এআই থেকে রেহাই - কল্পকাহিনী
পর্ব ৬। মাথার ভিতর চলেছে কল
বাসুদেব গুপ্ত
অনির্বাণ মাথা নাড়তে বিশু খ্যাপা আবার শুরু করেন।
-এ, আই, মানে এ প্লাস আই। সবার আগে তোকে বুঝতে হবে আইটা কি। আই মানে ইনটেলিজেন্স বা বুদ্ধি। সেটা কি? বিজ্ঞানের মতে, আমাদের ব্রেনের ফ্রন্ট লোবে যে কেমিকাল কম্পিউটিং প্রসেস চলছে তার একটা বুদ্ধি শব্দটা তার এক বর্ণনা মাত্র। আর এআই হল কৃত্রিম আই, আসল আই কে নকল করার এক টেকনলজি। আইতে আছে ব্রেন আর ব্রেন সেল। এআইতে সেই ব্রেন সেলের বদলে বসিয়ে দেওয়া কম্পিউটার জিপিইউ আর নিউরনের বদলে বসিয়ে দেওয়া আর্টিফিসিয়াল নিউরাল নেটের একটা করে গাঁট বা কৃত্রিম নিউরন।
-নিউরন ব্যাপারটা কি একটু বলবে?
দাদু একটা ইন্গিত করে আন্গুলে দিয়ে, ট্রান্সপেরেন্ট একটা স্ক্রীনে কতগুলো অশরীরি অদ্ভুত দেখতে ছবি ফুটে ওঠে।
-অদ্ভুত। না ভাইরাস না ব্যাকটিরিয়া এগুলো কি?
-তোর মাথা।
হাসতে গিয়ে দাদু থেমে গম্ভীর হয়ে যান।
-হ্যাঁ এগুলোই নিউরন। এই গোল গোল ভূতুড়ে জিনিসগুলো। আর এর থেকে যে অসংখ্য সরু সরু শুঁড় বেরিয়ে অন্য নিউরনের ভেতর ঢুকে গেছে তাদের নাম এক্সন আর ডেনড্রাইট। গোল জিনিষটার নাম সোমা। আর শুঁড়গুলোর গায়ে যে ইনসুলেশনের মত দেখতে তাকে বলে মাইলিন সিথ। সিথগুলোর মাঝে মাঝে উন্মুক্ত পয়েন্টগুলোর নাম নোডস অফ রানভিয়ে ।
অনির্বাণ এই ছবি বায়োলজির বইতে দেখেছে যদিও মনে নেই অর্থাৎ ওর লোকাল মেমরিতে নেই। একটু অধৈর্য হয়ে দাদুকে বলে
-তুমি যে আমাকে বায়োলজি বোঝাতে বসলে। এর সংগে এআইএর কি সম্পরআরে দাঁড়া বলছি। -তুইও একটা কফি নিয়ে বোস। অনেক বোঝার আছে। তুই নিশ্চয় জানিস নিউরন বা নার্ভ সেলেই ব্রেনের যাবতীয় কাজ। এদের তুই ইনটেলিজেন্স সেন্টারও বলতে পারিস।
-এরকম কত আছে মাথায়?
--প্রায় দশ হাজার কোটি। ৯০ বিলিয়ন বলতে পারিস। এই এক্সন হল ব্রেনের আউটপুট কেবল। এরা লম্বায় এক মিলিমিটার থেকে এক মিটারও হতে পারে। এবার ছোট্ট করে বলি নিউরন কি ভাবে কাজ করে। বাড়ী তৈরী হবার সময় ছাদ ঢালাই দেখেছিস? লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রমিকরা। এক জায়গায় সিমেন্ট মেশানো হচ্ছে। একজন একটা কড়া ভর্তি করে এগিয়ে দিচ্ছে সামনের লোককে। সে তার সামনে সে আবার তার সামনে। এভাবে কড়া ভর্তি সিমেন্ট পৌঁছে যাচ্ছে এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। তবে এটা একটা সহজ উদাহরণ। মাঝের লোকগুলো কোন ডিশিসন নিচ্ছে না শুধু ফরওয়ার্ড করে যাচ্ছে।
-হোয়াটসাপ যেমন হয়?
