জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫৫ / সালেহা খাতুন

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫৫ 
সালেহা খাতুন 

পড়াশোনা নামক ধারাবাহিক প্রক্রিয়াটি আমার সমগ্র জীবন জুড়ে এমন ভাবে চলে আসছে যে তাকে থামানোর মতো প্রতিভা কোনো মানুষের নেই। অতীতে ছিল না, বর্তমানে নেই আর ভবিষ্যতেও থাকবে বলে মনে হয় না। ভয় শুধু একটাই, গ্লকোমায় আচ্ছন্ন হওয়াকে। 

আমার বিয়েতে কণ্বমুনির মতোই কন্যাবিচ্ছেদের যন্ত্রণা অনুভব করেছিলেন আমার স্যার অধ্যাপক ড.শ্যামল সেনগুপ্ত। তিনি আমাকে একটি চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন এখনি সংসারের শত বন্ধনজালে নিজেকে যেন জড়িয়ে না ফেলি। স্যারের মতোই আমিও আমার ছাত্রীদের বলি। বিশেষ করে এম এ ক্লাসের ছাত্রীদের। যারা বিয়ে করে ফেলেছে তারা এখনি যেন সন্তান না নেয়। অনেক সময় লজ্জার মাথা খেয়ে ছাত্রীর অভিভাবকদেরও বলি, দেখবেন মেয়েগুলোর পড়াশোনা যেন ঠিকঠাক ভাবে চলে। মাতৃত্বের ভার এখনি যেন ওদের ওপর না চেপে বসে। আর তার জন্য সঠিক পরিকল্পনা যেন ওরা গ্রহণ করে।

 নারীর উচ্চশিক্ষার অনেক অন্তরায় আছে। বিশেষ করে এখনকার সেমিস্টার সিস্টেমে যদি প্রথম সেমিস্টারে ছাত্রী বিয়ে করে, পরের সেম দুটিতে সঠিক পরিকল্পনা না করে সন্তান সম্ভাবনাময়ী হয়ে উঠে আর শেষের সেমে গিয়ে সন্তানের জন্ম দেয় তাহলে পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটবেই। অনেক সময়ই হয়েছে আমার কাছে ডিসার্টেশান পেপার করেছে এমন ছাত্রী ভাইভার দিন উপস্থিত হতে পারে নি। পরে শোনা গেছে ঐ দিন তার মিসক্যারেজ হয়েছে। করোনাকালে এক ছাত্রী নার্সিংহোমে যমজ সন্তানের জন্ম দিয়ে অনলাইনে এম.এ.পরীক্ষা দিয়েছে। একবার তো বাইরের এক্সপার্টকে পরীক্ষার হল ছেড়ে কলেজ মাঠে নেমে পরীক্ষা নিতে অনুরোধ করি। কেননা ছাত্রীটি ভাইভা দিয়েই নার্সিংহোমে যাবে এবং ঐদিনই তার সিজার হবে। সে ছাত্রী রবীন্দ্রভারতীর দূরশিক্ষা পাঠক্রম থেকে এনভায়রনমেন্ট স্টাডিজে পড়াশোনা করছিল। একটুর জন্য তীরে এসে তরী ডুবছিল। খুব কষ্ট হয় ওদের কথা ভাবলে। নিজের জীবন অভিজ্ঞতা ওদের সাথে শেয়ার করে বোঝানোর চেষ্টা করি কী করা উচিত।

সবাই তো আর বাধ্য থাকে না। ফলে অনেক সময়ই ইচ্ছেগুলোকেই ওরা বধ করে ফেলে। কিন্তু আমি স্যারের বাধ্য ছাত্রী। চিঠিতে তিনি যে ঈঙ্গিত দিয়েছিলেন তা বুঝেছি এবং ছুটেছি আমার ডাক্তার দুলাভাই বেলাল হোসেনের কাছে। তিনি আমার মাসতুতো দুলাভাই। কোলাঘাটে তাঁর চেম্বারে গেলাম তাঁর পরামর্শ নিতে। বললাম আমি এখনও সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হই নি। নিজেকে সন্তান প্রতিপালনের উপযুক্ত করে আগে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। আপনি পথ দেখান। তিনি বললেন চেম্বারে কোনো কথা হবে না তুমি বাড়ি চলো। সেদিন আমাকে এবং সালাউদ্দিনকে তিনি যেভাবে আপ্যায়ন করেন তার কোনো তুলনা নেই। রীণুদিদি অসুস্থ শরীর নিয়েও যথেষ্ট যত্ন করে আমাদের। দুলাভাইয়ের কাছে শ্যালিকারূপে আমার যথেষ্ট কদর আছে। তিনি নিজের গাড়ি করে ড্রাইভারকে দিয়ে নন্দকুমারের কাছে পৌঁছে দিয়ে দীঘায় যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
🍂

