জ্বলদর্চি

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও তাঁর দেশপ্রেম(দ্বিতীয় পর্ব ) /তনুশ্রী ভট্টাচার্য

মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও  তাঁর দেশপ্রেম
(দ্বিতীয় পর্ব )
তনুশ্রী ভট্টাচার্য 

তাঁর দেশপ্রেম বুঝতে গেলে তাঁর মননটি বুঝতে হবে।মধুসূদন ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য বোধে উজ্জ্বল এক মানুষ।সেই সময়ে হিন্দু স্কুলের উজ্জ্বল ছাত্র। কবি ও অধ্যাপক  ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসনের কাছে শেক্সপীয়ার মিল্টন পড়া  শোনা ব্যাখার মাধ্যমে তার একটা নিজস্ব বোধ তৈরি হচ্ছে। ইংরেজির সাহিত্যের প্রতি তার তীব্র আকর্ষণ জন্মাচ্ছে। ইংরেজী ক্ল্যাসিকসের ভক্ত হচ্ছেন। ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। ইংরেজি ছাড়াও প্রায় 11 টি ইউরোপীয় ভাষা তিনি জানতেন। ইংরেজী ভাষাটা আয়ত্ত করছেন আর মনে মনে তীব্রবাসনা ইংরেজী তে সাহিত্য রচনা করবেন। ষোলো বছর বয়সে ইংরেজীতে কবিতা লিখছেন। তুখোড় ভাবে ইংরেজীতে সাবলীল। listening  speaking reading writing ---চারটি skill ই তার আয়ত্ত---তবে কেন তিনি এ ধারণা পোষণ করবেন না যে তিনি ইংরেজি তেই সাহিত্য চর্চা করবেন? তাঁর সহপাঠীরা কেউ তাঁর সঙ্গে ইংরেজীতে এঁটে উঠছেন না।শুধু ইংরেজী ভাষায় সাহিত্য রচনা করবেন সঙ্গে পাশ্চাত্যের যাপন অভ্যাস প্রিয় হয়ে উঠছে ক্রমশ:--  --এই দৃঢ়তায়   ধর্মান্তরিত হচ্ছেন। হিন্দুস্কুল ছাড়তে হলো সে কারণে। বিশপস কলেজে গেলেন।বন্ধুদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরী হচ্ছে।  কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎই কলকাতা থেকে  মাদ্রাজে চলে গেলেন।এই সব কিছুর মধ্যেই একটা স্বাধীন সত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। কলকাতা থেকে মাদ্রাজ, ভারত থেকে ইংল্যান্ড ইংল্যান্ড  থেকে ফ্রান্স, ফ্রান্স থেকে আবার কলকাতা রেবেকা থেকে হেনরিয়েটা---এই  গতায়াত নির্দেশ করে তার স্বাধীন চিন্তাভাবনার মানচিত্রটি।তাঁর যাপনের বৈচিত্র্যের মতো সাহিত্যের ধারায় বিচরণটিও সাহসী এবং বৈচিত্র্যময়।
মাদ্রাজে বসে  লিখলেন এ ভিসন অফ দ্য পাস্ট, দ্য ক্যাপটিভ লেডি কাব্যগ্রন্থ।ভাষাটি বিদেশি কিন্তু তার মূল বিষয়বস্তু একেবারে ভারতীয় ইতিহাস। নিজের দেশের অতীতের ইতিহাস কে তিনি ইংরেজি ভাষায়  রচনা করে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরচ্ছেন। এই ই তো দেশপ্রেম। রাজপুত জাতির ইতিহাস বাঙালিকে চিরকালই প্রভাবিত করে। মাইকেলকেও করেছে।  পৃথ্বীরাজ সংযুক্তার কাহিনী নিয়ে এই ক্যাপটিভ লেডি ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার পর তুমুল আলোড়ন না পড়লেও বেথুন সাহেব এর প্রশংসা করেন এবং তাকে ইংরেজিতে না লিখে এই প্রতিভা দিয়ে  মাতৃভাষায় লেখার অনুরোধ করেন। তিনি  মাইকেলকে বললেন ইংরেজী সাহিত্যে আর একজন বায়রণ বা শেলী লাগবে না বরং এই প্রতিভা বাংলা সাহিত্যের বিপুল উন্নতি ঘটাবে ।প্রসঙ্গত রোমান্টিক  কবি বায়রণ ছিলেন মাইকেলের প্রিয় কবি। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন বেথুনের কথামতো  মাতৃভাষাতেই সাহিত্য রচনা করবেন । এই তো দেশপ্রেম ।ভাষাপ্রেমের মোড়কে দেশপ্রেম। যে ইংরেজী ভাষার ও সাহিত্যের প্রতি তীব্র আবেগে তিনি ধর্মান্তরিত হলেন,ত্যাজপুত্র হলেন , কলকাতা ত্যাগ করলেন---সেই ইংরেজী ভাষার প্রতি টান ছেড়ে দিয়ে তিনি বাংলা ভাষাকে আঁকড়ে ধরলেন  এক লহমায় । বেথুনের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে এতটুকু দ্বিধা করলেনন না। 
🍂

