পর্ব -১১
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া
শঙ্খ নদী উজাইল..মরা কইন্যা জিয়াইলো
ফাগুন মাসের হাওয়ায় ঘুরে ঘুরে নেমে আসে শুকনো পাতারা। হালকা ভাঁপ ওঠে মাটি থেকে ।ঘেঁটুফুলের বাসে ম ম করে চাদ্দিক।ছোট যে লক্ষী বিলাস তেল মাখে তার চুলে অনেকটা সেরকমই গন্ধটা। ধুলো কুটো কুড়োনো হাওয়ায় হু হু করে কাঁটা বাবলার ফুলেভরা হলুদ দুপুর।
ঝিনিদের বাগানে আবীর রঙের কাঞ্চনফুল ফুটে পড়েছে। বড় মাসির লাগানো এই দেবকাঞ্চন।
রাজকুমারী মধুমালা হাজিইইইর!হাচাই কইছস।বাস থেকে নেমে পোঁটলা ধরনের কাপড়ের এক থলি কাঁখালে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে, মুইতো রাজার বেডি রাইজ কইন্যা ;তয় ভিখারি রাজা। তোগো দাদুভাইয়ের হিন্দুকখান আছিলো ব্যাবাকই ফাঁকা।কানা কড়ির হম্পত্তি হেয়ার। বড় মাসি মধুমালা ফোকলা দাঁতে হেসে বলে।
ঝিনুকের দিদুন মাণিক্যমালার বিয়ে হয় তেরোতে আর চোদ্দ বছরে জন্মায় বড়মাসি।কাজেই বড়মাসির সঙ্গে দিদুনের বয়সের ফারাক কেবল চোদ্দ বছর।তার চাইতে ঢের বেশি বয়সের ফারাক বড় মাসির সঙ্গে মা, সেজো আর ছোটর ।এমনকি মাসির দুই মেয়েও এই তিন বোনের চেয়ে বড় কেননা এগারোবার পোয়াতি হওয়া দিদুনের একেবারে শেষের দিকের সন্তান এই পিঠোপিঠি তিনবোন।
অকাল বিধবা মধুমালা থাকে তার ছোট মেয়ে সুরবালার সাথে।জামাই কাস্টমসের বড় চাকুরে। বড়দের আলোচনার ফাঁকফোকরে শুনেছে তারা মাসির বড় মেয়ে পারুলবালার স্বামী ছিলেন মস্ত উকিল।তিনি খুন হয়ে যান।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা শহরের তেতালা বাড়ি থেকে তার স্বামী মহিমচন্দ্রকে ডেকে নিয়ে খুন করে রাজাকাররা। রাজাকার মানে জিজ্ঞেস করলেই গম্ভীর হয়ে যায় বড়রা।
বদ্দিদি স্কুলে পড়াতো।বড়দের কথা থেকেই জানে একদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে বিধবা
বদ্দিদি দেখে তার ছোট মেয়ে নিখোঁজ।দিন দুই পর ক্লাস ফোরের জুঁইকে একটা বড় পুকুরে ভাসতে দেখা যায়। খুব তাড়াতাড়ি করে ক্লাস নাইনের বড় মেয়ে ঋতুকে এদেশে বোনের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয় বদ্দিদি আর প্রায় বোবা হয়ে যায় ।আমৃত্যু কাজের বাইরে বদ্দিদির একটি কথাও কেউ শুনতে পায় নি আর।
বড়মাসি কিন্তু অজস্র কথা বলত,হাসত,ছড়া কাটত,শুধু যুঁই, আর বড় জামাইবাবুর প্রসঙ্গ কখনও তুলতো না।এই মধুমালা এলে তাই মজাও যেমন তেমনি কড়া মেজাজের ঠ্যালায় অতিষ্ঠ। স্কুল থেকে ফিরলেই জল দেওয়া ভাত মেখে দেয় মাসি। সজনে ডাঁটা কেন যে কোনো ডাঁটাই ঝিনির চক্ষুশূল। অথচ তাদের গাছে গাছে ভরা সজনে আর বড়মাসি বা মা তা রান্না করবেই।নাকি খেলে পক্স হয় না আরো সব উপকার টুপকার।
ইস্কুলে যাওয়ার সময় ডাঁটা এড়িয়ে ঝটপট নাকেমুখে চাট্টি দিয়েই দেরি হয়ে যাবে এই অজুহাতে ঝিনি বইয়ের বাক্স হাতে দৌড় লাগায় দাদাদের সঙ্গে।
কিন্তু বাড়ি ফিরতেই অবশ্যাম্ভাবী সেই ডাঁটা চচ্চড়ি জলভাতে নুন তেঁতুল দিয়ে মেখে থেবড়ে বসে কড়া গলায় হেঁকে বলবে ঝিনিইই, ভাত লইয়া বোলাইতে পারুম না,ছ্যাৎ কইরা আইবি!কেডা মুই জানছসনি?মুই হইলাম ইন্দিরা গান্দী! খা কইতাছি ডাডা!ভাতের গুল্লার লগে দুইখান কইরা হইজনার ডাডা মুহের মইদ্যে দিয়া চাবান দিবি।ভাত প্যাডে যাইয়া হান্দাবে,ছিবড়া বাইর কইরা ফ্যালাইয়া দিবি!