বিয়ের পর পড়াশোনা থেকে দশ-পনেরো দিনের একটা ব্রেক নিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু মুখে মুখে সাহিত্য চর্চা চলছিল। বিভূতিভূষণ তারাশঙ্করের গল্প অন্যদের শোনাতে শোনাতে আমার নেটের প্রস্তুতি হয়েই যাচ্ছিল। একুশে নভেম্বর বিয়ে আর নেট পরীক্ষা ছিল আঠাশে ডিসেম্বর। কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে আশুতোষ বিল্ডিংয়েই নেট পরীক্ষার সিট পড়ে। বন্ধুদের বিয়ের পর দেখেছি তাদের বর বা শ্বশুর ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে দিয়ে যায় কিন্তু আমি একাই গেছি। এখনও মনে আছে নেট পরীক্ষা আমি দিই সোম সাহেবের দেওয়া শাড়ি পরে। গার্ডেন ভরেলির ইউনিক একটি শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন তিনি।

সে বছর নেটের বাংলা প্রশ্নের প্রথম দশটি প্রশ্ন ভুল করে মণিপুরি ভাষায় প্রিন্ট হয়েছিল। একটি এখনও মনে আছে – তা হলো  ‘শেক্সপিয়রচ ড্রামাচ ইবনি’। পরীক্ষা শেষে আমরা অয়ন্তিকার উদ্যোগে একটি অ্যাপ্লিকেশন জমা দিই সুবিচারের উদ্দেশ্যে।

শুরু হয়ে গেল উনিশশো আটানব্বই। সংসার পাতলাম শ্যামনগরের গৌরীশঙ্কর জুট মিলের কোয়ার্টারে। অবশ্য এর আগে ডিসেম্বরেও কয়েকদিন ছিলাম। ইছাপুর, শ্যামনগর, জগদ্দল, নৈহাটি বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ানোর ফলে সমরেশ বসুর ছোটোগল্প উপন্যাসের প্রেক্ষাপট পরিবেশ স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়ে গেল। এও একধরনের ফিল্ড সার্ভে।

এম. ফিল. করার উদ্দেশ্যে আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়মুখী হলাম। তখন এম. ফিল.- এর দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক নরেশ চন্দ্র জানা। ফর্ম ফিলআপ করলাম। নরেশবাবুকে বললাম স্যার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও অ্যাপ্লাই করবো। যেখানে চান্স পাবো সেখানেই পড়বো। নরেশবাবু বললেন, ‘আমি বলছি আর কোথাও তোমায় যেতে হবে না। তোমার রেজাল্ট অনুযায়ী তুমি এখানেই পড়তে পারবে’। তখন এম.ফিল.-এ মাত্র কুড়িটা সিট ছিল।

সালাউদ্দিন বললেন আব্বার অনুমতি নিতে হবে। মানে? তিনি না করলে, আমার আর পড়াশোনা হবে না? ভারি আশ্চর্য ব্যাপার! তখন সপ্তাহে একদিন শ্বশুরবাড়ি যেতাম। মঙ্গলবার রাত্রে গিয়ে বুধবার থেকে যেতাম, বৃহস্পতিবার ভোরে ফিরে আসতাম। কখনও কখনও বুধবারেই ফিরে আসতাম। শ্বশুর বাড়িতে সারা সপ্তাহের কাজ প্রায় সেরে আসতে হতো। সে ফিরিস্তি পরে দেওয়া যাবে।

শ্বশুরবাড়িতে চমৎকার একটি পুকুরের ধার ছিল। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাকে সঙ্গে নিয়ে সালাউদ্দিন তাঁর বাবার কাছে আমার এম. ফিল. পড়ার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তিনি অত্যন্ত তাচ্ছিল্য ভরে বললেন আগে চান্স পায় কিনা দেখো। 

(ক্রমশ)

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

0 Comments