জ্বলদর্চি

উদয়ের পথে/দ্বাবিংশতি পর্ব/মলয় সরকার

ফুসিমি ইনারি মন্দিরে ঢোকার প্রথম প্রবেশপথ

উদয়ের পথে
দ্বাবিংশতি পর্ব

মলয় সরকার



পরদিন।আজ আমাদের জাপান ভ্রমণপর্ব শেষ হবে। বেরোতে হবে রাত তিনটেয়। তার আগে ইচ্ছা কিয়োটোর বিখ্যাত শিন্টো মন্দির, ফুসিমি ইনারি শ্রাইন দেখে নেওয়ার।

সকাল থেকেই আজ বৃষ্টি পড়ছে, তাই চিন্তায় ছিলাম। যদিও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, তবুও বৃষ্টি পড়লে ঠিক ভাল লাগে না বেরোতে।এদিকে আবার আজই শেষ দিন, না দেখলে বাদ যাবে। মোটামুটি যা যা দেখব বলে প্ল্যান করেছিলাম, সবই দেখা হল। এটাই বাদ আছে।ভাবলাম, এটা তো কাছেই শহরের মধ্যেই। একটু পরেই না হয় বেরোন যাবে।দেখা যাক, বৃষ্টি কি করে। 

বেলা একটু বাড়তে বৃষ্টি অনেকটা ধরে এল।তখন বেরোতেই হল, ছাতা সঙ্গে নিয়ে।গাড়ির যে ড্রাইভারটি ছিল, যদিও খুব ভাল ইংরাজী বোঝে না, তবু বেশ রসিক, আলাপী আর আমুদে। নানা কথা বলে যাচ্ছিল। সে বলে, এখানে যারা আসে তারা বেশিরভাগই বিদেশী বা পর্যটক। সাধারণতঃ স্থানীয় মানুষ একে বেশি গুরুত্ব দেয় না। আমরা ওর সব কথা বিশ্বাস করলাম না।
এভাবেই তৈরী হয়েছে মানত করা টোরিগেটের তৈরী রাস্তা

আমরা গাড়ি থেকে নামতেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি এল। বুঝলাম, আজ একে সঙ্গে নিয়েই চলতে হবে। অবশ্য জাপানে ঘুরতে গেলে একে নিয়েই চলতে হয়।

এই মন্দিরটিকে Fushimi Inari-taisha ও বলে। কারণ এই জায়গাটির নাম ফুসিমি, আর যে পাহাড়ে এই মন্দির সেই ২৩৩ ফুট উঁচু পাহাড়ের নাম ইনারি।

এখানে যা বিখ্যাত তা হল এখানকার টোরি গেট।এই দেবতা আসলে ধান বা চাষের দেবতা। কিন্তু ব্যবসায়ীরাও এনাকে মানে, ব্যবসার দেবতা বলে।এখানে লোকে মানত করে নিজেদের উন্নতির জন্য আর মানতের দ্রব্য হিসাবে এই টোরি গেট দেয়।এই গেটগুলি প্রধানতঃ কমলা রঙের।এই গেটের আর্থিক মূল্য ধরা হয় ৪ লক্ষ ইয়েন থেকে ১০ লক্ষ ইয়েন পর্যন্ত। এ ছাড়া যাদের আর্থিক ক্ষমতা কম, তাদের জন্য অবশ্য ছোট গেট, আছে। এই রকম বহু মানুষ এই মানত করে।দিতে দিতে এই টোরি গেটের জঙ্গল তৈরী হয়েছে। 
মন্দিরের ভিতরের প্রবেশদ্বা্রের দুইদিকে শেয়াল দেবতা

রাস্তার থেকে মন্দিরের দিকে এগোতেই প্রথমেই পেলাম এক বিশাল টোরি গেট, যা ওই মন্দিরের চিহ্ন।এই মন্দিরটি একটি সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত মন্দির।
যদিও ৭১১ সালে এর প্রথম ভিত্তি স্থাপন হয়, তারপর বহু বার ধ্বংস ও স্থান পরিবর্তনের পর ১৪৯৯ সালে বর্তমান মন্দিরটি স্থাপিত হয়।