দাদাদের খাওয়া শেষ কিন্তু খেলতে যাওয়ার আগে বাড়তি রগড়ের আশায় খালি পাতে বসে বসেই তার হেনস্থা দেখছে আর খুশিতে আনচান করছে দেখে,রঙ্গ দ্যাহো এইহানে,কাম নাই তোগো?খাওনের শ্যাষেও বইয়া রইছস কিয়া আইর আ্যতো হাসি আইত্যাছে কোথাৎ দিয়া?সদ্য পথের পাঁচালী পড়া অরু ফিসফিস করে মিতুকে বললো "হাসছো কেন খোকা,এটা কি নাট্যশালা?"
বিজবিজাইয়া কইতাছোস কী?কোমরে দুহাত রক্ত চক্ষু বড়মাসি ফিরে তাকালেই এঁটো হাতে তারা ভোঁ ভাঁ!
আড়ালে মা হেসে বলে বড়দি আমাদেরও এর'ম শাসনে রাখতো। ছোট থাকতে বকুনির ঠেলায় বাপের বাড়ি আসলে ভাবতাম যাইবো কবে? তবে বাইরের ওই হাঁকডাকই সার।
ঝিনির রান্নাবাটির কত জিনিস যে বানিয়ে দেয় মধুমালা। শাদা ধুতি বা ছেঁড়া থান শিউলির বোঁটা দিয়ে রঙ করে দেয়।তুলি আর আলতা দিয়ে নকশা পাড় হয় সে কাপড়ের। পুরনো কাপড়ের টুকরা টুকরা দিয়ে পুতুলের ছোট্ট রঙিন কাঁথা সেলাই হয়। ছোট্ট মাটির উনুন, ছাঁচ পিঠের সরা বানিয়ে যখন বড় শামুকের খোল দিয়ে গোল গোল গর্তের ছাঁচ বানায় সত্যি পিঠের জন্য তখন ছোট একখানা সরাও তোয়ের হয় তার পুতুল ঘরের জন্য।কাঠের ছোট্ট ঢেকি, নারকেলের বেগো কেটে ছোট্ট গরু বাছুর সব যেন সত্যি!
