জ্বলদর্চি

ইস্কুল ফিস্কুল/ পর্ব-২/সৌমেন রায়

ইস্কুল ফিস্কুল পর্ব-২

সৌমেন রায়

চিত্র- অসিতকুমার সেনাপতি 

মুখবন্ধ

  শিক্ষক নয়, সমগ্র স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থাই কোন একটি জাতির মেরুদন্ড। কারণ স্কুল শিক্ষা শুধুমাত্র বিষয়গত জ্ঞান সরবরাহ করে উচ্চ শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করে না। সেই সঙ্গে  সহমর্মিতা,সমানুভূতি মূল্যবোধ গড়ে তোলে, সামাজিকতা শেখায়, আত্মবিশ্বাসী করে, আত্মমর্যাদা বোধ গড়ে দেয়, প্রকৃতির শুশ্রুষা করতে শেখায়। এইসব গুনই তাদের ভবিষ্যতের সুনাগরিক করে তোলে। পশ্চিমবঙ্গে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী পড়ে সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলে। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের মেরুদন্ড যদি বলতে হয় তাহলে তা হল বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়। কেমন চলছে এই বিদ্যালয়গুলি? ঝকঝকে পরিকাঠামোর অন্তরালের খবর কি?  গভীরে গিয়ে সেসব অনুসন্ধান করাই এই লেখাগুলির উদ্দেশ্য। কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তিকে আক্রমণ করা, অসম্মান করা কোন ভাবেই এই লেখাগুলির অভিপ্রায় নয়।

লেখাগুলিকে বোধহয় ‘কথকতা মূলক প্রবন্ধ’ বলা উচিত। প্রথম তিনটি লেখা আশি দশকের স্কুল নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক লেখা। পরের লেখাগুলি বর্তমান অবস্থার বিশ্লেষণ। লেখাতে সচেতন ভাবে আগের সময় ও এখনের সময়ের মধ্যে তুলনা করা হয়নি। কারণ দুটি ভিন্ন সময়ের উপাদান ভিন্ন, চাহিদা ভিন্ন। তাই তাদের মধ্যে লিখিত তুলনা করা অনুচিত। পাঠক চাইলে মনে মনে সে তুলনা করতে পারেন ।সেই কারণে প্রথম তিনটি লেখায় অতীতের কিছু তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে গল্পের ছলে। শেষের দিকে অন্ধকারের মধ্যে আলোক বর্তিকা সন্ধানের চেষ্টা করা হয়েছে। বেঁচে বর্তে থাকতে গেলে যা করতেই হয়। লেখার মধ্যে যে ঘটনাবলীর উল্লেখ আছে সেগুলি সম্পূর্ণ সত্য। কোথাও কোনো অতিরঞ্জন নেই। তবে বিড়ম্বনাএড়াতে স্থান, কাল পাত্র কখনো উহ্য আছে, কখনো বা পরিবর্তনকরে দেওয়া হয়েছে।

জানি এ লেখার ক্ষমতা নেই কোথাও কোন তিল মাত্র পরিবর্তন করার। সর্বজনীন শিক্ষা এখন এতটাই গুরুত্বহীন যে কেউ হয়ত এ লেখা পড়েই দেখবেন না। তাহলে লিখছি কেন?  আসলে লেখকও এই ব্যবস্থারই অংশ। বহমান পরিবর্তনের সাক্ষী। তাই এইগুলোকে লেখা না বলে আত্ম সমালোচনা বলতে পারেন বা আর্তনাদও বলতে পারেন!

আশি দশকের স্কুলবেলা 

(পর্ব – ২)

     (আগের পর্বের পর)

ফুটবল লিগ  বেশ জমাটি ছিল। পাশ ফেল প্রথা থাকায় অষ্টম শ্রেণীর গাঁটে আটকে যেত অনেক ফুটবলার। তাই অধিকাংশ সময় চ্যাম্পিয়ন হত অষ্টম শ্রেণী। ক্লাস টেনে গিয়ে তো আমার মত এগারো মাত্রার হিমোগ্লোবিনের ছেলেও চান্স পেয়ে গিয়েছিল দলে। এখনো মনে পড়ে মুকুন্দদার রাইট আউট ধরে দৌড়, সহপাঠী শম্ভু মান্ডির এই গোল থেকে সে গোলে মারা শট, মাঝ মাঠে সুনীলদার ড্রিবলিং। খেলার ক্লাসে সাদা হাফ প্যান্ট ও গেঞ্জি পরে ড্রিল করা আমাদের বেশ ভাল লাগত। সেই ভালো লাগাটা ঐক্যবোধ কিনা জানিনা। কিন্তু ক্লাসটা অধিকাংশ দিন হত না। রাগ করে আমরা কয়েকজন একদিন হাফপ্যান্ট পরে যাইনি। ঠিক সেইদিনই ক্লাসটা হল, আর আমাদের  কোন যুক্তি রঘুস্যার শুনলেন না। তারপর থেকে খেলাধুলার আরেক শিক্ষক শীতলস্যার আমাদের প্রিয় হয়ে উঠলেন। গ্রুপ বাজির হাতে খড়ি বোধহয় এভাবেই হয়েছিল!

