দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে
আজ ২১শে জুন "বিশ্ব যোগ দিবস"। এই দিবস সম্পর্কে জানার আগে, আমাদের অবশ্যই জানতে ইচ্ছে করে, যোগ শব্দের অর্থ কি?
যোগ বলতে কি বোঝায়? তার ঐতিহ্যই বা কি? এই সকল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলাম।
'যোগ' ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত ঐতিহ্যবাহী শারীরবৃত্তীয় এবং মানসিক সাধনপ্রণালী। 'যোগ' শব্দটি দ্বারা হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের ধ্যানপ্রণালীকেও বোঝায়।
হিন্দুধর্মে,এটি হিন্দু দর্শনের, ছয়টি প্রাচীনতম শাখার অন্যতম। জৈনধর্মে যোগ, মানসিক, বাচিক ও শারীরবৃত্তীয় কিছু প্রক্রিয়ার সমষ্টি।
.যোগ বলতে বোঝায়,
জীবনে চলার এক পদ্ধতি। সংস্কৃত শব্দ 'যুজ' থেকে আহরিত 'যোগ' এর অর্থ হলো , একত্র হওয়া অর্থাৎ ব্যক্তি সত্তার সঙ্গে বিশ্ব সত্তার মিলন। যোগের জ্ঞান ৫০০০ বছরের পুরানো ভারতীয় জ্ঞান। যদিও অনেকেই মনে করেন, যোগ মানে শুধুই শারীরিক কসরৎ, যেখানে জটিল পদ্ধতিতে শরীরটাকে মুচড়িয়ে, ঘুরিয়ে, টেনে ফেলতে হয় এবং কিছু কঠিন শ্বাসের ক্রিয়া করা হয়ে থাকে, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।
যোগ ব্যায়াম করা স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভালো। যে ব্যক্তি নিত্যদিন যোগব্যায়াম করেন, তাঁর শরীর সাধারণত রোগ মুক্ত থাকে।
'যোগ' নিজেকে চারটি প্রধান পথ হিসাবে প্রকাশ করে, যথা- কর্ম যোগ, ভক্তি যোগ, রাজ যোগ এবং জ্ঞান যোগ । এই চারটি পথ গাছের ডাল বা নদীর উপনদীর মতো। তাদের সকলের উৎস একই।
'যোগ' বিদ্যায় শিবকে আদি যোগী বলে মনে করা হয়, অর্থাৎ ভগবান শিব ছিলেন, যোগের জনক। বেদ অনুযায়ী যোগ হলো, আত্মা ও পরমাত্মার মিলন। যোগ অহংকে ধ্বংস করে। যে মুহূর্তে মনের প্রবৃত্তি বন্ধ হয়ে যায়, তখনই যোগের কনা শুরু হয়।
'যোগ সারায় রোগ’! এই প্রবাদ বহু প্রাচীন। বহু যুগ ধরে ভারতের বিশিষ্ট ঋষি-মুণিরা নিয়মিত যোগব্যায়াম করতেন। সুষম খাদ্যাভাস ও যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে সুস্থভাবে জীবনযাপন করতেন। শুধু তাই নয়, এই কারণে মন ও শরীর উভয়ই সুস্থ ও শক্তিশালী থাকতো,আর তাই ভারতে এখনও যোগ ব্যায়ামকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে দেশ ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বের দরবারেই এই যোগ-ব্যায়াম এক অন্য মাত্রা পেয়েছে। করোনা মহামারির সময় থেকেই, মানুষ নিজের শরীর নিয়ে বেশি সচেতন। তাই স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমেই সুস্থ ও সবল রাখার চেষ্টা করার প্রবণতা তৈরি হয়েছে,এই সকল কারণে প্রতি বছর ২১ জুন 'বিশ্ব যোগ দিবস' হিসেবে পালন করার মাধ্যমে প্রত্যেকে, নিজেকে একটু সুস্থ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে।
মানুষের সাফল্য আসে তিনটি জিনিস থেকে, সেগুলো হলো সম্পদ, খ্যাতি ও মানসিক শান্তি। এই তিন জিনিস যদি একজনের মধ্যে থাকে, তাহলে তিনি খুব সহজেই সাফল্য অর্জন করতে পারেন। মানসিক শান্তি পাওয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো, যোগ ব্যায়াম। যোগ ব্যায়াম করার কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। যোগ ব্যায়াম শুধুমাত্র দীর্ঘায়ু হতে নয়, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে, মনকে শান্ত ও মজবুত করতেও সাহায্য করে।
আন্তর্জাতিক যোগ দিবস (IDY), বা অন্তররাষ্ট্রীয় যোগ দিবস হলো, একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান, যা সারা বিশ্বে ২১শে জুন ২০১৫ সালে সূচনা হওয়ার পর থেকে উদযাপিত হয়ে আসছে।
IDY-এর ধারণাটি প্রথম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইউএনজিএ-তে তাঁর বক্তৃতার সময় প্রস্তাব করেছিলেন। এরপর২৭শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪সালের পরে, IDY১১ই ডিসেম্বর,২০১৪সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ (UNGA) দ্বারা সর্বসম্মতভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল।