আর থেকে থেকেই ঝিনিইই পান ছেঁইচ্যা দিয়া যা। পেতলের পানের বাটা আর ছোট ছোট পেতলের কৌটোয় জর্দা,খয়ের, সুপুরি, কমলার খোসা,কত রকম মশলা। শীতকালে কমলা উঠলে সারা বছরের মতো অনেক কমলার খোসা রোদে শুকিয়ে বড় টিনের কৌটোয় রেখে দেয় মাসি। পানের মধ্যে একটু কমলার খোসা ছেঁচে দিলে খুব লাল হয় রঙ।
পান মুখে বটি পেতে তেঁতুল কাটতে বসে মাসি। ছাড়ানো তেঁতুলের ছড়া ,গুড় অল্প নুন আর লেবুপাতা কচলে কী সুন্দর শরবত বানায় গরম দিনের দুপুরে।
কাঁচা আমের কুসি চিরে হয় আমচুর আর সেই শুকনো আমচুর জলে ভিজিয়ে শিলপাটায় বেটে নুন মাখিয়ে বড় বড় গোল্লা করে রোদে শুকোনো হয়। নতুন মাটির হাঁড়িতে শুকনো সেই আমসির গোলা রেখে সরা চাপা দিয়ে কাপড়ে মুখ বেঁধে রাখো। মাঝেমধ্যে বের করে রোদে দিলেই হলো।অরুচি বা পেটের অসুখে এই গোলা থেকে খানিকটা কেটে জলে ভিজিয়ে ভাত মেখে খেলেই ব্যাস।সেরে উঠবেই!
কাঁচা আম তো বটেই এমনকি পাকা আমও কুচি করে কেটে হালকা নুন আর শুকনো লঙ্কা পোড়া দিয়ে মেখে দেয় মাসি। টিফিন কৌটোয় নুন কাসুন্দি দিয়ে জাম ঝাঁকিয়ে খাওয়ায়।
কাঁচা আমের রসে নুন সর্ষে গুঁড়ো, হলুদ আর শুকনো লঙ্কা দিয়ে আম কাসুন্দি আর তেঁতুল দিয়ে তেঁতুল কাসুন্দি , আমতেল,আমসত্ত্ব, মিষ্টি আচার সব সব বড় মাসির হাতের জাদুতে অমৃত। কাচা কাপড় পরে শুদ্ধ হয়ে সে সব ধরতে হয়।চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে ময়লা কাপড় না ধোয়া হাতের জন্য ঝিনি আর ছোড়দা প্রায়ই চড়চাপড় বা কানমলা খায় তবে কমপেনসেশন হিসেবে সেদিনই ছাতুর বরফি বা চালভাজার সঙ্গে কাঁঠাল বীজ পোড়া মাখা বা ক্ষুদের ভাত,দুধ ছাড়া খেজুর রসের পায়েস এইসব চমৎকার কোনো না কোনো খাবার বানিয়ে চুপচাপ সামনে ধরে পিঠে হাত বোলায়।
ইস্কুলে ঝিনির সঙ্গীসাথী বেড়ে গেছে ইদানিং ।তহমিনার ডাকনাম মিনু। ঝিনির সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে বলে প্রায় বিকেলেই পাশের পাড়া থেকে সে খেলতে আসে। রোগা ভোগা মিনু ঝিনির প্রানের বন্ধু। মৃগেন স্যার তাদের ইস্কুলের কড়া মাস্টার। তার হাঁক শুনেই ছেলেপিলের প্যান্ট ভিজে যায়।তার ক্লাসে বইয়ের পাতা নাড়ার অবধি কেউ শব্দ তোলে না।
সেদিনকে ইতিহাস পড়া ভালো মুখস্থ হয়নি বলে আর খানিক ভয়ের চোটেও মিনু পড়া বলতে হোঁচট খাচ্ছে দেখে খাতার আড়ালে মুখ রেখে ঝিনি প্রম্পট দিচ্ছিল মন দিয়ে। এতো মগ্ন হয়ে সে ফিসফাস করে পড়া বলে যাচ্ছিল যে কখন মিনু চুপ করে গেছে ভয় খেয়ে আর স্যার এগিয়ে এসে বড় পণ্ডিত হয়েছো কেমন? বলে বিপুল বেগে পুরুষ্টু হাতের এমন থাবড়া পড়ল যে ব্যাথার চোটে মনে হলো পিঠটা বেঁকেই গেল তার। তবে ব্যথার চাইতেও ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সামনে লজ্জায় পড়ে গেল বেশি।মৃগেন স্যারের ক্লাসে যে পড়ার প্রম্পট দেওয়া সম্ভব এতেই অবিশ্যি সবাই হতবাক।মার তো খেতেই লাগবে সবচে' দুষ্টু ছেলে স্বপনও এসে ঘাড় নেড়ে বলে গেল তাকে।ইস্কুলে মার খাওয়ার কথা বাড়িতে না বললেও দাদারা ঠিক জেনে গেল এবং অবধারিত মা'র কাছেও খুব হেনস্থা হলো তার।তাদের বাবাই শুধু বললো ও কিন্তু ওর বন্ধুকে সাহায্য করতেই চেয়েছিল বিনু!
