বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ২৫
ঢোল কলমি
ভাস্করব্রত পতি
"সরষে ফুলের গা বেয়ে নেমে আসে
ফোটা ফোটা শিশির,
স্নান স্নিগ্ধ ঢোল কলমির লতারা
হেসে উঠে নতুন সূর্যের আভায়।
কুয়াশার চাদর ভেদ করে
উড়ে আসে অতিথি পাখির দল
নতুন ভোরের জন্য জায়গা করে দেয়
রাতের আঁধার।
ভোরের সোনারোদে ওম পেতে চায়
শিষ দেয়া ভোরের দোয়েল,
ভাঁটফুলের নরম ছোঁয়ায়
ধেয়ে আসে মধুকর।"
-- ঢোল কলমি, বারি সুমন
বাঙালির অতি পরিচিত হলেও ঢোল কলমির আদি নিবাস কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু এবং বলিভিয়ায়। সেখান থেকে স্প্যানিশ পাদ্রীরা সপ্তদশ শতকে হিমালয়ের কাশ্মীর ও কাংড়া উপত্যকায় নিয়ে আসে। এখানকার বিভিন্ন গির্জার বাগানে লাগিয়েছিল তাঁরা। পরবর্তীতে এখান থেকে এই গাছ সারা ভারতে এবং বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আজ এই গাছটি বাংলার গ্রামীণ জীবনের সাথে লেপটে রয়েছে বলা যায়।
বেড়ালতা বা বেড়াগাছ নামেও পরিচিত এই ঢোল কলমি। এছাড়াও এর পরিচিতি বাওনি গাছ (ভোলা), উজাউরি, মেলেট্রি ফুল, মটকুলা, ডোঙ্গ কলমি, বেহাইয়া ফুল (ময়মনসিংহ), আমরি, ঘাট কলমি, বেশরম গাছ, উজাউড়ি (মধ্যনগর উপজেলা), ভ্যাড়রা (পুরুলিয়া), বালি গাছ (গাজীপুর) নামেও। এর ইংরেজি নাম Pink Morning Glory, Everglades Morning Glory এবং Bush Morning Glory। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Ipomoea carnea Jace, Ipomoea fistulosa Mart। এটি Convolvulaceae পরিবারের অন্তর্গত। এই গুল্ম জাতীয় গাছটি অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। গ্রাম বাংলায় বেড়ার কাজে এটির ব্যবহার খুব।
নীল আকাশের নিচে গোলাপি ঢোল কলমি গাছ ও ফুল
সারা বছর এর ফুল দেখা গেলেও মূলত জৈষ্ঠ্য মাস থেকে বেশি দেখা যায়। শরৎকাল ও শীতকালে এই ফুলের রমরমা বেশি। আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ আর জমিতে অপরূপ সৌন্দর্য সমন্বিত ঢোল কলমির মাথা দুলুনি -- একটা অনাস্বাদিত দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যের অবতারণা করে। ঢোল কলমির একটি মঞ্জরিতে ৪-৮ টি ফুল থাকে। হালকা বেগুনী এবং গোলাপি রঙের ফুলগুলি অসাধারণ। ফুলের রঙ গোলাপি হওয়ার জন্য একে 'গুলাববসি'ও বলে। হিন্দিতে বলে 'বেশরম'। তেলের ফানেল বা ঘণ্টার মতো আকৃতি। কো। কোনও গন্ধ নেই। পাঁচটি করে পাপড়ি থাকে। বেশ দর্শনীয়। এর পাতা এবং কাণ্ড বিষাক্ত ও তেতো স্বাদের হয়। তাই গবাদিপশুরা একে ছোঁয়না। পাতাগুলো ৬-৮ ইঞ্চি মাপের হয় এবং হৃৎপিণ্ডের মতো দেখতে। পাতা কিংবা ডাল ভাঙলে সাদা রঙের আঠা জাতীয় একপ্রকার পদার্থ বের হয়।
জমির আলের ধারে ঢোল কলমি গাছ বেড়ে উঠেছে
এটি অবশ্য সভ্য সমাজের চোখে 'আগাছা গাছ' হিসেবেই পরিচিত। মোটামুটি গড়ে উচ্চতা ৮ - ১০ ফুট পর্যন্ত হয়। নদীর পাড়ে খুব জন্মায়। ইদানিং হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ভারত বাংলাদেশের নিচু জলাজমি, নদী পাড়, জমির আল এলাকায় এর বসতভূমি। বাস্তু জমির সীমানা নির্ধারণ করতে প্রান্ত বরাবর ঢোল কলমি লাগানো হয়। কৃষিজমির আলে লাগানো হয় যাতে অন্য জমির মালিক অযথা 'ভিতা ছেঁটে' নিজের জমি বাড়াতে না পারে।