ইতিহাসে পড়া অসহযোগ আন্দোলনের  সফল প্রয়োগ আমরা স্কুলেই করেছিলাম । নাটকের স্ক্রীন টেস্টে হরিসাধন কে বাদ দেওয়া হয় শুধুমাত্র টেনে পড়ে বলে। প্রতিবাদে আমরা ক্লাস বয়কট করেছিলাম। বয়কট বলতে আমরা ক্লাসে বসতাম কিন্তু কোন রেসপন্স করতাম না। শেষমেষ শিক্ষকরা আমাদের ক্লাসে এসে ব্যাপারটি মিটিয়ে নেন। স্কুলে শৌচাগার ছিল তবে তার অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। ছাত্রীরা বাধ্য হয়ে তাই ব্যবহার করত। আমরা ভাঙ্গা প্রাচীরের ফাঁক গলে যেতাম মাঠে। আর সেখানে আমাদের প্রকৃত ঐক্যের বোধ জেগে উঠতো! মূত্রত্যাগ সংক্রান্ত বিভিন্ন ক্রীড়া কৌশল আমরা সেই বয়সে আবিষ্কার করে ফেলেছিলাম! কিন্তু পেটেন্ট নেওয়া হয়নি।

কল্প শক্তি- বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় ছিল আমাদের কম।তাই পাঠ্যবইগুলো ছিল আমাদের জানালার মত। সকলেই সে জানালা ব্যবহার করেছে এমন দাবি অবশ্য করছি না। তবে সেই সময় প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাড়তি পড়া বা ছোট থেকে কম্পিটিশনের চাপ ছিল না। পাঠ্য বইগুলি পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট ছিল। সেই কারণে অজস্র গল্পের বই পড়ার সুযোগ ছিল। টেনিদা – ঘনাদা- ফেলুদা থেকে দেশে ধারাবাহিক পূর্ব-পশ্চিম, নিষিদ্ধ পারস্য রজনী কিছুই বাদ যায়নি। টিউশন এর ব্যাপক প্রচলন ছিল না। অংক ইংরেজিতে টিউশন চলত টুকটাক। একই মাস্টার সব পড়াতেন। সেখানেও স্কুলের পড়া তৈরি করে দেওয়া হতো,প্যারালাল স্কুল চলত না। স্কুলে চক, ডাস্টার, ব্ল্যাকবোর্ড ছাড়া কোনো টি এল এম ব্যবহার হয়েছে বলে মনে পড়ছে না। টি এল এম এর  ঘাটতি আমরা পূরণ করে নিতাম কল্প -শক্তি দিয়ে। পরীক্ষায় নকল তখনও ছিল। তবে সে দুঃসাহস কয়েক জনেরই হতো। আর এ নিয়ে বেশ একটা চোর-পুলিশ খেলা চলত। নোট ধরতে কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আবার কথিত ছিল শিশিরবাবু নাকি খবর কাগজ এরফাঁক দিয়ে লক্ষ্য রাখেন। এমনিতে তাকে সহপাঠির মাথায় কাঠের চাঁদা ভাঙতে সবাই স্বচক্ষে দেখেছিল। তাই তিনি পরীক্ষার হলে খবরের কাগজ হাতে নিলে দাগি আসামীরা সতর্ক হয়ে যেত। এ ব্যাপারে দাদা দিদিরা আবার সেচ্ছা সেবক হিসাবে ট্রেনিংও দিত। নোট লুকানোর এমন এমন গুপ্ত জায়গা তারা আবিষ্কার করেছিল যে ফেলুদারাও হয়তো ফেল করে যেত। নকলের খারাপ দিক সরিয়ে রাখলে সেছিল দুপক্ষের বুদ্ধির ডুয়েল।