একদম মাথায় তুলবে না তুমি; কড়া গলায় মা বলল ক্লাসের ডিসিপ্লিন ভাঙা অন্যায় এটা ওকে বুঝতে হবে। ডিসিপ্লিন মানে কী জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু ইস্কুলে মার খাওয়ার অপমান এবং মা'র বকুনিতে মন মেজাজ বিচ্ছিরি লাগছিল।
মিনু এসেছিল সেদিন বিকেলে।ঘুরচণ্ডী খেলছিল ওরা।ঝিনি মণি টেনি খোকন একদলে আর বাচ্চু বেবি বুলা,মিনু একদলে।
খেলা ধুলোতেও মিনু তেমন দড় নয়।ওর দিক দিয়েই ঝুল কেটে বাউলি দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো ঝিনিরা। বারবার ওকে ভালো করে বেড় দিতে বলেও শেষতক হেরে গিয়ে বেবি ক্ষেপে গিয়ে বললো এই মোল্লা পাড়ার মেয়ের সাথে খেলবো না আমি। শুনে জড়সড় হয়ে গেল মিনু ,কিন্তু কী বললি বলে ঘাড় বেঁকিয়ে ঝিনি তাকালো বেবির দিকে। হিন্দু পাড়ায় খেলতে আসে কেন?মিনু তো মুছলমানদের মেয়ে;ওরেম্মারে! কথা শেষের আগেই বেবি ডুকরে উঠলো তৎক্ষণাৎ নাকে ঝিনির ঘুষো খেয়ে। ভাগ তুই,তোর সাথেই খেলবো না আমরা চেঁচাতেই কানে জোরালো কিসের টানে ফিরে দেখে বড়মাসি।আরো কসকসে করে তার কান টেনে বড়মাসি জিজ্ঞেস করল মাইর দিলা ক্যান অরে? চিক্কুর পাড়তেছিলা ক্যান?অয় তো তর গায় হাত তোলে নাই!তর গলা খানই মুই হুনছি দূর থিক্যা।ঝিনি চুপ করেই ছিল। কিছু জিগাইছি তরে মুই।হুনছোনি নাকি ঠসা হইয়া বইছো,কানে হান্দায় নায় কতাখান?হইছে কী?রা নাই ক্যান আ্যহন?
অবেলায় চান করে বেড়ার গায় গামছা কাপড় মেলছিল বড়মাসি চেঁচিয়ে বেবিকে তার শাসানি শুনতে পেয়েছে ঘুষিটাও দেখেছে।ঝিনি বুঝলো বাড়িতেই আজ মৃগেন স্যারের চাইতেও বড় থাবড়া কপালে আছে। কানে মোচড় খেতে খেতেই দাঁতে ঠোঁট চেপে সে পা দিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগলো। মার খেয়ে বেবিও ফুঁসছিল।মণি টেনিদের কাছে ঘটনা শুনে অবশ্য বড়মাসি অবাক। পোলাপানের খ্যালানের মইদ্যে হিন্দু মুছলমান আইল কোথাৎ দিয়া? তার কান ছেড়ে দিয়ে বেবির দিকে ফিরল মাসি। নিজের ছোট ছোট ভিজে চুলের মাথাটা আঙুল দিয়ে পাট করতে করতে বলল যদিও ঝিনির মাইর দেওয়াডা ঠিক না তয় কতাডাতো ব্যাবাক ভুল কইছো তুমি। গুরাগারার খ্যালতে খ্যালতে কাইজ্যা তো বান্দেই কিন্তু এই কতাডা কওনতো ছাইড়া দেও চিন্তায় আইনলেও অপরাদ হয়।