গ্রামে বেড়া দেওয়ার কাজে এটি বেশ কার্যকরী গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। গরিবগুর্বো মানুষজন এর ডাল শুকনো করে জ্বালানি দেয়। লতানো কলমি পরিবারের উদ্ভিদ হলেও এই ঢোলকলমি কিন্তু মোটেও লতাজাতীয় নয়। এর ফাঁপা কাণ্ড রয়েছে। তাই ব্রাজিলের আদিবাসীরা এই ঢোল কলমির কাণ্ড ব্যবহার করে তামাকের পাইপ হিসেবে। কোথাও কোথাও এর কাণ্ড দিয়ে কাগজ তৈরি করা হয়। ভূমিক্ষয় রোধ করার কাজেও খুব কাজে লাগে।
ঢোল কলমি যেমনি জনপ্রিয়, তেমনি এটি অত্যন্ত উপকারী একটি গাছও। নেহাত অপাংক্তেয় গাছ নয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এই গাছের ফুল, পাতা ও দুধকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। গাছের পাতা ফোঁড়া বা অন্যান্য চর্মরোগের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। এর পাতা থেঁতো করে ফোলা জায়গায় লাগালে মাত্র ৩ - ৪ দিনে ফোলা কমে যায়। ঢোল কলমির পাতার রস গরম জলের সাথে মিশিয়ে খেলে অর্শ্ব রোগ নিরাময় হয়। ঢোল কলমির পাতা পুড়িয়ে তেলের সাথে মিশিয়ে দাদ হাজা চুলকানি হওয়া অংশে লাগালে উপকার মেলে। কুকুর কামড়ানোর স্থানে এর পাতার রস লাগালে বিষের প্রদাহ এবং প্রকোপ দুটোই কমে। গাছটিতে রয়েছে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণাবলী। ফলে দেহের ক্ষতস্থানে এর সবুজ পাতা গরম তেল দিয়ে মিশিয়ে লাগালে উপশম হয়। ক্ষত সেরে যায়। এই গাছের ডালে থাকা সাদা তরুক্ষীর বোলতা, ভীমরুল, বিছের কামড়ের স্থানে লাগালে উপকার মেলে।
নব্বুইয়ের দশকে গুজব ওঠে যে ঢোলকলমি গাছের মধ্যে থাকা এক ধরনের পোকা নাকি মানুষকে কামড়ালে মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। এমনকি স্পর্শ করলেও জীবনে অন্ধকার নেমে আসতে পারে। যদিও এটি ছিল সম্পূর্ণ ভুল তথ্য। সম্পূর্ণ মনগড়া। কিন্তু সেসময় মানুষ আগাপাসতলা না বিচার করে গনহারে এই গাছ নিধনের কাজ শুরু করে দেয়। বলা যায় একপ্রকার 'নিধনযজ্ঞ'। এর রেশ আমাদের রাজ্যেও এসে পড়ে। ফলে অচিরেই বংশলোপের যাঁতাকলে পড়তে শুরু করে আদুরে ঢোল কলমি। কিন্তু এই গাছে থাকা পোকাটি সম্পূর্ণ নিরীহ। কোনও ক্ষতিকারক দিকই নেই। যত্রতত্র জন্মানো এই গাছের ডালে প্রচুর পাখি এসে বসে। দোল খায়। আর গাছের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকা ছোট ছোট পোকামাকড় খায়। আর ঢোল কলমির ফুলের মধু খেতে ভনভন করে ভ্রমরের দল। গ্রামের মানুষের কাছে এটি পরম আত্মীয় এক গাছ!
"একবার যদি আসো আমার এ গাঁয়
ঢোল কলমি দেবে না ফিরে যেতে
এই নদীর জলেতে সাঁতার কাটে
মাছরাঙা, পানকৌড়ি, বুনোহাঁসের দল
গাঁয়ের বধূরা সেই দৃশ্য দেখে হেঁসে হয় কুটিকুটি"।
-- আমার গাঁ, মিঠু সর্দার
🍂
0 Comments