-তাই এবং তার থেকে অনেক বেশি। একটা নিউরনের কাছে সিগনাল আসছে একটা বা অনেকগুলো নিউরন থেকে। ইনপুট কেবল বা ডেনড্রাইটের কাজ সেগুলো আনা, এনে তুলে দেওয়া নিউরনের হাতে। এভাবে একটা নিউরনে অনেক সিগনাল আসছে। সিগন্যালগুলো জুড়ে জুড়ে তাদের জোর বাড়ছে। বাড়তে বাড়তে একসময় আসবে যখন নিউরনটির সহ্যক্ষমতা পেরিয়ে যাবে। বা অন্যভাবে বলা যায় সে বুঝতে পারবে সিগনালগুলোর সিরিয়াসনেস। কিছু একটা করতে হবে। তখন সে তার এক্সন দিয়ে সামনের নিউরনদের পাঠিয়ে দিচ্ছে নতুন সিগনাল। সেই সিগনাল বৈদ্যুতিক পালস বা স্পন্দন হয়ে নোডস অফ রানভিয়ে হয়ে লাফাতে লাফাতে চলে যাচ্ছে তার সংগে জুড়ে থাকা অন্য নিউরনের ডেন্ড্রাইটে। মানুষের সেরিব্রাল কর্টেক্সে 16 বিলিয়ন নিউরন থাকে। কিন্তু প্রতিটি নিউরন 1000টি ডেনড্রাইট এবং অ্যাক্সনের সাথে সংযোগ করতে পারে। ব্রেনের আয়তন ধর মাত্র ১২৫০ সিসি হবে। শুধু কতগুলো কানেকশান বা যোগ হতে পারে এই নিউরনগুলোর মধ্যে একবার ভাব। এইটুকু মাথা, তার মধ্যেই যেন একটা ছোট্ট ব্রহ্মান্ড।
এইভাবে পায়ে কাঁটা ফুটলে সেই ব্যথার সিগন্যাল চলে আসছে ব্রেনের ওপর তলায়। সেখান থেকে আবার হাজার হাজার ডেনড্রাইট এক্সন হয়ে নতুন সিগনাল নেমে যাচ্ছে পায়ের পেশীতে, কোন পেশী সঙ্কুচিত হচ্ছে, কোন পেশী ফুলে উঠছে। আর ঠিকঠাক পা ছিটকে সরে যাচ্ছে কাঁটা থেকে। এটা একটা সরল উদাহরণ। কিন্তু ধর তোর সামনে এক সুন্দরী মেয়ে এসে হাজির হলো। তোর মনে হঠাৎ ফুর্তি এলো, চোখ ঘুরে গেল সে দিকে, একটা প্রেমের গান মনে পড়ে গেল, এ সবই ঐ নিউরনের কামাল। বুঝলি, কাব্য টাব্য কিছু না।
দাদু হঠাৎ রসিক হয়ে অনির্বাণকে অস্বস্তিতে ফেলে দিলো।
-দাদু এ ছাড়া তুমি আর উদাহরণ পেলে না, অনির্বাণের জোরালো অনুযোগ।
-যাই হোক দেখলি তো কি সরল একটা সিস্টেম দিয়ে আমাদের আমাদের এই জটিল মাথাটা চালিয়ে যাচ্ছে আমাদের সব কিছু।
কম্পিউটার বিজ্ঞানীদের অনেকদিনের লোভ এই ব্যাপারটা প্রোগ্রাম বা কোড করার। সেই নিয়ে গবেষণা করতে করতে একদিন তৈরী হলো আর্টিফিস্য়াল নিউরাল নেট। আর তার হোতার নাম ফ্রান্ক রোজেনব্লাট। তিনি ছিলেন আদতে সাইকোলজিস্ট। তবে খুব করিৎকর্মা। ১৯৫৭ সালে কর্নেল এরোনটিকাল ল্যাবে তিনি বানালেন পারসেপ্ট্রন নামে একটি যন্ত্র।
🍂
প্রথমে এটা পরীক্ষা করা হলো আইবিএম ৭০৪ কম্পিউটারে একটা প্রোগ্রাম লিখে। তারপর সেটাকে রূপ দেওয়া হয় একটা আলাদা মেসিনে। মেসিনটা বানাবার উদ্দেশ্য ছিল পিকচার আইডেন্টিফিকেশান। ফটো দেখে সনাক্ত করা, চিনতে পারা এটা কার ছবি। এখনো সে মেসিনটা রাখা আছে স্মিথসনিয়ান হিস্টরি মিউজিয়ামে। তবে মিউজিয়ামটায় বোধহয় আর কেউ যায় না। ভারচুয়াল ট্যুর চালু হয়ে গেছে তো। আমারা যখন প্রথম দেখতে পাই সে প্রায় ৬০ বছর আগে। খুব উত্তেজিত হয়েছিলাম। দাদু খানিকক্ষণ চুপ করে পুরনো কথা ভাবতে বসে যাচ্ছে দেখে অনির্বাণ তাড়া দেয়।
-থামলে কেন? আমারও তো খুব একসাইটেড লাগছে। আজকের এই টেকনলিজকাল সভ্যতার তো সেই শুরু।
-মেসিন মানে তো একসময় আমরা বুঝতাম বড় বড় কম্পিউটারচালিত যন্ত্র।
দাদু আবার শুরু করে।
-যা লোহা বা স্টীল কাটছে, তৈরী করছে নানা আকারের ধাতব বা প্লাস্টিকের জিনিষ, চাকা, গীয়ার্, স্পিন্ডল, এক্সেল ইন্জিনের পার্টস সেরকম জিনিসকেই আমরা বলতাম মেসিন। আজকাল তো প্রায় সবই থ্রিডি প্রিন্টারে ছাপা হয়। মেসিন বলতে কম্পিউটারও বোঝাতো অনেকদিন। কম্পিউটারের নিজস্ব ভাষাকে বলত মেসিন ল্যাঙ্গুয়েজ।
সেই মেসিন পেল বুদ্ধি। একটু একটু করে শিশুর মত সে বড় হতে থাকলো তার বুদ্ধিও বাড়তে থাকলো চড়চড় করে। শোন তাহলে সেই গল্প।
(ক্রমশ)
আরও পড়ুন
0 Comments