আইর বলো বুজি! একলগে খ্যালবা হগগলে।পা টেনে টেনে মাসি ফিরে গেল। কিন্তু এই ঘটনায় সেদিনকার খেলা ভণ্ডুল।
ঝিনিইই হুইন্যা যা এহানে।মাস্টারমশাই চলে গেলে বড়মাসি ডাকলো তাকে। আইজ তরে মাইর দিয়া অপরাদ হইছে মোর।হাতের তালুতে দুটো তিলের নাড়ু গুঁজে দিয়ে বললো মাসি।মাপ কইরা দিস মাগো। জড়িয়ে ধরলো কড়া মেজাজের বড়মাসি।এতো অবাক হলো ঝিনি যে কিছু বলতেই পারল না ।
হইত্য কইতাছি তরে,হুইন্যা রাখ তোগো বড় ভগ্নীপতিরে,মোর ছোড লাতনিডারে তো মুছলমানরা মারে নাই।অগো খুন করছে রাজাকাররা। রাজাকার কারা মাসি? শিউরে ওঠে ঝিনি।লুকিয়ে শুনেছে বটে তবে এসব কথা সরাসরি আজ অবধি কেউ কখনও বলেনি তাদের।
সিরাজদৌলা পালায় মীরজাফরের নাম হুনছস? রামায়ণে বিভীষণের কতা?রাজাকাররা হইল হেই কিসিমের মানুষ। মনে রাখবা বিশ্বাস ভাঙনের লাহান পাপ আর নাই। মাইনষে ঘিন্না করে তাগো।আইজ অবদি হুনছস কেউ পোলাপানের নাম মীরজাফর বা বিভীষণ থুইছে? আইর একখান হইত্য অইলো মাইনষে যহন নিজেগো ধর্মেরে বড় ভাইব্যা বহে তহন তাগো মনের মইদ্যেই নরক লাইম্যা আসে। শুরু অয় কাটাকাটির রায়ট।
তোগো দাদুবাই তো ছোডোকালে বিয়া দিয়া আফদ লামাইছে। ল্যাহাপড়া শিহি নায় তয় ভ্যাজাইল্যা এই জীবনখান দিয়া মুই বুজজি পোলাপানের মইদ্যে ছোডোকাল থিক্যাই এই বেবির লাহান হিন্দু মোছলেমের ফাও কতাগুলান হান্দাইয়া দ্যাওয়াডা যে বাপমাওয়ের কতফোর অপরাদ! ভালবাসার থিক্যা তাগোরে মিথ্যা ফারাকডারেই শিখাইত্যাছে । ছোড একখান কতা বিষের বৃক্ষ হইয়া মাতা চাইর দিয়া ওডে।আইর কিছুর মইদ্যে কিছু নাই ডাঙ্গোর হইয়া হুদাহুদি জাতের লাইগ্যা দাঙ্গা যুইদ্দে লাইম্যা পড়ে।যুইদ্দো কী করতে পারে দেখছি মুই।।কী জিতবার চায় হেয়া না জাইন্যাই ক্যাবলই জিতবার চায় মাইনষে! কাঁটাতারের বেড়া উডাইয়া দেয় মাইনষের বুকের উপর দিয়া!