যোগ হলো একটি শারীরিক, মানসিক এবং আধ্যাত্মিক অনুশীলন যার বেশিরভাগই ভারতে রয়েছে। ২১শে জুন তারিখটি প্রধানমন্ত্রী মোদী তার জাতিসংঘের ভাষণে প্রস্তাব করেছিলেন কারণ এটি উত্তর গোলার্ধে বছরের দীর্ঘতম দিন এবং বিশ্বের অনেক অংশে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত বছর, লখনউ শহরের মন্টেসরি স্কুলের ৭২ জন ছাত্র এবং শিক্ষক আন্তর্জাতিক যোগ দিবস উপলক্ষে, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরে যোগ ব্যায়াম করেছিলেন।
২০১৮সালে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, দেরাদুনে আয়োজিত যোগ ব্যায়ামের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ইভেন্টে প্রায় ৬০০০০ লোকের সমাগম হয়েছিল।
যোগ দিবসের ইতিহাস খানিকটা এইরকম ছিলো,
দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বক্তৃতায় প্রথমবার আন্তর্জাতিক যোগ দিবস পালনের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ১৭৭ টি দেশও এই প্রস্তাবে সমর্থন করেছিল। তারপর ২০১৫ সালের ২১শে জুন প্রথবারের মতো পালন করা হয় যোগ দিবস। বিশ্বজুড়ে প্রচুর মানুষ এই দিনে ব্যায়াম করে পালন করেছিলেন 'আন্তর্জাতিক যোগ দিবস’। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য রেখে বলেছিলেন, 'যোগ আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য,এটি দেহ ও মনকে শান্ত রাখে'। যোগের মাধ্যমেই দেশ-বিদেশের যোগীরা একে অপরের সঙ্গে সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রচার করেন। তাই প্রত্যেকের উচিত যোগ ব্যায়াম করা।এরপর ২০১৫ সাল থেকে সারা বিশ্বে 'যোগ দিবস' পালিত হয়ে আসছে।
🍂
বিভিন্ন রোগ সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতি বছর যোগ দিবস পালিত হয়। এমনকি করোনা অতিমারির সময়ও বিশেষ ব্যবস্থা মেনে 'যোগ দিবস' পালিত হয়েছিল।
প্রত্যেকটি দিবসের একটি করে প্রতিপাদ্য বিষয় বা থিম থাকে, যেমন,
২০২২ সালের থিম ছিলো, 'নারীর ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যোগ দিবস'। যোগ ব্যায়াম করলে রোগ মুক্ত থাকা যায়। এতে নারীরা, শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ থাকতে পারবেন। মানসিক শান্তি প্রদানের জন্য, নিত্যদিন প্রত্যেকে করতে পারেন যোগব্যায়াম।
২০২৩ সালের থিম ছিলো, 'মানবতা'।
যোগ দিবস বিশ্বের মানুষের কাছে যোগের অনেক শারীরিক ও আধ্যাত্মিক উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে, এই দিবসটি পালন করা হয়।
চলতি বছর, এই বিশেষ দিনে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়েছে।
যোগ দিবস ২০২৪ এর থিম হলো,
‘নিজে ও সমাজের জন্য যোগ’। এই থিমটি যোগব্যায়ামের ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত উভয় দিককেই তুলে ধরে।
যোগ দিবসের তাৎপর্য বা গুরুত্ব অপরিসীম।
এই বিশেষ দিনের উদ্দেশ্য হলো,সকলের মধ্যে যোগ ব্যায়াম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। শুধু তাই নয়, মনকে ধীর, স্থির হতেও সাহায্য করে যোগ। সেই সঙ্গে দেশ, বিদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে জাগিয়ে তোলার জন্য বিশ্বজুড়ে ২১শে জুন সকলে পালন করে থাকেন যোগ দিবস।
যোগব্যায়ামের উপকারিতা সম্পর্কে বলা যায় যে,
যোগব্যায়াম স্ট্রেস, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতা কমাতে সাহায্য করে, এছাড়াও একাগ্রতা এবং মানসিক অবস্থার উন্নতি করে।
এটি পেশীগুলির নমনীয়তা উন্নতি করে।
যোগাসন করলে, হজম ঠিক থাকে। এটি পেট সংক্রান্ত সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।
অভ্যন্তরীণ অঙ্গ শক্তিশালী করে।
হাঁপানি, ডায়াবেটিস এবং হার্ট সংক্রান্ত সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যায়।
ত্বকের উন্নতি ঘটে।
একাগ্রতার উন্নতি ঘটায়, মন এবং চিন্তা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
উদ্বেগ, মানসিক চাপ এবং বিষণ্নতা থেকে মুক্তি দেয়।
এক কথায় বলতে পারি যে, প্রত্যেককে ব্যস্ত জীবন থেকে কিছু সময় বের করে অবশ্যই যোগ ব্যায়াম করা উচিত, দেহ- মন সুস্থ রাখা ও আগামী ভবিষ্যৎকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য।
আরও পড়ুন
0 Comments