পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
ধ্যান গম্ভীর ঐ যে ভূধর… একপাশে খাদ, একপাশে খাড়াই পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে চলা গাড়ি,খানিক ভরা পেটে দিবানিদ্রার আয়েশ এবং আঁকাবাঁকা রাস্তার দুলুনিতে ঝিমঝিম ভাব, মনে মনে রবীন্দ্রনাথের কবিতার অনুরণন। এভাবেই কেটে গেছিল বাকি পথটুকু। অবশেষে সূর্য যখন তার শেষ আলোটুকু আকাশময় ছড়িয়ে বিদায়ে প্রস্তুত, চারিদিকের গাছপালা সে রঙে উজ্জ্বল,ওরা এসে পৌঁছেছিল ফুলছট্টির ছোট্টো ধর্মশালায়।
মনে আছে, সারাদিনের পথশ্রমে ক্লান্ত পিসিমাকে গরম জলে গা-হাত-পা মুছিয়ে খানিক চিঁড়ে মুড়ি আর গরম চা খাইয়ে ঘরের বাইরে এসে যখন দাঁড়িয়েছিল বিরজা, সন্ধ্যে গড়িয়ে আকাশে চাঁদের উদয় হয়েছে। ছোট্টো ধর্মশালাটির হাতায় গড়িয়ে আসা চন্দ্রালোকের মায়াবী ছায়ায় দৃষ্টি প্রসারিত করলে বড়ো বড়ো হাতির পিঠের মতো পাহাড়, কালো কালো মেঘের মতো পাহাড়… সমতলের কন্যা কি এক অনির্বচনীয় বিহ্বলতায় চেয়ে রইল, শুধু চেয়ে রইল নৈশব্দের আরাধনায় মগ্ন ধ্যান গম্ভীর সেই দেবতাত্মার দিকে,
'স্তব্ধতা উচ্ছ্বসি উঠে গিরিশৃঙ্গরূপে,
ঊর্ধ্বে খোঁজে আপন মহিমা।'....
মুগ্ধতার কি কোন ব্যাখ্যা হয়! প্রাপ্তির কি কোন সীমা হয়!
রেলিং ধরে সে কথা ভাবতে ভাবতে লক্ষ্যই করেনি,
পাশে কখন যে পাশে দাদা এসে দাঁড়িয়েছিলেন। খানিক গলা খাঁকারি দিয়ে তার দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন,
-’কি ভাবছো বোন! মনখারাপ করছে কারো জন্য!’
-’কার কথা ভাববো দাদা! কে আছে আমার!’
তারপরেই অবশ্য বাস্তবে ফিরে এসে সংশোধন করেছিলেন,
-’হ্যাঁ দাদা। বাড়ির কথা মনে পড়ছে। দাদা-বৌদি-ভাইপো…কে কেমন আছে!’
সামান্য হাসলেন প্রৌঢ় মানুষটি। তারপরে আত্মমগ্ন গলায় বললেন,
-’বুঝি বোন। সবই বুঝি। সংসার বড়ো মায়া। আমরা জড়িয়ে থাকতে চাই তার ছায়ায় বলেই তো সে ডাকে। তবু কখনো কখনো দড়ি ছিঁড়তে হয়,মনের কথা শুনতে হয়। সবাই তো আর এক পথের পথিক হয় না!...
বুদ্ধিমতী বিরজা বুঝতে পারছিলেন,বহুদিন পরে মাকে কাছে পেয়ে স্মৃতিমেদুরতা অথবা সঠিক সময়ে কর্তব্যকর্ম না করার অপরাধবোধ ক্লিষ্ট করছে মানুষটিকে,তাই এমন সব সময়ে শুভার্থী হিসেবে প্রসঙ্গান্তরে যাওয়াই শ্রেয়।
তাই তিনি ডাক দিলেন ঘরের ভেতরের বাকি সবাইকে।একে একে অরুন্ধতী,তার বর এবং ভাই, মেসোমশাই সবাই এলেন, এসেই দাদাকে বললেন জামাই মানুষটি,
-’দাদা,আমাদের ঘোরাঘুরির ভালোমন্দ নিয়ে একটু কথা হোক।আমরা তো একেবারেই নতুন এ পথে।’
তারই মধ্যে অরু জানালে,
-’মায়েদের তো পায়ে পিঠে ব্যাথা হয়েছে বেশ। কাল কি আবার আজকের মতো এতোটাই পথ, দাদা!’
-’কালকের পথ এ যাত্রার সবচাইতে কষ্টকর পথ। পুরোটাই হাঁটতে হবে। প্রায় কুড়ি কিলোমিটার রাস্তা’
-’ওটা কোন ব্যাপারই নয়। দৌড়ে চলে যাবো’
হাততালি দিয়ে বলে উঠলো এতক্ষণ চুপ করে থাকা কিশোর ভাইটি, বয়সে সে আমাদের বড়ো খোকার চাইতেও ছোটো।
🍂
দাদা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-’সমতলের রাস্তা আর পাহাড়ি রাস্তা এক নয় ভাই। কালকেই তুমি তা টের পাবে।’
-’আজ কতোটা এলাম আমরা দাদা?’
