জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—আলবেনিয়া (ইউরোপ)তারা-কপালী ভাইবোন /চিন্ময় দাশ

চিত্র- শুভম দাস
দূর দেশের লোকগল্প—আলবেনিয়া (ইউরোপ)
তারা-কপালী ভাইবোন

চিন্ময় দাশ

এক দেশে এক রাজা ছিল। সে রাজার কোনও ছেলে ছিল না। তবে, মেয়ে ছিল রাজার। একটি নয়, দুটিও নয়। তিন-তিনটে মেয়ে ছিল রাজামশাইর।
মেয়েগুলোকে নিয়ে ভারি ভাবনা রাজার। কেন বলো তো? বড় মেয়ে দুটো ভারি ধুরন্ধর। সব সময় বদবুদ্ধি খেলা করে তাদের মাথায়। কী করে অন্যের অনিষ্ট করবে—একটাই ভাবনা তাদের। 
ছোটটি যেমন শান্ত, তেমনি সাধাসিধে। সাতে-পাঁচে থাকে না কারও। ভারি দয়ালু। কারও কোন অসুবিধা চোখে পড়লেই হোল। অমনি ঝাঁপিয়ে পড়বে। কী করে একটু রেহাই দেওয়া যায়!
রাজামশাই ভারি ভালোবাসেন ছোটকে। তাতেই হয়েছে আরও ঝামেলা। বাবা ছোটকে বেশি ভালোবাসে, এটা সইতে পারে না দুজনে। হিংসায় জ্বলে-পুড়ে মরে।
ভবিষ্যৎ নিয়েও রাজামশাইর বড় ভাবনা। একদিন তো মরে যেতেই হবে। রাজা হবে কে তখন? কার হাতে যাবে এতো বড় রাজ্য?
হোল কী, ভাবতে ভাবতে, একদিন টুক করে মরেই গেল রাজামশাই। ভারি সোরগোল রাজবাড়িতে। রাজা থাকলে একজন মন্ত্রীও থাকার কথা। একজন মন্ত্রী ছিল এই রাজারও। যেমন বুদ্ধি তেমনি ঘোড়েল।
একটি ছেলে ছিল মন্ত্রীর। জোয়ান হয়ে উঠেছে। রাজা হওয়ার একেবারে উপযুক্ত ছেলে সে। মন্ত্রী ভাবল, বলা নাই, কওয়া নাই রাজা মারা গিয়েছে। এমন মওকা কম পাওয়া যায়। হাতছাড়া করা যাবেই না। দাঁওটা এখনই মারতে হবে। 
সোরগোলের ভিতর, নিজের ছেলেটাকে এনে, রাজার সিংহাসনে বসিয়ে দিল মন্ত্রী। রাজার আসন তো আর খালি রাখা যায় না। পাত্র-মিত্র, অমাত্য-নিমিত্ত, সেনাপতি-ধনপতি কেউ কিছু বলবার সময়ই পেল না। আর, সময় পেলেই বা কী হোত? মন্ত্রীর সামনে রা কাড়বার মুরোদই নাই কারও। 
রাজার আসনে বসেছে যুবক ছেলেটি। মনে এখন ভারি আনন্দ। একদিন সাধ হোল, নিজের চোখে রাজ্যটা ঘুরে দেখব। দুম করে এতো বড় একটা রাজ্যের রাজা হয়ে বসে পড়েছি। প্রজারা কী ভাবছে, না ভাবছে, জানা দরকার। কেউ কোথাও আপত্তি তুলছে কি না, নিজের কানে শোনাই ভালো। 
নিজের হাতের তালুর মতো চিনতে হবে রাজ্যটাকে। তবেই না ভালোভাবে শাসন করা যাবে। ঘোষণা করে দিল—রাজাকে দাহ করবার দিন, কোনও বাড়িতে আলো জ্বলবে না। একটা বাতিও নয়। তাতে সম্মান দেখানো হবে রাজামশাইকে।
সন্ধ্যা নামল। কাউকে কিছু বলল না রাজা। সাধারণ একজন ভিখিরীর ছদ্মবেশ ধরে বেরিয়ে পড়ল।
বিশাল রাজবাড়ি। মেয়েরা থাকে অনেকটা ভেতরের অন্দর মহলে। তার পাশ দিয়েই যাচ্ছিল রাজা। তিন বোন বসে গল্প করছে। তাদের গলা কানে আসতেই রাজা দাঁড়িয়ে পড়ল রাস্তায়।
বড় মেয়ে বলছে— নতুন রাজা ছেলেটা ভালো। রাজা যদি আমাকে বিয়ে করে, বিশাল বড় একটা গালিচা বুনে দেব তাকে। 
ছোট জানতে চাইল—সে কী, দিদি? বিশাল গালিচা দিয়ে রাজা কী করবে? কাজকম্ম ফেলে, গড়াগড়ি খাবে গালিচায়?