আমরা মন্দিরে ঢোকার মুখে একটি মঞ্চ মত চাতালে দেখলাম , এক হাল্কা বাঁশির সুরের সাথে একটি সুন্দরী মেয়ে নাচছে।এটা হয়ত ওই পূজারই অঙ্গ। তবে বেশ সুন্দর লাগছিল আর আবিষ্টের মত বহু মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছেন।

🍂
এক সময় নাচ শেষ হল।এক শান্ত মন্দিরের পরিবেশে এ রকম এক সুন্দরীর নৃত্য এমন সুন্দর হাল্কা সংগীতের সুরে মানুষকে স্বাভাবিক ভাবেই মুগ্ধ করে দেবে।
আমরা এগোলাম ধীরে ধীরে ।মেঘলা ভিজে আবহাওয়া। ঢোকার মুখে গেটে দেখি বহু শেয়াল দেবতার মূর্তি। এখানে আসলে ভাবা হয় , এই শেয়ালরা হল দেবতার বাহন বা দূত। কাজেই তাদের দেবতার সাথে শেয়ালদেরও পূজা করা হয়। এই শেয়ালরা আবার স্ত্রীপুরুষ উভয় লিঙ্গেরই হয়।তার কারণ তাদের দেবতা কামি, ও দেবী ইনারির জন্য এই ব্যবস্থা।
টোরিগেটের সারি, এখানেও শেয়াল দেবতা

আসলে প্রাচীন জাপানে শেয়ালদের সাথে ধান বা শস্যের একটা সংযোগ আছে মনে করা হত। কারণ শেয়ালরা ধানক্ষেতের  কাছাকাছিই থাকে। তাই মানুষ এদের শস্য, আগামী দিনের সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি এগুলোর প্রতীক মনে করেছে।

এই শেয়াল দেবতা বা বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারকে দেব দেবীর সাথে সংযোগের ব্যাপারটা সারা পৃথিবীর সমস্ত ধর্মেই আছে। আমাদের হিন্দুদের সব দেব দেবীর বাহন হিসাবে জঙ্গলের জন্তু জানোয়ারদেরই ভাবা হয়েছে। মিশর, চীন , ইউরোপ বহু জায়গাতেই দেবার্চনায়, রূপকথার গল্পে, লোকগাথায় মানুষ প্রাণীকুলকে একাত্ম করে নিয়েছে। এর থেকে অবশ্যই শিক্ষার আছে। সমস্ত জীবজগতের সাথে , তা প্রাণীকুল বা বৃক্ষকুল যাই হোক, সবার সঙ্গেই অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়েই মানুষ বাঁচতে শিখেছে। বর্তমানে একে অস্বীকার করাই হয়ত, আমাদের দুর্দশার কারণ।

একটু উপর দিকে উঠে গিয়েই দেখলাম, একটি বড় টোরিগেট, এবং সেখান থেকে দুটি রাস্তা দুপাশে চলে গেছে যা অপেক্ষাকৃত সরু। অর্থাৎ এই রাস্তা দুটি ঐ বড় গেটটির অর্ধেক মাপের গেট , পর পর ঘন সন্নিবিষ্ট করে এগিয়ে গেছে, যেন দুপাশে দেওয়াল সহ মাথায় ছাদ নিয়ে দুটি রাস্তা। এই গেটের দুপাশের খুঁটি গুলি, অনেক ক্ষেত্রে দেখলাম মোটা বাঁশের উপর রঙ করা, আবার কখনও মোটা পাইপের উপর রঙ করা। রংটা প্রায়শঃই গাঢ় কমলা। অবশ্য বেশি বড় গেটগুলোর খুঁটি কংক্রীটেরও হতে পারে বা অন্য কিছু।আসলে এগুলি অতীত দিনে কাঠেরই হত। এখন বহু জিনিস ব্যবহৃত হয় এর জন্য।

এবার বলি এই টোরি গেটের কথা। এই টোরি গেট গুলি সাধারণতঃ ব্যবহার হয় শিন্টো মন্দিরে। এতে ভাবা হয় যে এই গেট দিয়ে ঢুকলে অপবিত্রতা কেটে গিয়ে পবিত্রতা আসবে এবং এতে দেবতাকে আহ্বান বা স্বাগত জানানো হয় এই গেটের মাধ্যমে।