-’আজ প্রায় আড়াইশো কিলোমিটার রাস্তা। তবে এলাম তো সবটাই গাড়িতে। আর আগামীকাল সবটাই হেঁটে’
তারপরে যাত্রাপথের মানচিত্র ও পরিকল্পনা নিয়ে দুই পুরুষে খানিকক্ষণ আলোচনা চলতে চলতেই খাওয়ার ঘন্টা বেজে গেল।
দাদা বললেন,
-'আজ সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। সঙ্গে বুড়ো মানুষ এবং মেয়েমানুষেরা আছে, ধীরেসুস্থে চলতে হবে। কাল ভোররাতে আমাদের যাত্রা শুরু'।
অতঃপর দলপতির নির্দেশমতো খাওয়া শেষে বিছানায় গিয়েছিলেন সবাই, মৃদু নাসিকা গর্জন জানান দিচ্ছিলো, ঘুমিয়ে পড়েছেন মায়েরা।অরু চুপিচুপি উঠে এসে বললে, ঘুমোলে নাকি!’
-’নাগো। এতো তাড়াতাড়ি আমার ঘুম আসেনা। কিন্তু তুমিও ঘুমোও নি কেন?’
-’ঘুম আসছে না ভাই’
-’কেন?একা ঘুমোবার অভ্যেস নেই বুঝি!’
-’যাঃ! কি যে বলো! আমি বলে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম! আর তুমি না! একটা যা তা! আমি বলে তোমার- আমার দেশ, শউরঘর, বাপের ঘর…এইসব গল্প করি এসো।’
বিরজার মনে পড়ছিল,এই মেয়েটির মতো তাঁর বিবাহিতা সইরা, বৌদিদি, ছোটবৌ, এমনকি নিজের ফেলে আসা জীবনের ননদিনীর কথাও। তাঁরা সবাই বিবাহিত, তাঁরা সবাই সীমন্তিনী। সবারই কি স্বামীর জন্য এমনই অভাববোধ থাকে! শুধু তাঁরই…
পরমুহুর্তেই নিজেকে সামলে নেন আত্মাভিমানী নারী, মনে পড়ে সন্ধ্যায় বলা দাদার কথা, সবার জীবনই কি এক ছাঁচে ঢালা হয়! তারজন্য হাহুতাস না করে হাসিমুখে তা মেনে নিলেই তো হয় বাপু!
খানিক হাসলেন, অরু ভাবলে, ঠাট্টা… তারপরে নব পরিচিত দুই সমবয়স্কার মধ্যে চললো নানা মেয়েলি গল্প,কখন যেন আনমনে ঘুম। পরের ভোরে পরস্পর আবিস্কার করলে তারা সারারাত এক কম্বলের তলায় ঘুমিয়েছে;কবোষ্ণ বন্ধন;যা আজও অমলিন।
এই তো সেদিনও গঙ্গাজল তাঁকে দেখতে এসে যা কান্নাকাটি করলো জড়িয়ে ধরে… আর কি আশ্চর্য দেখ আজকাল কতো কি তো মনে পড়ে না, তবু এসব কথা তো বেশ মনে আছে।
এই যেমন মনে আছে, সেদিন ভোরে সবাই মিলে হাঁটতে হাঁটতে জানকী চট্টি যখন পৌঁছলেন, শীতপোষাক খুলতে হচ্ছিলো ওতো শীতেও। কী ভীষণ চড়াই রাস্তা, মাঝেমধ্যেই ও বাড়ির মাসীমা আর পিসিমার বুকে চাপ লাগছিল, অরু আর সে মিলে বুকে হাত বুলিয়ে, চা খাইয়ে চাঙ্গা করে আবার পথ চলতে হচ্ছিলো। শেষে প্রায় দ্বিপ্রহরে যমুনোত্রী…বরফ শীতল জলে স্নান, পূজা, সংকল্প… সব হোল;কুণ্ডের জলে দাঁড়িয়ে দুই সখীতে গঙ্গাজল পাতানোও হ’লো।
সবচাইতে মজার কথা, তারা সারাদিন জানতো তারা দেখতে গেছে গঙ্গা নদীর জন্ম;সেজন্যই ‘গঙ্গাজল’ পালিয়ে সম্বন্ধ-উদযাপন;কিন্তু সন্ধ্যায় দাদার কাছে শুনেছিলো সেটি যমুনা!
ততক্ষণে তারা দুজন তো ‘গঙ্গাজল’ হয়ে গেছে!
🍂
0 Comments