মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১১৪
রাজা দেবেন্দ্রলাল খান (স্বাধীনতা সংগ্রামী, নাড়াজোল)
ভাস্করব্রত পতি
তিনি ছিলেন নাড়াজোলের রাজা নরেন্দ্রলাল খানের জৈষ্ঠ্যপুত্র। এই বিখ্যাত খান পরিবারের ২১ তম প্রজন্ম।১৩০০ বঙ্গাব্দের ২৪ শে ফাল্গুন তিনি জন্মগ্রহণ করেন। অসাধারণ স্মৃতিধর মানুষ ছিলেন রাজা দেবেন্দ্রলাল খান। চতুষ্পাঠীর শিক্ষা শেষ হলে তিনি গৃহশিক্ষকের কাছে ইংরেজি শেখেন। একসময় তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। অতি অল্প বয়সে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় তিনি ভ্রমণ করেছিলেন। BENGAL LIGHT HORSE এর সৈন্য শ্রেণীভুক্ত হয়েছিলেন যুদ্ধবিদ্যায় শিক্ষালাভ করার জন্য। ১৯০৫ সালে তিনি নিজেকে দেশসেবার কাজে উৎসর্গ করেন। অকাতরে অর্থ দান করেছিলেন মহেন্দ্র অ্যাকাডেমি এবং মেদিনীপুর টাউন স্কুলের পরিকাঠামো নির্মাণের জন্য। ১৯২০ সালে রাজা নরেন্দ্রলাল খানের মৃত্যু হয়। তখন এই জমিদারি এস্টেটের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন রাজা দেবেন্দ্রলাল খান।
১৯৩২ সাল থেকে রাজা দেবেন্দ্রলাল খানের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে নাড়াজোলে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর দাদা জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু। ১৯২৬-২৭ সালে দেবেন্দ্রলাল খান মেদিনীপুর জেলা বোর্ডের সভাপতি হয়েছিলেন। দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের সহযোগী হয়েও ১৯২৬ এ দলাদলির প্রভাবে আইন সভার নির্বাচনে তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৩০ ট্যাক্সবন্ধ আন্দোলনেও তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
নাড়াজোল রাজবাড়িতে জহরলাল নেহেরুর সাথে দেবেন্দ্রলাল খান
১৯৩০ এর ২৬ শে জানুয়ারি সারা ভারতের মতো নাড়াজোল রাজবাড়িতেও দেবেন্দ্রলাল খান ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে স্বাধীনতা দিবস পালন করেন। সেদিন তিনি জনগনকে শপথবাক্য পাঠ করান -- "স্বাধীনতা আমাদের জন্মগত অধিকার। এই অধিকার থেকে আমাদেরকে কেউ বঞ্চিত করতে পারে না। পূর্ণ স্বাধীনতা না পাওয়া পর্যন্ত প্রতি বছর এই দিনেই আমরা স্বাধীনতা দিবস পালন করব"!
১৯৩০ এর ২২ শে মার্চ সরকারি নির্দেশ অমান্য করে নাড়াজোল, কেশপুর, পাঁচখুরি এলাকায় শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন ইনিই। গান্ধীজীর লবন সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময় তিনি গ্রামে গ্রামে শুকনো কলাপাতা পুড়িয়ে সেই পোড়া ছাই থেকে পাতন পদ্ধতিতে 'প্রতীক লবন' উৎপাদন করে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করেন। কংগ্রেস তাদের প্রাদেশিক কার্যালয় হিসেবে তাঁর কলকাতার বাড়িতে বহু বছর ধরে বিনা ভাড়ায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। বহু বছর তিনি কংগ্রেসের প্রাদেশিক কমিটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন।
নাড়াজোল রাজবাড়িতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে দেবেন্দ্রলাল খান
১৯৩১ এর ৭ ই এপ্রিল পেডীকে হত্যা করেন বিমল দাশগুপ্ত। নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে তাঁকে মুক্ত করেন। পরবর্তী ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস হত্যার পর সরকারি নির্দেশে পুলিশের চৌকি বসানোর জন্য দেবেন্দ্রলাল খানের বসতবাটি খালি করে দিতে হয়। এরপর বার্জ হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকায় ধরা পড়লেন -- কামাখ্যা ঘোষ, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায়, নির্মলজীবন ঘোষ, সনাতন রায়, নন্দদুলাল সিংহ, সুকুমার সেনগুপ্ত, শৈলেনচন্দ্র ঘোষ, বিনয়কৃষ্ণ ঘোষ, পূর্ণানন্দ সান্যাল, ফনীন্দ্রনাথ চৌধুরী, সরোজরঞ্জন দাস কানুনগো এবং শান্তিগোপাল সেন। ১৯৩৪ এর ১০ ই ফেব্রুয়ারি সোশ্যাল ট্রাইব্যুনালের রায় বোরোলো। তাতে