জ্বলদর্চি

মেসেজ/পি.শাশ্বতী

না-গল্প
মেসেজ
 
পি.শাশ্বতী


মানব জীবনের ধর্ম অনুযায়ী দৈনন্দিন চলাচলে সবল ও সুস্থ থাকার সময় যতই কমে আসতে থাকে, ততই মনের খোপে খোপে জমতে থাকে আতংক আর আশঙ্কার কালো ছায়া। শেষ জীবনের অখণ্ড অবসরও তাই এক বড় ধরনের  যন্ত্রণার যাপন হয়ে ওঠে। তবু যদি শরীরের ইন্দ্রিয়গুলো সচল থাকে, তাহলে একরকম কাটে। কিন্তু লেন্স বসিয়ে পাওয়ার দিয়েও যদি  স্পষ্ট না দেখা যায় চোখে কিংবা সুগারের ওঠানামায় কখনো চোখ জুড়ে ঘুম, কখনো প্রচণ্ড দুর্বলতায় শরীর অচল, অথবা নার্ভের সমস্যায় ভালো করে কিছু হাতে ধরে রাখা মুশকিল। এমনকি নিজের নামটুকু সই করতে গেলেও হাত কেঁপে যায়— তাহলে সেই বেঁচে থাকার আর কোন যুক্তি থাকে! চোখের কারণে না আছে পড়ে সুখ। না আছে দেখে সুখ। টিভিতে খবর আর খেলা ছাড়া কোনো দিনই কিছু দেখি না। এখন দৃষ্টি বাঁচাতে সেটাও প্রায় বন্ধ। 
এদিকে এখন আর্থিক সম্বল বলতে সামান্য চাকরি জীবনের পর অবসরকালীন কিছু পেনশন আর লেখালেখি বাবদ কিছু রয়্যালটির  টাকা। এই যে ষাটোর্ধ্ব হয়ে এতদিন এই ধরার আলো, বাতাস, হওয়া উপভোগ করে চলেছি, এতটা ভাবিনি সত্যিই। একটা সময় পর্যন্ত মনে হতো, আমি বোধহয় বেশিদিন বাঁচবো না।
আজ থেকে অনেক বছর আগে একটা মারণ রোগে   জিভে একটা জটিল অপারেশন হয়েছিল। জিভের খানিকটা বাদ যাওয়ায় পর বহু দিন পর্যন্ত ভালো করে কথা বলতে পারিনি। দীর্ঘমেয়াদি থেরাপির মাধ্যমে ধীরে ধীরে আবার উচ্চারণ করতে পেরেছি আমার প্রাণের ভাষা। কিন্তু সেও অনেক কষ্ট, অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে। সেসব নিয়েই কেটে গেছে আরও চোদ্দটা বছর। চাকরিতে অবসরের অনেক আগে থেকেই আমার শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে আমার সরকারি দপ্তর থেকে আইনি ভাবে যেটুকু ছুটি দেবার, সেটুকু তো দিয়েছেই। তারপরও মানবিক কারণে তারা আমাকে আরও বেশি কিছু দিন বিশ্রামে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। তা নাহলে আমি কিভাবে চাকরিটা বাঁচিয়ে রাখতাম, আমার জানা নেই। কারণ অপারেশনের পর পাঁচটা বছর ধরে চিকিৎসার প্রয়োজনে কখনো কলকাতা-বোম্বাই, কলকাতা-ব্যাঙ্গালোর ছোটাছুটি করেই কেটেছে। এটা সম্ভব হয়েছে একমাত্র আমার অফিসের সহকর্মীদের এবং কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বদান্যতায়। ফলে তাঁদের কাছে আমাকে চিরঋণী হয়ে থাকতে হবে।
এখন আমার দিন কাটে মূলত অডিও ভয়েস শুনে আর গান শুনে। মাঝে মাঝে কিছু পড়ার কিংবা লেখার চেষ্টা করি, যতক্ষণ পর্যন্ত চোখে সয়। এরই মাঝে একদিন আমার বোনের  নাতনির আবদারে খুলে ফেললাম আমার মোবাইলে এককালের বহু ব্যবহৃত পুরনো ফেসবুক আইডি-টা। বছর-সাতেক আগেও নিয়মিত অ্যাক্টিভ থাকতাম এই পেজে। কিছু প্রিয় বন্ধু ছিল। গ্রুপেও ছিলাম দু-একটি। চোখের সমস্যার পর থেকে সে-পাট চুকিয়ে দিয়েছি অনেক কাল আগে। বোনের ডাক্তারি পড়া নাতনি সেই পুরনো পেজের খবর শুনেই পীড়াপীড়ি শুরু করে। বলে, চোখের ওপর খুব একটা চাপ না দিয়ে মাঝে মাঝে খোলো না পেজটা। প্রয়োজনে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করো। এতে মনটা ভালো থাকবে, মন ভালো থাকলে শরীরটাও ভালো থাকবে। 
তারপর থেকেই মাঝে মাঝে পেজটা খুলছি। পুরনো দিনের ছবিগুলো দেখে মনটা তরতাজা হয়ে গেল। ভাবা যায়, কী ছিলাম, আর কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি! সেই সময়ের কত সুন্দরীর কমেন্ট পড়ে আছে কমেন্ট বক্সে। সেসব দেখে এই বয়সেও পুলকিত হয়ে ওঠে মন। সরকারি একটা চাকরি করলেও বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে নেহাৎ কম নাম ছিল না। খুব বড়মাপের না হলেও বাংলার একটা নির্দিষ্ট পাঠককুলের কাছে আমার একটা ভিন্নধর্মী গ্রহণযোগ্যতা আগেও যেমন ছিল, আজও তেমনই আছে। এখন তো সেভাবে আর লিখি না, অল্প কিছু পত্রপত্রিকা ছাড়া। ফেসবুক খুলেই দেখতে পেলাম বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেরই এপারের খেলা সাঙ্গ হয়েছে। আবার অনেক মোহময়ী বান্ধবীকে দেখি নাতি-নাতনিদের নিয়ে সাদা চুলে পোস্ট দিয়েছে।
হঠাৎ কি মনে হল স্প্যাম বক্সে ঢুকিয়ে রাখা একজনের মেসেজের চ্যাট বক্স খুললাম। খুললাম মেলের স্প্যাম। একটা সময়ের পরে ওই সাইটটা আমি আর খুলতামই না কিছুটা বিরক্তি, কিছুটা আমার চারপাশে তৈরি হওয়া ইমেজের কৌলিন্যে। কিন্তু আজ এত বছর পর সেই সাইটটা খুলতেই বুকের ভেতরে থেকে একটা হাহাকার উঠে এলো। একের পর এক কমেন্টগুলো দেখতে দেখতে আমার চিরকালীন শুষ্ক চোখও জলে ভোরে উঠলো।
এ কী করেছি আমি! আমার কঠিন অসুখ, আমার সকল প্রতিবন্ধকতা মেনে নিয়ে যে মানুষটা প্রাণের গভীরতা ঢেলে ভালোবেসেছিল, আমি তাকেই কিনা নিজের গোঁয়ার্তুমির বলি করেছি! এই তো ক-বছর আগে পর্যন্ত আমি পাগলের মতো লেখালিখি করতাম। প্রায় শ-খানেক বই, পুরস্কার, অসংখ্য স্তাবক— সব মিলিয়ে অসুস্থ শরীরেও ছুটে বেড়াচ্ছিলাম এসভা থেকে ওই সভায়। সেই সময়ে সব সময়ের সঙ্গীনীও ছিল সে।
না আইনত বা সামাজিক কোনো স্বীকৃতি দেবার মতো মেরুদণ্ড আমার ছিল না। ভয় হতো যদি এর ফলে আমার পাঠককুল বিমুখ হয়। তাই কলিযুগের রাম সাজতে গিয়ে একদিন তাকেই নির্বাসন দিলাম সামান্য অজুহাতে। 
আজ বড় মনে পড়ছে তাকে। খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। আজ বুঝতে পারছি আমিও তাকে......
কোনো দোষ ছিল না তার। প্রাণ ঢেলে ভালোবাসত আমাকে। সামাজিক সম্মান, মান-অপমান বিসর্জন দিয়ে তার সবটুকু উজাড় করে আমাকে বুকে টেনে নিয়েছিল; আমি কিনা তাকেই.....হে ঈশ্বর...
পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছলো যে, কথায় কথায় ওর নাম্বার থেকে শুরু করে হোয়াটস অ্যাপ, মেসেঞ্জার, মেইল সব ব্লক করে দিতাম। সামান্য অজুহাতে কথা বন্ধ করতাম। ফোনে আমার দরকারি কথা ছাড়া কথা বলতাম না। অথচ ভালোবাসার সম্পর্কটা একপ্রকার জোর করে আমিই গড়ে তুলেছিলাম। আর তাকে ভালোবাসার পরিবর্তে নানা ভাবে নিজের লেখালেখি থেকে শুরু করে নানা কাজে ব্যবহার করতে থাকলাম। সম্পর্কটা আমি শেষ পর্যন্ত এই কাজকর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইছিলাম। আমার কাজ করতে গিয়ে সে যদি কোনো ভাবে উপকৃত হতো, তাহলেও দোষারোপ করতাম। আসলে ওর মধ্যেও একটা লেখক সত্তা ছিল। যেগুলো সাংসারিক, পারিবারিক চাপে প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমার সঙ্গে মেলামেশার পর থেকে সেই সুপ্ত প্রতিভার আবার একটু একটু করে উন্মোচন হতে থাকলো। যেটা আমার কাছে বোধহয় কিছুটা ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠেছিল। আজকে এসে মনে হয় তেমনটা কি হওয়ার প্রয়োজন ছিল। বোধহয় না। আমার জগতের সঙ্গে ওর ছোট্ট জগতটাকে মিলিয়ে ফেলার কোনো কারণই ছিল না। ঈর্ষা যে কত ভয়ংকর হতে পারে, আজ আমি বুঝতে পারছি। যখন অন্ধ হয়ে ছিলাম তখন বুঝিনি। অথচ ও কিন্তু শুধুই ভালোবেসে গেছে।
এই তো মেসেজের পর মেসেজ। সবেতেই সে দোষ না করেও ক্ষমা চেয়েছে, নিজেকে দোষী বলেছে। আরেকটিবার সুযোগ দিতে বলেছে। এই তো আরও, আরও। আমাকে ভুল বুঝতে বারণ করেছে। মাথা ঠান্ডা করতে বলেছে বারবার। আর আমি তখন উন্মাদ আরও আরও সফলতার জন্য।  আরও পুরস্কার আরও প্রশংসা। ফেসবুক দুনিয়ার গ্ল্যামারে  আমি অন্ধ হয়ে গেছিলাম। অনুষ্ঠানের পর অনুষ্ঠান আর পুরস্কার পাওয়ার জন্য কী করিনি। আর ও তো আমার সেই প্রয়াসে সর্বক্ষণই পাশে থেকেছে। তবু কি যে হল তখন… হয়তো ওর ওই স্বল্প সাফল্যও আমাকে তিষ্ঠতে দিচ্ছিল না। তাই ওভাবে....
আঃ !
আজ আমি একা, সত্যিই একা...  
আমার চারদিকে শুধু মেডেল, মেমেন্টো, উত্তরীয়র মেলা। আর ছবি, কত ছবি...বেশির ভাগ ওরই তুলে দেওয়া।
কত বছর পার হয়ে গেল। অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষার পিছনে ছুটতে গিয়ে জীবনের সব মাধুর্যটুকু হারালাম। আজ সেই স্তাবকের দল, সেই মনমোহিনী বান্ধবীদের দল কেউ— কেউ  আমার খোঁজ নেয় না। আর দিনের পর দিন মেল, টেক্সটে করা এই সব মেসেজগুলো আমার প্রতি তার ভালোবাসা, সম্মান, সততার প্রমাণ দিচ্ছে। অথচ আত্মদম্ভে সেসব আমি খুলেও দেখিনি। আজকে বিজ্ঞানের আধুনিকতম উদ্ভাবনীতে এই  অক্ষয় মেসেজ প্রমাণ দিচ্ছে আমার অকৃতজ্ঞতা, আমার লোভ,  আমার মুখোশের আড়ালে আসল অমানুষের চেহারাটা।

🍂

Post a Comment

0 Comments