এই গেটের একেবারে মাথার নৌকাকৃতি অংশটি  এবং দুপাশে স্তম্ভের নীচের অংশ গুলি হয় কালো এবং বাকী অংশ পুরোটাই কমলা।বাজারে বা এরকম শিন্টো মন্দিরের সামনে ছোট বড় নানা টোরি গেটের মডেল পাওয়া যায়, যেগুলো সাধারণ মানুষ মানত হিসাবে দেবতার স্থানে দেয়, যেমনটি আমাদের পীরের থানে মাটির ঘোড়া দেওয়ার রেওয়াজ আছে। অনেকে ব্যবসায়ে বা অন্য কোন ভাবে সাফল্য পেলেও দেবতাকে এই টোরিগেট দান করে নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী।

আর এই লালচে কমলা রংটা থাকার কারণ হল, লাল যেহেতু রক্তের রঙ, তাই একে ওরা প্রাণশক্তির প্রতীক মনে করে। তা ছাড়া একে ওরা পবিত্রতার প্রতীকও মনে করে।  
অনান্য অন্য শিন্টো মন্দিরের চেয়ে এখানে এই টোরিগেট দান করার রেওয়াজটা বেশি, যেমনটি অনেক কালী মন্দির থাকলেও লোকে কালীঘাট বা তারাপীঠ  ইত্যাদি জায়গায় বেশি পশুবলি দেয়।তাই সব মিলিয়ে এই জায়গার গুরুত্ব বা সৌন্দর্য্যও বেশি।

এই গেট দিয়ে তৈরী রাস্তায় যেতে যে কি সুন্দর লাগছিল কি বলব! সবাই এর ভিতরে ঢুকে ছবি এবং সেলফি নিতে ব্যস্ত।চারিদিকে পাহাড়ি জঙ্গল বা গাছ ও যথেষ্ট। একট সব মিলিয়ে, ভিজে স্নিগ্ধতা আর মোহময় পরিবেশ তৈরি করেছে।এখানে মনে হয়, আর কোন দেবতার বা মন্দিরের প্রয়োজন নেই। এই পরিবেশই পূজার বা অর্চনার জন্য যথেষ্ট। 
জোর বৃষ্টি এসে গেল হঠাৎ। আমরা সবার সাথে একটু দাঁড়ালাম আড়ালে।দু একটা দেবতার বসার মত জায়গা করা রয়েছে, কিন্তু সব ফাঁকা। সেটাই ভাবছিলাম, এখানে এই পরিবেশে দেবতার সত্যিই কোন কাজ নেই। এটাই আসলে শিন্টো ধর্মের ভিতরের কথা। 

যাই হোক, আমরা ভিতরের আশ্রমিক পরিবেশে বৃষ্টি ভেজা পথে ঘুরলাম খানিকক্ষণ।মন শান্ত হয়ে গেল। শেষে বেরোবার শেষ ঘণ্টা পড়ল। 
মন্দিরে মনোস্কামনা মানতের কাঠের প্লেট

বের হওয়ার পথে দেখলাম, আমাদের দেশের মতই ধর্মস্থানে পর্যটকদের কাছে বিক্রীর জন্য দোকান রয়েছে অনেকই।এ ব্যাপারটাও সারা পৃথিবীর সমস্ত ধর্মের ধর্মস্থানের একই চিত্র, অল্প কিছু জায়গা ছাড়া।আসলে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ,সারা পৃথিবীর সমস্ত জায়গার , মূলতঃ এক। যেটুকু পরিবর্তন বা তফাত,তা হল, স্থান এবং পরিবেশের উপর ভিত্তি করে ।আমরাও কিনলাম দু একটি জাপান ভ্রমণের স্মৃতিচিহ্ন ।