রামকৃষ্ণ রায়, ব্রজকিশোর চক্রবর্তী এবং নির্মলজীবন ঘোষের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয় সুকুমার সেনগুপ্ত, সনাতন রায়, নন্দদুলাল সিংহ এবং কামাখ্যা ঘোষের। বাকিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। ১৯৩৪ এর ৩০ শে আগস্ট বার্জ হত্যার রায় বের হল হাইকোর্টে। তাতে ট্রাইব্যুনালের রায়ই সম্পূর্ণ রূপে বজায় রাখা হল। আসলে দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত আসামীদের পক্ষে হাইকোর্টে আপিল রুজু করা হয়। খ্যাতনামা ব্যারিস্টার এইচ ডি বসু, ব্যারিস্টার বরেণ বসু এবং তাঁর সহযোগী অ্যাডভোকেট শরৎচন্দ্র জানা, ব্যারিস্টার নিশীথচন্দ্র সেন, এন কে বসু, সন্তোষকুমার বসু প্রমুখ আইনজীবিগন বিভিন্ন আসামীর পক্ষে সমর্থন করেন। তাঁরা প্রায় বিনা পারিশ্রমিকে দীর্ঘ ১১ দিন ধরে মামলা লড়েছিলেন। এই মামলার যাবতীয় অর্থব্যয় করেছিলেন নাড়াজোলের রাজা দেবেন্দ্রলাল খান। তিনি ১৯৩৭ এ বঙ্গীয় আইন সভায় ও ১৯৪৬ এ কেন্দ্রীয় আইন সভায় সদস্য নির্বাচিত হন।
চেঁচুয়াহাটের গনহত্যা (১৯৩০ এর ৬ ই জুন) এবং হিজলি জেলের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডতে (১৯৩১ এর ১৬ ই সেপ্টেম্বর) দেবেন্দ্রলাল খান মেদিনীপুরের চন্দ্রাকর ময়দানে এক জনসভায় জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন। ফলে বেঙ্গল ভল্যান্টিয়ার্স গ্রুপের সদস্যরা উদ্দীপ্ত হয়েছিল। তেমনি ১৯৪২ সালে ঘাটালে হয়ে যাওয়া ট্রেজারী লুটের মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় ঘাটাল মহকুমার ২০ জনকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ। এঁদের মধ্যে ছিলেন দেবেন্দ্রলাল খানের ছায়াসঙ্গী কানাইলাল হাজরা (দাসপুর), অরবিন্দ মাইতি (ঘাটাল), আশুতোষ সিংহ, বিজয় সিংহ (কেচকাপুর) ও ধুর্জটি চ্যাটার্জী (কেশপুর)। দেবেন্দ্রলাল খান পরোক্ষভাবে এঁদেরকে জামিনে মুক্ত করেছিলেন।
কংগ্রেস নেতৃত্বদের সাথে নাড়াজোল রাজবাড়িতে দেবেন্দ্রলাল খান
১৯৩২ সালে অষ্পৃষ্যতা বর্জন আন্দোলনে একটি সভায় উপস্থিত থাকার জন্য স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আবেদন করেন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য তিনি আসতে পারেননি। কিন্তু কবিগুরু তা নিয়ে একটি পত্র লিখেছিলেন, যা আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ঐ বছরের ২৫ শে অক্টোবর। ১৯৩৮ এর ১০ ই এপ্রিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির কার্য সমিতি গঠিত হলে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ঐ কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন। সেসময় দেবেন্দ্রলাল খান বেশ কিছু কংগ্রেস কর্মীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন 'মেদিনীপুর কর্মী সংঘ'।
১৯৪০ সালে মেদিনীপুরে ভয়াবহ বন্যার সময় গঠিত হয় 'মেদিনীপুর বন্যা সাহায্য সমিতি'। তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা। এই বিষয়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এই সমিতির সম্পাদক অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, "মেদিনীপুরের বন্যাবিদ্ধস্ত অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ নরনারীকে কি প্রকারে সাহায্য দেওয়া যাইতে পারে তাহা চিন্তা করিয়া আমি খুব ব্যাকুল হইতেছি। কুমার দেবেন্দ্রলাল খান প্রমুখ মেদিনীপুরের জনসেবক এই কার্যে অগ্রসর হইয়াছে তাহা সুখের বিষয়"!
তিনি ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের এক নির্ভিক যোদ্ধা। তাঁকে 'দেশভক্ত' সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল। রাজা দেবেন্দ্রলাল খানের নামে দক্ষিণ কলকাতায় 'ডি এল খান রোড' নামে একটি রাস্তার নামকরণ হয়েছে। এটি এ জে সি বোস রোড এবং বেলভেদেরার রোডকে যুক্ত করেছে। ১৯৫৭ সালে দেবেন্দ্রলাল খানের নামে ভবানীপুর রোডের এই নামকরণ করা হয়।
চিত্র ঋণ -- দেবাশীষ ভট্টাচার্য
🍂
0 Comments