--কেন, কেন? যুদ্ধে যাবে যখন, পুরো বাহিনী শুয়ে-গড়িয়েও, বাড়তি জায়গা থেকে যাবে সে গালিচায়। কতো কাজে লাগবে।
মেজমেয়ে বলল—আমাকে যদি বিয়ে করে রাজা, আমি বিশাল একটা তাঁবু বানিয়ে দেব রাজাকে। এমন তাঁবু, যাতে সৈন্য-সামন্ত সবাই থাকবার পরও, আরও ঘর বাড়তি থেকে যাবে।  
ছোট বলল—কেন, কেন? তাঁবুতে রাজার কী কাজ? বউকে নিয়ে লুকোচুরি খেলবে না কি?
--অনেক কাজ তাঁবুতে। যুদ্ধের সময় রাতের বিশ্রাম, জলে-ঝড়ে তাঁবুই তো মাথা বাঁচাবে সবার।
ছোট বলল—আমি বাপু ওসব বোনাবুনি কিছু করতে পারব না। আমি দুটো ছেলে-মেয়ে উপহার দেব রাজাকে। 
--তাই না কি রে?
ছোট বলল—যেমন তেমন নয় গো। কপালে তারা আঁকা থাকবে আমার ছেলে-মেয়ে দুটোর। দেখলে, তাক লেগে যাবে রাজার।
চলার পথে তিনজনের কথাই শুনেছে রাজা। পরদিনই দরবারে ডাক পড়ল তিন বোনের। তিনজনকেই বিয়ে করে ফেলল রাজা। 
বছর শেষ হয়ে যায় যায়। ছেলেপুলে হবে ছোটর। এমনই বিপাক, রাজাকে যুদ্ধে যেতে হোল সেসময়েই। ফিরে এসেই খোঁজ করল, ছোটরানির ছেলেপুলে হয়েছে?
বড়-মেজো তো মুখিয়েই ছিল। তারা মুখ বেঁকিয়ে বলল—হয়েছে, হয়েছে। দুটো ইঁদুর আর ছুঁচো বিইয়েছে তোমার সাধের ছোটরানি। কী ঘেন্না, কী ঘেন্না। মুখ দেখানো ভার।
রাজা তো রেগে কাঁই। সেপাইকে ডেকে হুকুম করল—সদর দেউড়ির সামনে রাস্তায় রেখে আয় হতচ্ছাড়িকে।  লোকেরা দেখবে আর থতু ছেটাবে। 
রাজার হুকুম শুনে বড় আর মেজো দুই বোনের ভারি ফূর্তি। সত্যি সত্যিই তো আর ইঁদুর আর ছুঁচো বাচ্চা হয়নি ছোটর। হয়েছিল সুন্দর ফুটফুটে দুটো ছেলেমেয়ে। কী মিষ্টি, কী মিষ্টি! তার উপর, দুজনের কপালেই সুন্দর দেখতে দুটো তারা আঁকা।
দেখেই ভারি কাহিল দুই রানি। হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরার অবস্থা। রাজবাড়ির গায়েই ভূমধ্য সাগর। বাচ্চা দুটোকে একটা বাক্সে ভরে ফেলল তাড়াতাড়ি। একটা চাকরানিকে ডেকে বলল—সাগরে ফেলে দিয়ে আয় বাক্সটা।
সেদিন বাতাস বইছিল একেবারে ঝড়ের মত। ভাসতে ভাসতে কতো দূর চলে গেল বাক্সটা। হয়েছে কী, দুই বুড়োবুড়ি মাছ ধরছিলো সাগরে। তারা দেখতে পেয়ে গেল। এরকম কত জিনিষই তো ভেসে আসে মাঝেমাঝে। কী না কী সম্পদ আছে এতে, কে জানে!
বুড়োবুড়ি ঘরে নিয়ে এলো বাক্সটা। খুলে তো ভারি অবাক! এ মা, কী সুন্দর দুটো বাচ্চা গো? আরও কী অবাক কাণ্ড! দুজনেরই কপালে দুটো তারা এঁকে দিয়েছে বিধাতা! এমন কচি দুটো বাচ্চাকে ভাসিয়ে দিয়েছে! কোন হতভাগী করেছে এ কাজ? এমন নিষ্ঠুরও হতে পারে কেউ? 
দরদ যেন উথলে উঠল দুজনের। তারা বাচ্চা দুটোকে বুকে তুলে নিল। নিজের সন্তানের মতো বড় করে তুলতে লাগল দুটিকে।
দিন যায়। মাস যায়। এক এক করে বছরও যেতে লাগল। বড় হয়ে উঠতে লাগল দুজনে। একদিন বুড়িটা মারা গেল। তার কিছু বাদে বুড়োও। মরবার সময়, বুড়ো ছেলেটাকে ডেকে বলল—সাগরের ধারে যেও। একটা গুহা আছে পাহাড়ের গায়ে। সেখানে একটা লাগাম রাখা আছে আমার। লাগামটা নিয়ে এসো। যা চাইবে, তাই হাতে পেয়ে যাবে তা থেকে।
শুনে তো আনন্দে লাফিয়ে উঠেছে ছেলেটা—তাই না কি? এখুনি যাচ্ছি আমি। 
--না, বাছা। এখন নয়। বুড়ো বলল—আমাকে কবর দেওয়ার পর, গুণে গুণে ৪০ দিন সবুর করবে। তার পরে যেও। তার আগে গুহায় ঢুকলে, কাজ তো হবেই না। উলটে বিপদও হতে পারে।  
বুড়ো মারা গিয়েছে কথাগুলো বলেই। গুণে গুণে ৪০ দিন কেটে গেল। দুই ভাইবোন গিয়ে হাজির হোল সেই গুহায়। সত্যিই একটা লাগাম রাখা আছে ভেতরে। 
লাগাম হাতে নিয়ে, ছেলেটা বলল—দুজন আছি তো আমরা। দুটো ঘোড়া চাই আমাদের।
চোখের পলকও পড়তে পেল না। টগবগে দুটো ঘোড়া সামনে হাজির। পিঠে জিন চাপানো। মুখে লাগাম। ভাই বলল—এই অজ গাঁয়ে পড়ে থেকে কাজ নাই, বোন। তার চেয়ে শহরে যাই চলো।
ঘোড়ায় চেপে শহরে এসে হাজির হোল দুটিতে। সেটাই আসলে তাদের বাবার রাজধানি। কিন্তু তারা তো অতশত জানে না কিছু। ভাই বলল—পেট চালাতে হবে তো। আমি একটা কফি দোকান খুলি। পথচলতি লোকজন নিশ্চয় পছন্দ করবে আমাদের। 
একটা কুঁড়ে বানিয়ে থাকল দুজনে। সকাল হলে, ছেলেটা দোকানে চলে যায়। মেয়েটা ঘরসংসার দেখে। যেমন ভেবেছিল ছেলেটা। ক’দিন না যেতে, বেশ নাম হয়ে গেল তাদের কফি দোকানের। পেট চালাবার কোন অসুবিধা রইল না আর। 
রাজার কানে গিয়েছে নতুন দোকানটার খবর। ঘোড়া হাঁকিয়ে নিজে একদিন দোকানে এসে হাজির। সত্যিই সে দোকানের কফির স্বাদ চমৎকার। আরও একটা বিষয়, ভারি সুন্দর দেখতে ছেলেটা। তার চেয়েও বড় কথা, কী সুন্দর একটা তারা জ্বলজ্বল করছে ছেলেটার কপালে। মাথায় হাজারো চিন্তা এসে ঘুরপাক খেতে লাগল। এমনটা কোন দিন দেখেনি রাজা।
সেদিন বাড়ি ফিরতে একটু দেরিই হোল রাজার। দুই রানি বলল—আজ এতো দেরি হোল যে?
