শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫৪ / সালেহা খাতুন
বিয়ের দিন একের পর এক চমক পাচ্ছিলাম। আমার ছোটোবেলার সব বন্ধুদের বাবা নিমন্ত্রণ করেছেন। খুঁজে খুঁজে তাদের শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছেন। বন্ধু মনীষা এসেছে সপরিবারে। ও বললো "তুই ভুললে কী হবে, অদুদবাবু আমাকে ভোলেন নি"।বিভিন্ন ধর্ম, বিভিন্ন ভাষা, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষজনের মিলন হয়েছিল সেদিন। শুধু মিল হচ্ছিল না হাওড়া জেলা ও উত্তর চব্বিশ পরগণার বিশেষ সেই পরিবার দুটির। মাঝখানে একটিমাত্র জেলা কলকাতা তাদের বিভাজন ঘটিয়েছিল আচারে ব্যবহারে সংস্কারে।
দূরত্বের কারণে পাত্রপক্ষের তরফ থেকে বিয়েতে গায়ে হলুদের কাপড় এলো না।পাকাদেখা বা পাকাকথার দিন কোনো তত্ত্ব এলো না। তবে বিয়েতে আমি কী রঙের বেনারসি চাই সেটি শ্বশুরমশাই জেনে নিয়েছিলেন। আমার মায়ের বিয়েতেও মায়ের পছন্দের বেনারসি দেওয়া হয়েছিল। বাঙালি মুসলিম বিয়েতে সাধারণত পাত্রপক্ষের দেওয়া শাড়িতেই বিবাহ সম্পন্ন হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এই যে মেয়েদের কাছে তাদের বিয়ের বেনারসির রঙ পছন্দ করার সুযোগ দেওয়া এটা অনেক বড়ো ব্যাপার।
একশো কিলোমিটারের উপর দূরত্ব অতিক্রম করে গায়ে হলুদের কাপড় তো এলো না। সেটা ঠিক আছে। তবে অনেক কিছুই ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছিল বিয়েকে কেন্দ্র করে। বিয়ের দিনের আগের শুক্রবারে কনের গায়ে হলুদ হয়ে গেলে তার আর বাইরে বেরোনোর অনুমতি থাকে না। আমার বিয়ের দিনটা ছিল শুক্রবার। ফলে প্রায় আট দিন গৃহ বন্দি থাকার কথা। কিন্তু আমি দুই শুক্রবারের মাঝে সেট পরীক্ষা দিয়ে এসেছি মৌলানা আজাদ কলেজ থেকে। একা একাই। অথচ মসজিদে এবং পাড়ায় প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাড়িতে ক্ষীর পৌঁছে গেছে বিবাহ উপলক্ষে। এমনি এমনি রূপচর্চার জন্য হলুদ অনেকবার মাখলেও বিয়েতে এক ফোঁটাও হলুদ মাখিনি। দুই পরিবারের কেউ কেউ এই গায়ে হলুদ নিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁরা মনে করেন এটি সেরেকি প্রথা।
কান্নায় ভেঙে পড়লো টুকু
পাত্রপক্ষের বাড়ি থেকে সাজগোজের কোনো জিনিসই তো আসে নি। তাহলে নিয়মানুযায়ী বিয়ের আগের দিন পরবো কী? সেদিন পরে ছিলাম সাঁতরাগাছির জ্যাঠাইমার দেওয়া সবুজ রঙের একটি তাঁতের শাড়ি। শুভ্রবসনা জ্যাঠাইমা একটি বিরাট দোতলা বাড়িতে একা একাই থাকতেন। তাঁর দুই কন্যা নিজের নিজের সংসার সন্তান নিয়ে ব্যস্ত। স্যারের বাড়ি গেলে আমরা জ্যাঠাইমাকে নিঃসঙ্গ অবস্থা থেকে সাময়িক মুক্তির আস্বাদ দেওয়ার চেষ্টা করতাম। বলা ভালো তাঁর উপর অত্যাচার করতাম। সরস্বতী পুজোর রান্নাবান্না খাওয়া দাওয়া সব তাঁর বাড়িতেই হতো। জ্যাঠাইমাকে আমার বিয়েতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি তো আসতে পারবেন না। আমাকে অনেক আদর সহকারে বোঝালেন কেন তিনি আসতে পারবেন না। সবুজ শাড়িটি তিনি সেদিনই উপহার রূপে আমার হাতে আগেই দিয়ে দেন।
🍂
বিয়ে নিয়ে সবাই এতো ব্যস্ত ছিল যে আমার পোশাকআশাক নিয়ে কেউই তেমনভাবে মনোযোগ দেন নি। শাড়ির আনুষঙ্গিক টুকিটাকি জিনিস সংগ্রহ করে দেয় টুকু। স্যারের বাড়িতে পড়ানোর জন্য স্যার যে খাম দিতেন তাতে থাকতো পাঁচশো টাকা। ঐ পাঁচশো টাকা দিয়েই আন্দুল থেকে টুকু ওগুলো কিনে আনে। বিয়েতে মেজোমামা একটা পিওর সিল্ক শাড়ি দেন। বিয়ের দিন সকালে ওটাই পরবো ঠিক করি। এমন সময় সপরিবারে বড়ো মাসি এলেন। দিদিরা বললো একটু গর্জাস শাড়ি পরতে। বেলাল দুলাভাই যে শাড়িটি উপহাররূপে আনেন সেটিই দিদিরা পরিয়ে দেয়। সাজিয়ে দেয় সযত্নে। মেকআপের জিনিসপত্তর ওরাই আনে। ঠিক সময়ে বাবা কিন্তু আমার জন্য ফুলের মুকুট আর মালা আনিয়ে দেন। অবাক হয়ে যাই আমি। কেননা আগে থেকে অর্ডার না দিলে তো এ জিনিস আসবে না। এতোসব ভেবেছেন তিনি। মনটা কেমন করে উঠলো।
বর এবং বরযাত্রী অবশেষে এলেন। বিয়ে পড়ালেন বড়ো মেসো। বিবাহ মজলিশে বরকনে এক জায়গায় বসে না। অন্দরমহলে গিয়ে ইজাব কবুল করে আনেন তিনি। বিবাহের খোৎবা পাঠ সমাপ্ত করে নবদম্পতির জন্য প্রার্থনা করেন সবাই। একটা ব্যাপার আমার মন ভালো করে দেয় তা হলো সালাউদ্দিনের বস সোম সাহেব যখন ঐ সভায় দুহাত তুলে মোনাজাত করেন আমাদের জন্য। এরপর সালাউদ্দিনের পাশে নিয়ে গিয়ে বসানো হলো আমাকে। বাবা কন্যাকে সঁপে দিলেন জামাতার হাতে।
অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে তাই এক ধাক্কায় দোতলা থেকে নামিয়ে আমাকে বরের গাড়িতে তুলে দেওয়া হলো। কান্নাকাটির কোনো সুযোগ পাওয়া গেল না। টুকু কান্নায় ভেঙে পড়লো। আমার স্যার বিজনবাবুর সঙ্গে গাড়ির মধ্যে থেকেই কথা বললাম।তিনি আসতে একটু দেরি করে ফেলেছিলেন।
কনের সঙ্গে বাড়ির কেউ না কেউ যায় কিন্তু আমার সঙ্গে কেউ এলো না। ঐ যে শ্বশুরমশাইয়ের দুর্ব্যবহার! গাড়িতে সালাউদ্দিন ছাড়া চেনা কেউ ছিল না। বর এবং বরযাত্রীর দুই গাড়ির ড্রাইভারদ্বয় রাস্তা ভুল করতে করতে প্রায় অর্ধেক রাত শেষ করে ফেলে আগাপুর পৌঁছতে। রাত বারোটায় সালঙ্কারা নববধূ নামলো আগাপুর মোড়ে। হাওড়া জেলা থেকে উত্তর চব্বিশ পরগণায় প্রথম দিনের যাত্রায় সারা পথ মাঝে মাঝেই শ্বশুরমশাই তাঁর গাড়ি থেকে নেমে এসে ছেলে বৌমার খোঁজ নিচ্ছিলেন। তাঁর যত্নটাও বুঝলাম। কিন্তু ঐ যে রাগ আর চিৎকার চেঁচামেচি করা এজন্য তিনি অনেকেরই বিরাগভাজন হয়ে পড়েন।
কন্যাকে সঁপে দিলেন জামাতার হাতে
শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি যখন পৌঁছলাম ততক্ষণে সবাই নিদ্রামগ্ন। খবর পেয়ে বড়ো জা ছুটে এলেন। তিনি আমাকে কোলে করে নিয়ে ঘরের মধ্যে পৌঁছে দিলেন। নতুন বৌকে পায়ে হেঁটে যেতে নেই। সে যত্ন ভুলি কী করে? আমাদের দুই জায়ের শ্বশুরবাড়ির জীবন প্রায় একই রকম। সেখানে আমরা অতিথি। ঘরের বৌ কোনোদিনই হতে পারি নি। আসলে বিবাহ পরবর্তী জীবন বিভিন্ন কারণে শ্বশুরবাড়ির বাইরেই আমাদের কাটছে।
দেখলাম প্রায় দেড়খানা ঘর সালাউদ্দিন সযত্নে সাজিয়েছেন। শ্বশুরমশাই বললেন, “সালেহা কোথায় বসবে, কোথায় দাঁড়াবে এসব চিন্তা করেই নাকি ওঁর এই সব সাজানোর পরিকল্পনা”। আরো বললেন ছেলের কত বড়ো বড়ো যোগাযোগ এসেছিল, কত কত টাকা তাঁরা পণ স্বরূপ দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু ছেলে বিনাপণে বিয়ে করে বুদ্ধিহীনতার পরিচয় দিয়েছে। পরের দিন দুপুরে বৌভাতের অনুষ্ঠানে শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের দল, পাড়া প্রতিবেশী সবাই এলেও আমার বাড়ি থেকে কনেযাত্রী রূপে কেউ এলো না। বাবা নিজের ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে শুধু ওবাইকে পাঠিয়েছেন মেয়ে জামাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
সালাউদ্দিন তখন গৌরীশঙ্কর জুটমিলে প্রসেস কন্ট্রোল অফিসার রূপে কাজ করছিলেন। অফিসের সবাইকে আমন্ত্রণ করে বাস পাঠিয়েছিলেন কিন্তু দুই ম্যানেজার ব্যানার্জি সাহেব ও মুখার্জি সাহেব ছাড়া আর কেউ এলেন না। ওঁদের সাথে আলাপ হলো। ওঁরা খুব খুশি। সালাউদ্দিন অধ্যাপক মেয়েকে স্ত্রীরূপে পাওয়ায়। ব্যানার্জি সাহেব সাহিত্যের ভক্ত। উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি তাঁর আত্মীয়। পরে অনেকবার ফোনে তাঁর সাথে কথা হয়েছে। বজবজ জুটমিলে পরবর্তী কালে তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়ে তাঁর গঙ্গার ধারের বাংলোতে বেশ সুন্দর ভাবে আপ্যায়িত হই। মুখার্জি সাহেবের কন্যা তিন্নি তখন যাদবপুরে কমপ্যারেটিভ লিটারেচার নিয়ে পড়াশোনা করছিল। ওর সঙ্গেও সাহিত্যচর্চা হতো।
(ক্রমশ)
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
0 Comments