কাটমানি- মেয়েদের সঙ্গে ছেলেদের মেলামেশা অবাধ্তো ছিলই না, এমনকি কথাবার্তাও তেমন হতো না। কয়েকজন সাহসী ছাত্র আর সাহসী ছাত্রী কথাবার্তা বলত। তারাই দুপক্ষের সেতুবন্ধনের কাজ করতো। সে জড়তা এখনো আছে। কোন অপরিচিতার সঙ্গে কথা বলতে গেলে সামান্য কুশল বিনিময়ের পরে আবহাওয়া ছাড়া আর কিছু কথা মনে পড়ে না। তবে তার মানে এই নয় যে দু-একটা লায়লা মজনু স্কুলে ছিল না। তাদের যোগাযোগ করতে হতো অত্যন্ত সন্তর্পনে, এজেন্ট মারফত। এজেন্টরা 'কাটমানি' হিসেবে মাঝে মধ্যেই খেতে চাইত। হারুদার দোকানে যৎকিঞ্চিত  মটর ভাজা, ঘুগনি পাওয়া যেত তাতেই খুশি থাকতে হত তাদের। তা নাহলে অপেক্ষা করতে হত কবে আসবে শিবরাত্রির মেলা।

🍂
আচার্যগন- কানাই বাবু ও গোরাচাঁদ বাবুর বাংলা পড়ানোতে আমাদের কাছে মূর্ত হয়ে উঠত তারাপদ, ফটিক বা গ্রামের হাট। দেবাশিসবাবু ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির। 'Two roads diverged in a yellow wood' বলে তিনি তাকিয়ে থাকতেন জানলা দিয়ে। খানিক পরে চেতনা ফিরত ' খ্যাকখ্যাক' আওয়াজে। কে করলো, কে করলো?  কিন্তু তখন ক্লাস সমষ্টিতে  পরিণত, তাকে ভেঙে ব্যক্তি করে কার সাধ্য! বাগস্যার এর পড়ানোর ধরনটি আকর্ষণীয় ছিল। স্কুল আসার সময় ঘটা দুর্ঘটনা থেকে চলে যেতে পারতেন ব্লাডগ্রুপ পড়ানোতে। ইতিহাসের গল্প বলতেন কালীপদবাবু। শিক্ষকের অভাবে তিনিই পড়াতেন ভূগোল। সবমিলে স্থান-কালের একটা ছবি তিনি আমাদের সামনে খাড়া করেছিলেন। ছোট স্কুল থেকে বড় স্কুলে আসার সময় চিত্তবাবু পড়াতেন ইতিহাস, নির্বিবাদী উদয়বাবু গণিত। এই দুজন পূর্ব পরিচিত মনে খানিক সাহস যুগিয়ে ছিলেন। স্কুলের করণিক অজিত বাবু ক্লাস ফাইভে পড়িয়েছিলেন হিন্দি। আমরা আজীবন তাকে স্যার বলেই জেনে এসেছি। পদার্থ বিদ্যার অশোকবাবু গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। তিনিই আবার কর্মশিক্ষায় আমাদের ফিনাইল, সাবান তৈরি শিখিয়েছিলেন। হেডমাস্টার মহাশয় ভাগবত বাবু ছিলেন নির্বিরোধী লোক। এখন হলে তিনি মনে হয় খুবই মনোকষ্টে  ভুগতেন। বার্ষিক পরীক্ষার পরে শীতের রোদের মৌতাত মেখে আমরা দলবেঁধে কোন কোন মাস্টারমশায়ের কাছে যেতাম নম্বর জানতে। একবার ক্ষুদিরাম বাবুর বাড়ি গিয়ে তো আমরা অবাক। তিনি একটা পাম্প মেশিন খুলে সারাই করছেন। যিনি রাঁধেন তিনি দেখছি চুলও বাঁধেন। তবে মনের অনেকটা দখল করে নিয়েছিলেন অংকের শিক্ষক বিনয়বাবু। শিক্ষকের অভাবে তিনি কিছুটা বিজ্ঞানও পড়াতেন। আজ যে করে খাচ্ছি তার প্রাথমিক ভিত্তি নির্মাণ তিনিই করেছেন। পরবর্তীকালে তিনি হাট থেকে চশমা কেনেন শুনেও (পাওয়ার চেক না করে) শ্রদ্ধা কমেনি। কারণ তখন হোস্টেলে থাকার সুবাদে অর্থনীতির কিছু জ্ঞান হয়ে গেছে।

            (পরবর্তী অংশ পরের পর্বে)

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

1 Comments

  1. নির্মাল্য ঘোষJuly 16, 2024 at 11:51 AM

    স্মৃতিকথার সেই মানুষ গুলির অনেকেই হয়ত আজ আর নেই তবু সেই মানুষগুলিকে ঘিরে কথকথা তাঁদের বাঁচিয়ে রেখেছে।

    ReplyDelete