কথাদের ভারি বাতাস থেকে দম নিতে চাইল ঝিনি।ও মাসি,তুমি ছোটবেলায় খেলা করতে?খেলাইতাম না? গুড়াগারা লইয়া দাইড়াবান্দা খেলাইতে হুদাহুদি ফাল দিয়া ওঠতাম দেইখ্যা তোগো দাদুভাই চ্যালা কাড লইয়া কত যে ধাওয়াইতো। ছোট বেলার কথায় কলকল করে ওঠে বড়মাসি।
🍂
আরো অনেক দিন পর কাউকে না জিজ্ঞেস করেই ঝিনি হয়ত বুঝতে পারবে বড়মাসির কথাগুলো।
কোন যৌবন কাল থেকে ফলবৃন্তগুলি আগলে
পালন করেছে মিথ্যে সংযম। পাছে কেউ চুরি করে চাঁদ ও তারাপুঞ্জ তার। শিশু নাতনির ধর্ষণ ও খুন, বন্দুকের গুলিতে তরতাজা জামাইয়ের মৃত্যু, পেটের মেয়ের অকাল বৈধব্যের মতোই উপবাসে ভরা একাদশী আটকে রাখতে পারেনি মাসিকে ঘোমটা টানা নিরম্বু জীবন। রঙ্গ রস কথায় কথায় শোলোক, ধাঁধা আর গল্পের শরীরে কত রুপোর গোঠ ও বাজুবন্ধ। চাঁদ তারা ভেঙে গড়ে নেওয়া সেই সব অলংকারগুলি একান্ত তার।অন্যকে সাজিয়ে দেওয়া বাগান খোঁপায় বেজে ওঠা কড়ির ঝুমুর।
অনায্য দেখলেই ছোট বড় একধারসে বকুনি দিয়ে, রেঁধে বেড়ে সবাইকে খাইয়ে শাদা আতপের মতো ভেজা হাত দুটি নিয়ে ছেলেদের মতো ছাঁটা চুল বড়মাসি নিরিমিষ দাওয়ার শানে বসে আছে উবু হয়ে। ঠুন ঠুন আওয়াজ উঠছে ছোট্ট হামানদিস্তার।শাসনের অগাধ প্রশ্রয়ে ঝিনির ছেলেখেলার বেলা নরম জোছনার মতো শাদা থানের আলোয় গিয়ে বসে।
আইছসনি ও মনু,এউক্কা পান ছেঁইচ্যা দে। এট্টু পান দাওনা।হিক্কি ওডবে।ঘুল্লি খাইয়া পড়বি এয়া খাইলে।তয় মোরে পরণ কথা কও। বুজজি।হেইয়ার লাইগ্যাই তো আইছ। একটুখানি পানের বোঁটা তার হাতে ধরিয়ে ছেঁচা পান নিয়ে রাঙা মুখে টুকটুকে মধুমালা পরণকথা শোনাতে বসে।হোনো তাইলে এক দ্যাশে ছিল এক দুঃখিনী কইন্যা...
কত বছর পর প্রাণভোমরার কৌটোর মতো আদরের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে ঝিনি বুঝতে শিখবে পিতাশাসনের এই মিথ্যে বলয়ে কন্যারা তো দুঃখিনীই হয় বরাবর। নরম শাঁসটুক জাঁতাকলে পিষে দিতে দিতে শাদা ভাতের পাতে নুনটুকুর মতো একটুখানি ভালবাসা পেতে সংসারের কত সমুদ্দুর পেরিয়ে ফাঁকা স্রেফ ফাঁকা তেপান্তরের রাস্তায় হোঁচট খেয়ে খেয়ে হেঁটে যেতে হয় তাদের কতো স্বপ্নকাল।
কেবল স্বপ্নেই কি বুনে যেতে হয় মায়ার বীজ? খুলে দিতে হয় তার আবাঁধা বেনীর কেশরাশি।মুক্তির মতো যে পথে উঠে আসে প্রেম। নাকি ফুটন্ত মালসায় বিধবা চালের মতো সে কেবলই বগবগ রান্না করে নিজেকে? শাদা আতপের হবিষ্যান্ন পাক হওয়ার আগে কিংবা চিরুনি দিয়ে সিঁথি চিরে দেওয়ার আগে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন তবে কিভাবে দেখবে ?
কেবল যেখানে নদী ও অশ্রু চির সমবয়সীনি সেখানে মৃত নারীদের জাগিয়ে তুলতে কিছু কি বাকি থাকে রূপোকথার উপসংহার?
কিভাবে ভাটির গোণে জল ভরে ওঠে শঙ্খ নদীতে।নীল জোয়ারের স্রোতে কিভাবে নায় ভরা দিয়ে এসে রাজার ছেলে মরা রাজকন্যাকে বাঁচিয়ে তোলে। বুকের ভেতর কতটা পথ পেরোলে মৃত মধু মালাকে জড়িয়ে পরণকথারাও সুর করে বলে ওঠে শঙ্খ নদী উজাইলো... মরা কইন্যা জিয়াইলো...!
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপনের বিকল্প বিজ্ঞাপনই || ঋত্বিক ত্রিপাঠী
0 Comments