রাজা তখন কফি দোকান, আর তারা-কপালী ছেলেটার কথা সব খুলে বলল। অমনি ছাঁৎ করে উঠেছে রানিদের বুক। সর্বনাশ! বাচ্চা দুটো বেঁচে আছে তাহলে? যে করেই হোক, নিকেশ করতে হবে আপদ দুটোকে। নইলে, অনেক দুর্ভোগ আছে আমাদের কপালে। 
এক কুচুটে বুড়ি চাকরাণি ছিল রাজবাড়িতে। কানে কানে মন্ত্র দিয়ে, তাকে ছেলেটার বোনের কাছে পাঠিয়ে দিল দুই রানি। 
ভাই গিয়েছে দোকানে। বাড়িতে বোন একা। বুড়ি গিয়ে হাজির—সে কী গো? একলাটি রয়েছ বাড়িতে।
--ভাই গিয়েছে দোকানে। আমি বাড়িতে আছি। কাজকম্ম আছে না সংসারে? 
--সে তো সব সংসারেই আছে, বাছা। তাই বলে, বোনকে ভালবাসবে না ভাই? একলাটি ফেলে চলে যাবে?
মেয়েটা বলে উঠল—না, না, বুড়িমা। আমার ভাই আমাকে খুব ভালোবাসে।
বুড়ি বলল—ভালো বাসে না আর কিছু। লাল পপি এনে দিয়েছে তোমাকে কোন দিন?
--লাল পপি এনে দেবে বোনকে? কেন?
--এই তো! নতুন এসেছ তো শহরে। তাই জানো না। এখানে সব ভায়েরা লাল পপি এনে দেয় তাদের বোনকে। সেটাই ভায়ের ভালবাসার প্রমাণ। সেটাই এ রাজ্যের নিয়ম, বাছা। 
সেদিন দোকান থেকে ঘরে ফিরেছে ভাই। দেখল বোনের মুখ ভার। বলল—কী হোল, বোন? মন খারাপ কেন?
বোন বলল—এ শহরে সব ভায়েরা লাল পপি ফুল এনে দেয় বোনেদের। তুমি যদি আমাকে ভালোবাসতে, তুমিও এনে দিতে।
লাল পপি ফুলের কথা জানে ছেলেটি। সাগরের ধারে সবার বড় এক পাহাড়। তার মাথায় ফোটে সে ফুল। ছেলেটা বলল—এই কথা? আজই এনে দেব তোমাকে। 
ঘোড়া হাঁকিয়ে রওণা দিল ছেলে। পাহাড়ের খানিকটা ওপরে উঠেছে। সামনে ভয়াণক এক দৈত্য। (আলবেনিয়ার পৌরাণিক লোককাহিনীর মতে, দশমাথা সে ড্রাগনের নাম—কুলসেদ্রা। সে ক্রুদ্ধ হলে, দশ মুখ দিয়ে আগুনের থুথু ছেটায়। তাতে পৃথিবী জুড়ে খরা, অঝোর বৃষ্টিপাত, বন্যা, ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়। মুখ খুলে যায় আগ্নেয়গিরিরও। সে দৈত্যের সামনে পড়লে, রেহাই পায় না কেউ।) 
দৈত্যের সামনে পড়ে, ছেলের তো পিলে চমকে গিয়েছে। আজই তার মৃত্যু। এর হাত থেকে ছাড় পাওয়া যাবে না। 
কিন্তু যা ঘটল, তা একেবারে অবাক করা ব্যাপার। দৈত্যটা বলল—ভয় পেয়ো না হে। কোন অনিষ্টই করব না তোমার আমি। গিলে তো ফেলবই না। 
সাহস তো পেলোই, খানিক মজাও পেয়ে গেল ছেলাটা। বলল—কেন বলো তো? অনিষ্ট করবে না কেন আমার?
--এত সুন্দর দেখতে কোনও মানুষ আমি দেখিনি কোনও দিন। তাছাড়া, কারও কপালে এমন তারা আঁকা থাকে, এ তো ভাবতেও পারছি না। নিশ্চয় স্বয়ং বিধাতা নিজের হাতে গড়েছেন তোমাকে। বলো, এখানে কেন এসেছ?
--লাল পপি ফুল চাই আমার। আমার বোনের জন্য নিয়ে যাব।
--কিন্তু সে ফুল তুমি পাবে কোথায়। সে তো থাকে কেবল এক সুন্দরী মেয়ের বাগানে। দুনিয়ার সেরা সুন্দরী সে। স্বয়ং বিধাতা গড়েছেন সে মেয়েকেও। 
ছেলের মনে ভারি আনন্দ। বলল—তাহলে সে মেয়ের হদিস বলে দাও আমাকে। আমি ঠিক জোগাড় করে আনব।
দৈত্য বলল—সে হদিশ আমার জানা নাই। পথ বলে দিচ্ছি্‌, আমার বড় ভাইয়ের কাছে যাও তুমি। সে হয়তো বলতে পারবে। 
ঘোড়া হাঁকিয়ে সে দৈত্যের কাছে হাজির হোল ছেলে। সেও একই ভাবে দেখতে সুন্দর, কপালে তারা আঁকা ছেলে, বিধাতার হাতে গড়া—এসব বলে, বলল—তোমার কোন ক্ষতি করব না আমি। বলো কেন এসেছ?
ছেলেটা ফুলের নাম আর সুন্দরী মেয়ের কথা বলতে, হাসি ফুটে উঠল দৈত্যের মুখে। পথের হদিশ দিয়ে, বলল—এই পাহাড়ের একেবারে মাথায়, বিশাল একটা প্রাসাদে থাকে সেই মেয়ে। সামনে উঠোন জুড়ে বাগান। তার নিজের হাতে গড়া। সেখানেই পাবে ফুল।
ছেলেটা আবার ঘোড়ায় চেপে বসল। দৈত্য বলল—ভেতরে ঢোকার উপায়টা জেনে যাও। নইলে তো ফিরে আসতে হবে। দেউড়িতে পৌঁছে, তোমার রুমাল দিয়ে পাল্লায় তিন বার ঘষা দিও। তাতে দরজা খুলে যাবে আপনা থেকে। ভেতরে ঢুকে দেখবে, একটা সিংহ আর একটা ভেড়া। কিছুটা কাঁচা মাংস আর এক গোছা ঘাস দিচ্ছি, নিয়ে যাও। এগুলো পেলে, বাধা দেবে না তারা।
মাংস আর ঘাস নিয়ে ছেলেটা পাহাড় চুড়ায় উঠতে লাগল। উপরে উঠে, সত্যিই এক প্রাসাদ। বিশাল দেউড়ি তাতে। দৈত্য যেমনটি বলেছিল। নিজের রুমালের কোণা দিয়ে একবার দু’বার তিনবার ঘষা লাগালো ছেলে। অমনি ঘড়ঘড় শব্দে দরজার মুখ হাঁ। 
সেই শব্দে সিংহ আর ভেড়া জেগে উঠেছে। এই নিষিদ্ধ জায়গায় কেউ আসে না কখনো। ঘুমিয়েই থাকে দুটিতে। কতকাল বাদে জেগেছে আজ। খিদেয় পেট চুঁই চুঁই।
ছেলেটা মাংস আর ঘাস ছুঁড়ে দিতেই, পথ ছেড়ে দিল তারা। অনেকটা এগিয়ে তবে ফুলের বাগান। টকটকে লাল পপি ফুটে আছে বাগান জুড়ে। আনন্দ ধরে না ছেলের।
ফুল তুলতে যাবে, অমনি খটকা লাগল মনে। যার বাগান তার অনুমতি না নিয়ে, ফুল তোলা অন্যায়। যাই মেয়েটির অনুমতি নিয়ে আসি। 
বাগানের পেছনে প্রাসাদ। প্রাসাদে ঢুকে তো মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। অসংখ্য কুঠুরি সেই প্রাসাদে। অসংখ্য দরজা। ঢুঁ মেরে মেরে হয়রাণ। কোন দরজাই খোলে না। কোথাও মালকিনের চিহ্নটুকুও নাই। এদিকে ফুল না নিয়ে ঘরে ফিরবে না সে। অগত্যা, আবার দৈত্যের কাছে ফিরে এল ছেলে। 
সব শুনে, দৈত্য ভারি খুশি। বলল-- সুযোগ ছিল হাতে। তবুও ফুল না তুলে, ফিরে এসেছ এত দূর। ভারি খুশি হয়েছি। এমনটা দেখা যায় না দুনিয়ায়। সুন্দরী মেয়ের কাছে পৌঁছানোর উপায় বলে দিচ্ছি তোমাকে। 
--বাগানের একেবারে ঈশান কোণে যে গাছ, সেটা থেকেই একটা ফুল তুলবে। সেই ফুল হাতে নিয়ে ঢুকবে প্রাসাদে। ফুল হাতে থাকলে, সমস্ত দরজাই খুলে যাবে সামনে দাঁড়ানো মাত্র। 
ছেলে বলল—সে প্রাসাদে তো অনেক কুঠুরি। কোথায় পাবো সে মেয়েকে। কোথায় থাকে সে? 