সংস্কৃত শিখলেন আরো ভালো করে। মাদ্রাজে আট বছর থাকাকালীন কঠোর নিষ্ঠায় তিনি ভারতীয় ক্লাসিক্স ভাষাগুলো তামিল সংস্কৃত,এমনকি তেলেগু ,সঙ্গে হিব্রু ল্যাটিন  শিখলেন। বন্ধু গৌরদাস বসাককে চিঠিতে জানাচ্ছেন যে রুটিন মেনে তিনি সমস্ত ভাষা শিক্ষা করছেন। সেখানে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় আবার ইংরেজিতেও লিখছেন। নিজের দেশের জিনিসকে তুলে ধরা এটাই তো দেশপ্রেম। প্রথম যৌবনে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন রাজমোহনস ওয়াইফ। একটি কথা বলে  নেওয়া দরকার যারা ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করেন সেই দু:সহ আঠেরো বছর বয়: সন্ধিক্ষণে  যৌবনকালে শেখার তীব্র উদগ্র বাসনা বিস্তারিত হওয়ার কালে ইংরেজি সাহিত্যের মাদকতা থেকে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন বরং সেই নেশায় যুক্ত হয়ে ইংরেজিতেই সাহিত্য রচনা করবেন এইরকম একটা ধারণা গড়ে ওঠেই। বঙ্কিমচন্দ্রও নিজেকে দূরে রাখতে পারেননি। মধুসূদন ত  নয়ই।   হিন্দু কলেজের ডেভিড  লেস্টার রিচার্ডর্চনের কাছে তিনি ইংরেজি শিক্ষা করেছেন। শেক্সপিয়ার মিলটন হোমার দান্তে পেত্রার্ক ট্যাসো ভার্জিল ওভিড-----  সব আত্মস্থ করার পর ইংরেজীতে সাহিত্য সৃষ্টি করতে চাওয়া তাঁর মতো প্রতিভাধর মানুষের কাছে খুবই সাধারণ ব্যাপার। তিনি বিষয় বেছে নিচ্ছেন  আদ্যন্ত ভারতীয়  আর ভাষা বেছে নিচ্ছেন ইংরেজী। এটাও দেশপ্রেমের পরিচায়ক। ইওরোপীয় সংস্কৃতির অনুরাগী মানুষ প্রথম কাব্য রচনা করছেন ভারতীয় বিষয় নিয়ে এর থেকে দেশপ্রেম আর কি হতে পারে!আবার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পরিবর্তনও করে নিয়ে বাংলা ভাষায় ফিরে আসছেন। এই মানুষের দেশপ্রেমের সংজ্ঞা চিরচরিত ধাঁচে ফেললে চলবে না।

 দেশপ্রেম মানে কি শুধু দেশ ভক্তির গদগদ বা জ্বালাময়ী  কিছু কাব্য রচনা করা   দেশকে কতটা ভালোবাসি তার এদিক-ওদিক কিছু প্রমাণ দেওয়া? দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নিজের চিন্তার অগ্রবর্তী করে তোলা‌ সমাজকে এগিয়ে রাখা সমকাল থেকে এগিয়ে থাকা মানুষ কি দেশে প্রেমিক নয়? বিশ্বের সঙ্গে সমতালে পা ফেলার চেষ্টা সমাজকে নতুন ধারনা দেওয়া কি দেশপ্রেম নয়?  সেই অর্থে মধুসূদন কে আমরা সর্বপ্রকারে একজন দেশপ্রেমিক বলতে পারি। তার দেশপ্রেম আমরা মাপতে পারি না। তার  যে মহাকায় সত্তা ,যেভাবে তিনি মেঘনাদবধ কাব্যে চিরায়ত ধারণাকে উল্টে  রাবণ মেঘনাদ কে বীর রসে জারিত করে দেশের জন্য আত্মাহূতি দেওয়া দেশপ্রেমী হিসাবে  উপস্থাপন করলেন   রাম কে আগ্রাসনকারী দেখালেন     ( সাগরপেরিয়ে আসা রাম আর সাগর পেরিয়ে আসা ইংরেজ কোথাও কি মিশেছে? ) সেখানে তাঁর দেশপ্রেমের আবেগটি খাঁটি।আবার যদি দেখি প্যারাডাইস লস্ট পড়া কবি এই মহাকাব্যের আদলে গড কে নয় স্যাটার্ন কে হিরো করার মিল্টনীয় দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েছেন। সেই মানুষ বেশী শ্রদ্ধা পান যিনি ধ্বংস বা পতন জেনেও লড়াই ছাড়েন না। ওখানে ফল অফ স্যাটার্ণ এখানে ফল অফ রাভন কিন্তু indomitable spirit ই শেষ কথা। দেশপ্রেম ত একটা স্পিরিট।যুগযুগ ধরে মানুষকে টানে। মানুষকে উজ্জীবিত করে।মেঘনাদবধ কাব্য পড়ে  পরাধীন মানুষ লড়াইয়ের শক্তি পান দ্রুতিময় ও দ্যূতিময় ভাষার লাবণ্যে ঝংকারে মানুষ দেশপ্রেমী হয়ে উঠেছেন।।এখানেই নিহিত আছে মধুসূদনের দেশপ্রেম।বিবেকানন্দের খুব পছন্দের ছিল এই কাব্য। তিনি বলতেন এই শব্দ সুষমা বা শব্দ ঝংকারে একটা রাজসিক ভাব জাগে। রক্ত গরম হয়। এই উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলা কাব্য গ্রন্থটি সেই সময়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটের সিলেবাসে অন্তুর্ভুক্ত হয়েছিল ।  
বীরবাহু বা মেঘনাদের স্বদেশ চেতনার সঙ্গে  ক্ষুদিরাম বিনয় বাদল দীনেশ প্রফুল্লচাকী সূর্যসেনের  কোনো পার্থক্য নেই। দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করা,দেশের স্বাধীনতা বজায় রাখা তাদের একমাত্র লক্ষ্য।রাবণ জানেন তার পতন তবুও তিনি তেজস্বী। লড়াই ছাড়েন না। আমরাও ত জানতাম না আদৌ ইংরেজদের তাড়াতে পারবো কিনা দেশকে স্বাধীন করতে পারব কিনা কিন্তু লড়াই তো আমরা ছাড়িনি। এটাই তো দেশপ্রেম।এই attitude  এই mentality  তাঁরই দান।।মধুসূদন এখানেই আমাদেরকে হাতে ধরে সাবালক করে তুলেছেন প্রেরণা দিয়েছেন। সেই সময় রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা "স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায় দাসত্ব শৃঙ্খল বলো কে পরিবে পায় হে কে পরিবে পায় "----এই শ্লোগানধর্মী দেশাত্মবোধক কবিতা লেখা হয়ে গেছে। কিন্তু  মাইকেল যে চিন্তন প্রক্রিয়ায় অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি তো এভাবে লিখবেন না। এখানেই তিনি অনন্য।গোলাম মুর্শিদ বলছেন তাঁর মেঘনাদকে আজ পর্যন্ত বধ করতে পারে নি কেউ। কারণ আর একজন মধুসূদন জন্মান নি এখনো। 

(চলবে )

Post a Comment

0 Comments