্দ। তাড়া করে আসছে শয়তানগুলো। 
খানিক দূর গিয়েছে, হাঁসের দল একেবারে মাথার উপরে নেমে এসেছে। এবার শুরু হোল তাদের পাখার ঝাপটা মারা। শক্ত ডানা হাঁসেদের। মেয়েটার মাথায় মুখে ঝাপটা মেরে যাচ্ছে। শরীর দুর্বল হয়ে আসছে। মেয়েটাও বুঝে গেছে, আর বেশি সময় দৌড়ানো যাবে না। বাঁচানো যাবে না ভাইকেও। কেড়ে নিয়ে যাবে পাখিগুলো।
তখনই মেয়েটা উনুনের সামনে এসে হাজির। কান্না ভেজা গলায় বলল—উনুন দিদি, উনুন দিদি! বাঁচাও আমাদের। ভয়াণক বিপদ। 
উনুনও সব দেখছে নিজের চোখে। সে বলল—তুমি আমার কেক খাও। আমিও তোমাদের বাঁচাই। 
তাড়াতাড়ি কেকে কামড় বসিয়ে দিল মেয়েটি। উনুনও দুজনকে ভিতরে ঢুকিয়ে নিল। কিছুই করতে পারল না পাখিগুলো।
বাড়ি আর দূরে নয়। উনুনকে ধন্যবাদ জানিয়ে, শেষ বারের মত দৌড় লাগালো মেয়ে। বুকে ভাইকে জড়িয়ে ধরা। একটু বাদেই নিজের ঘরে এসে পৌঁছে গেল মেয়েটা। ভাইকে দাওয়ায় নামিয়ে দিতে পেরেছে। আর ভয় নাই বুকে। মনে ভাবনা নাই। 
মুখে হাসি ফুটে উঠল মেয়ের। বাবা-মা এখনও ফিরে আসেনি। আর রাস্তায় গেল না, ভাইকে নিয়ে, দাওয়াতেই খেলা করতে লাগল দুজনে।

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

0 Comments