--মহলের পর মহল পার হবে। একেবারে অন্দর মহলে থাকে মেয়েটি। তারও একেবারে ঈশান কোণের কুঠুরিতেই তার আস্তানা। আরও শোন, দেখবে সোনার পালঙ্কে ঘুমিয়ে আছে সে। যদি জাগাতে চাও, তার হাতের আংটি খুলে নিতে হবে তোমাকে। যদি পারো, তবেই জাগবে সে। তখন ফুল তোলার অনুমতি চাইবে তুমি। 
আবার সেই প্রাসাদে এসে হাজির হোল ছেলে। দৈত্য যেমনটি বলে দিয়েছে, ঈশাণ কোণের গাছ থেকে একটা ফুল তুলে, প্রাসাদে ঢুকে পড়েছে। 
হাতে ফুল। একটার পর একটা ফটক খুলে যাচ্ছে। একেবারে ঈশাণের কুঠুরির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দরজা খুলে গেল আপনা থেকেই। তাকিয়ে দেখে, দু’চোখ ছানাবড়া ছেলের। 
গরীব বাবা-মায়ের ঘুপচি কুঁড়েঘরে বড় হয়েছে সে। একটা কুঠুরিও যে এত বিশা্ল হতে পারে, ভাবতেই পারছে না। আর, কী রাজকীয় ভাবে সাজানো ঘরটা। মাঝখানে এই এত্তো বড় একটা সোনার পালঙ্ক। তাতে মখমলের বিছানায় শুয়ে আছে মেয়েটি। 
আহা, রূপ যেন ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে। চোখ ঝলসে যায় এমন। চেয়ে চেয়ে দেখছে ছেলে। কতক্ষণ বাদে হুঁশ ফিরে এল। বোন পথ চেয়ে আছে বাড়িতে। ফুল নিয়ে ফিরতেও হবে এতটা পথ। তার আগে অনুমতি নিতে হবে এই মেয়ের। তবেই না ফুল পাওয়া যাবে!
গুটি গুটি পায়ে পালঙ্কের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ছেলে। ভয়ে বুক দুরুদুরু। তবুও সাহস করে আংটি খুলতে লাগল। কী সৌভাগ্য, খুলেও গেল বেশ সহজেই। 
এদিকে তখনই এক কাণ্ড। যেই না হাতের আংটি খুলেছে, অমনি চোখ খুলে উঠে বসল মেয়ে। অপলকে চেয়ে আছে  সামনের ছেলেটির দিকে। পাতা পড়ছে না চোখের। 
কতক্ষণ পরে মেয়েটি তার পরিচয় জানতে চাইল। এখানে কী করে  এলো, কেন এসেছে এসব জানতে চাইল। ছেলেটি বলল— ঘরে একা একা থাকে আমার বোন। মন খারাপ হয়ে যায় তার। বোনের জন্য একটা পপি ফুল নেব। দয়া করে অনুমতি দাও আমাকে। 
সুন্দরী মেয়ের মুখে মিষ্টি হাসি। বলল—আমিও তো একা একা থাকি এখানে। মানুষজন কেউ নাই কোথাও।  আমারও মন খারাপ হয় খুব। তার কী হবে? 
এ কথার কী জবাব দেবে ছেলে? জবাব দেবার আছে কী তার? চুপ করে আছে। সুন্দরী মেয়ে বলল—কী গো, কিছু বলছ না যে।
ছেলে বলল—তুমি এখানে একা একা থাকো। তাতে আমি কী করতে পারি?  
--কেন, আমাকে নিয়ে যেতে পারো তোমার সাথে। 
শুনে তো মাথা ঘুরে গেল ছেলের। বলে কী এ মেয়ে? জবাব দিল—আমার সাথে যাবে? লোকে কী বলবে তোমাকে? আমিই বা কী জবাব দেব লোকের কথার?
মেয়েটি হেসে আকুল। বলল—কেন গো, বলবে আমি তোমার বউ। পারবে না বলতে? 
ছেলে বলল—কী করে পারব? খেতে দিতে পারব কী করে তোমাকে? গরীবের ছেলে আমি। ভাইবোনেরই রুটি জোগাড় করি কোনমতে। তোমাকে কী খাওয়াব?
মেয়েটির মুখে আবার হাসি। বলল—নিজেকে চেনো না তুমি, তাই এসব বলছো। আসলে এক রাজার ছেলে তুমি। কপাল দোষে এই দশা হয়েছে তোমাদের ভাইবোনের। আমাকে নিয়ে চলো, কপাল ফিরে যাবে তোমাদের। 
অনেক কথার পর, ছেলে রাজি হোল। মেয়েকে সাথে নিয়ে ঘরে ফিরে চলল। ঘরে ফিরে বোনের কী আনন্দ, কী আনন্দ! ভাই ফুল তো এনেছেই। সাথে একজন মেয়েকেও এনেছে। কথা বলবার একজন কেউ তো হোল। 
পরের দিন রাজা আবার এসেছে কফি দোকানে। ফেরার সময় বলল—শোন হে। এ রাজ্যে তো তুমি নতুন। তোমার কারণেই এমন উপাদেয় কফি খেতে পারছি। কাল তোমরা রাজবাড়িতে এসো। নেমন্তন্ন করে গেলাম। ভোজসভার আয়োজন করেছি তোমাদের জন্য। 
বড় আর ছোট দুই রানিও শুনল, ভাইবোন দুটোকে নেমন্তন্ন করে এসেছে রাজা। ভোজসভার আয়োজন হবে কাল। বড়র তো বাজ ভেঙে পড়ল মাথায়। সে বলল—সর্বনাশ। সব যদি ফাঁস হয়ে যায়?
মেজো বলল-- সর্বনাশ কোথায়? বরং মওকা এসে গেছে হাতে। কালকেই নিকেশ করে ফেলব দুটোকে।
দুজনে মিলে পায়েস বানাল নিজের হাতে। গোপনে বিষ মিশিয়ে দিল খাবারে। চেটেপুটে খাবে, আর মরবে ভাইবোন দুটো।
পরদিন ভোজসভা বসেছে। খাবার দাবার সাজানো হয়েছে টেবিলে। পায়েসের পাত্রও সাজিয়ে দিয়েছে দুই রানি। টেরটিও পায়নি কেউ।  
গল্পসল্পও চলেছে খাবারের সাথে সাথে। রাজা বলল—তুমি তো এই শহরে একেবারে নতুন। চিনিই না তোমাকে। পরিচয়টা কী, বলো তো তোমাদের। আগে তো দেখিনি কখনও। এলে কোথা থেকে? 
ভাইবোনের সাথে সুন্দরী মেয়েটিও এসেছে ভোজের আসরে। সে বলল—রাজামশাই, এ তেমন কিছু জানে না নিজের সম্পর্কে। কেবল জানে, দুজন গরীব বাবা-মায়ের কাছে বড় হয়েছে। তারপর, একটা যাদু লাগামের গুণে দেখা হয়েছে আমার সাথে। এটুকুই জানে এ।
রাজা বলল—তুমি অতশত জানলে কী করে? সবে তো কালই এসেছ?  
মনে মনে হাসল মেয়েটি। মুখ কিছু বলল না। বলল—জানব না কেন? পাহাড়ের কত উপরে থাকি আমি। সকলের সব কাজকর্ম দেখতে পাই অপর থেকে। এমনকি গোপনে করা সবার কুকর্মগুলোও দেখতে পাই আমি। 
রাজা বলল—তাহলে তুমিই বল, নতুন কিছু যদি জানা থাকে তোমার। 
মেয়েটি বলতে থাকল—এই দুটি ভাইবোনের মা ছিল এক দেশের রাজার ছোট রানি। জন্মের পরেই, দুজনকে মেরে ফেলবার জন্য, দুই সৎমা বাক্সে ভরে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। এক গরীব জেলে বুড়ো-বুড়ি সেই বাক্স থেকে এদের দুজনকে পেয়েছিল। 
আরও একটা কথা। বিধাতার নিজের হাতে আঁকা একটা করে তারা আছে ভাইবোন দুজনের কপালে। এ দুনিয়ায় আর কারো কপালে এমনটা দেখা যাবে না। 
রাজার বুঝতে কিছু বাকি রইল না। ভারি আনন্দ এখন রাজার মনে। এমন দুটো ছেলেমেয়ে তার নিজের সন্তান! বিশ্বাসই হতে চাইছে না রাজার। বলল—কিন্তু আমারই দুই রানি এমন পাষণ্ডের কাজ করেছে, বিশ্বাস করি কী করে? 
মেয়ে বলল—অন্যের কথা বিশ্বাস করতে হবে না। নিজের চোখে দেখে, বুঝে নিন যা বুঝবার।
রাজা বলল—বলো, কী করতে হবে?
--এই টেবিলেই পায়েসের পাত্র সাজানো আছে। আপনার দুই রানি নিজের হাতে রেঁধেছে যত্ন করে। এক চামচ করে পায়েস খেতে বলুন দুজনকে। 
সাক্ষাৎ মৃত্যুর সামনে পড়ে গেছে দুজনে। তারা চেঁচিয়ে উঠল-- খাব না, খাব না। 
তা শুনে রাজা চমকে গেল। পাত্র-মিত্র যারা ছিল, সবাই চমকে গেল। রাজা বলল—কেন খাবে না? তোমরা তো নিজেরাই রেঁধেছ? 
মেয়েটা ভারি মজা পেয়ে গেছে। সে বলল—কাউকে খেতে হবে না। আমি দেখাচ্ছি ব্যাপারটা।
হোলই বা রাজার বাড়ি। ভোজসভা হচ্ছে, বেড়াল থাকবে না, তা আবার হয় নাকি? এক চামচ পায়েস ফেলে দেওয়া হোল একটা বেড়ালের সামনে।

🍂

এতটুকু একটা পুঁচকে জীব বেড়াল। কতটুকু জীবনই বা তার। যেই না পায়েস মুখে তুলেছে, সাথে সাথেই গড়িয়ে পড়ে গেল বেচারা।
রাজা লাফিয়ে উঠেছে—তবে রে, হতচ্ছাড়ির দল। এত শয়তানি বুদ্ধি তোদের পেটে পেটে? আবার একবার মারতে চেয়েছিলি ছেলেমেয়ে দুটোকে? এই পায়েস খাইয়েই মারব তোদের। 
মেয়েটা বলল—ওদের দোষে, আপনি কেন পাপ কাজ করতে যাবেন? এক কাজ করুন। গরাদে ভরে দিন দুজনকে। দিনে একবার করে খাবার পাঠিয়ে দেবেন। ধুঁকে ধুঁকে হলেও, বেঁচে থাকবে। যত দিন বাঁচবে, শাস্তি পেতেই থাকবে। এক দিনেই মেরে ফেললে, শাস্তিটা হবে কী করে? 
সাধু সাধু করে উঠল সকলে। সেই বন্দোবস্তই হোল। বড় আর মেজো দুই রানিকে অন্ধকার গরাদে ভরে দেওয়া হোল। সেদিন থেকে বাইরের আলো আর দেখতে পেল না তারা।
আর ছোটরানি? পথে পথে ভিক্ষা করে বেড়ায় সেই দুঃখিনী। খুঁজে খুঁজে রাজবাড়িতে তুলে আনা হোল তাকে। রানির আসনে বসানো হোল ছোটকে। সুখের দিন ফিরে এল তার জীবনে। 
সারা রাজ্যে ঢেঁড়া পিটিয়ে, সুন্দরী মেয়েটির সাথে নিজের ছেলের বিয়ে দিল রাজা। 
ভারি ধুমধাম করে বিয়ের আসর বসেছে। রাজা ছোটরানিকী বলল—বিয়েবাড়ির আসর ভাঙলে, আমার কাজ শেষ। এবার আমার ছেলেই বসবে রাজার সিংহাসনে। আমার ছুটি। 
রানি হেসে বলল—ছুটি? কী কাজ করবে তুমি ছুটি নিয়ে? 
রাজা হেসে বলল—বলো কী রানি? কাজ নাই আমার? রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে বেড়াব। একটাই মেয়ে আমার। কতদিন আদর যত্ন পায়নি বেচারি। তার জন্য ভালো মতন একটা রাজপুত্র খুঁজে আনতে হবে না? তুমি তার কপালে তারা এঁকে দিয়েছ। তার জন্য সোনার টুকরো ছেলে খুঁজে আনব আমি।

Post a Comment

0 Comments