এবার আমাদের ফেরার পালা। রাত সাড়ে তিনটেয় বেরোনো। যেতে হবে কিয়োটো থেকে ওসাকা বিমান বন্দরে।
আগে থেকে ব্যবস্থা করা ছিল। গাড়ি এসে গেল ঠিক সময়ে। আমরা ফাঁকা রাস্তায় ভোরের আগেই পৌঁছে গেলাম নিঝুম শহরের বুক চিরে ওসাকা এয়ার পোর্টে। তখনও রাস্তায় আলো নেভে নি, শহর জাগে নি। এয়ারপোর্টে এসে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কোন এয়ার পোর্ট রাতে বন্ধ থাকে এটা আগে দেখি নি। এখানে দেখি সব বন্ধ। এমন কি, বাইরের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়া থেকে বাঁচার জন্যও এতটুকু ভিতরে ঢুকে আড়ালে বসে থাকব, সে ব্যবস্থাও নেই। নিছক বাইরে ঠাণ্ডায় চেয়ারে বসে থাকলাম। ধীরে ধীরে আর দু একজন এলেন। তাঁদেরও ওই একই অবস্থা।কোন মানুষও নেই যাকে কিছু জিজ্ঞাসা করব।অগত্যা–

ঘড়িতে যখন পাঁচটা বাজল, তবে দু একজন করে স্টাফেরা আসতে শুরু করলেন।তারপর দরজা খুলতে ভিতরে ঢুকে তবে একটু দাঁড়াতে পেলাম। তবে স্বস্তি পেলাম, কারণ ভিতরে অত ঠাণ্ডা ছিল না

।সাড়ে পাঁচটায় কাজ শুরু হল। আমাদের কাউন্টারে ছিল একটি  সুন্দরী অল্প বয়সী মেয়ে।সে সব দেখে টিকিট করে দিল হাসি মুখে। তারপর অস্থির হয়ে বলল, আরে আপনাদের তো দুজনেরই হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করতে বলা আছে। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন, নিশ্চয়ই কষ্ট হচ্ছে।
সম্মতি দিলাম, তা একটু হচ্ছে। 
সে দৌড়াল কাউন্টার ছেড়ে। বলে গেল, দাঁড়ান দেখছি,আগে হুইল চেয়ার নিয়ে আসি। ভাবলাম, এ আবার কি, অন্য ছেলেকে বা হুইল চেয়ারের স্টাফকে ডেকে দেবে তো! এত লোক লাইনে রয়েছে।

যাক, দেখি কোথা থেকে দুটো হুইল চেয়ার একাই ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এল। এসে বলল, বসুন। বসলাম দুজনে দুটোতে।সে বলল, এ ভাবে বসুন- বলে দুটো পা নিজের হাতে তুলে যত্ন করে বসিয়ে ঠিক করে দিল। আমার এই যত্নের আবেগে চোখে জল এসে গেল- ঠিক যেন আমার নিজের মেয়ে , বয়স্ক বাবাকে যত্ন করছে। একটা বাইরের মেয়ে বিদেশী এক বয়স্ককে এভাবে যত্ন করবে ভাবি নি। আমার গিন্নীও আশ্চর্য। তারপর বলে কিনা, ইস, ঠেলার লোক নেই! দেখছি, বলে আবার দৌড়াল, হুইল চেয়ারের লোক আনতে।ততক্ষণে লাইনের লোক দাঁড়িয়ে হাঁ করে সে মেয়ের কীর্তিকলাপ দেখছে।

এই একটা ব্যাপারেই আমিও ভালবেসে ফেললাম সেই ছোট্ট সুন্দরী  জাপান  তনয়াকে ।শুধু আমি নয়, বুলবুলও।এর কথাই আমি আগে বলেছিলাম, যে জাপানী মেয়ের ভালবাসায় আমার মনও বাঁধা পড়ল তার কাছে।

নতুন করে আরো একবার জাপানের মানুষের ভালবাসায় বাঁধা পড়লাম সারাজীবনের মত।ক্রমশঃআমরাও এসে গেলাম আমার পথচলতি জাপান ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে।দেখলাম অনেক কিছু ,শিখলাম অনেক কিছ্‌ নতুন জিনিস জানাও হল বহু। তবু মন বলে, চলো চলো রঙের খেলায় এই মাটির পথে পথে । দেখতে থাকো মন বাউলের একতারাটি সুরের রঙে বেঁধে নিয়ে------ক্রমশঃ--

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments