৪২তম পর্ব
তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
প্রাচীন জনপদ দ্বীপভূমি ভেটদ্বারকার ভূমিকম্পে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তবে এখানে যে শ্রীকৃষ্ণের বাসভূমি ছিল তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না কারণ জলোচ্ছ্বাসে প্রাচীনকালের সেই দ্বীপ হয়তো পুরোপুরি সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরবর্তীকালে বেট দ্বারকা নামে এই অঞ্চলে শ্রীকৃষ্ণের মন্দির গড়ে ওঠে। প্রখ্যাত গবেষক ডঃ এস আর রাও তাঁর লিখিত 'প্রগ্রেস অ্যান্ড প্রসপেক্ট অফ মেরিন আর্কিওলজি ইন ইন্ডিয়া' গ্রন্থে বলেছেন দ্বারকা ও বেটদ্বারকা কবে সমুদ্রে ডুবে যায় তা নিশ্চিত ভাবে বলতে হলে সিন্ধু সভ্যতার একটি মুদ্রা, একটি মাটির পাত্র এবং একটি ছেনি ইত্যাদির সাহায্য নিতে হয়। যে মুদ্রাগুলি পাওয়া গেছে তাতে একটি ষাঁড়ের, একটি ঘোড়ার ও একটি ছাগলের মূর্তি খোদাই করা আছে। এছাড়া বেটদ্বারকার আশপাশের এলাকা থেকে উদ্ধারপ্রাপ্ত বিভিন্ন ধরনের পাত্রের অংশবিশেষ থেকে এই অনুমানে পৌঁছাতে অসুবিধা হয় না যে প্রাচীন যুগে এই অঞ্চলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের বাহেরিন সহ কয়েকটি জায়গার ব্যবসায়িক সম্বন্ধ ছিল। বেটদ্বারকা যে সময়ে ডুবে যায় সেই সময় বাহেরিনের কিছু কিছু এলাকাও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ডুবে গিয়েছিল। বেটদ্বারকা থেকে পাওয়া মুদ্রা আনুমানিক পনেরশো খ্রিস্টপূর্বের। দ্বারকার কাছে সমুদ্র থেকে লোহার নোঙ্গর পাওয়া গেছে। বিভিন্ন ওজনের এই নোঙ্গরগুলি খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১৪০০ বছর আগেকার বলে মনে করা হয়। এইগুলি পর্যালোচনা করে ডক্টর রাও অভিমত দিয়েছেন আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে মূল দ্বারকা ও বেটদ্বারকা জলোচ্ছ্বাসে সমুদ্রের তলায় তলিয়ে যায়। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় বর্তমানে আমরা যে দ্বারকা ও বেটদ্বারকা দেখতে যাই সেগুলি খুব প্রাচীন নয়। শ্রীদ্বারকাধীশ মন্দিরটি এখন যেখানে অবস্থিত তার থেকে খানিকটা দূরে সমুদ্রতট লাগোয়া বিভিন্ন জায়গা খনন করে প্রথম, চতুর্থ ও অষ্টম শতাব্দীর মন্দিরের ভগ্নাবশেষ আবিষ্কার করেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। অষ্টম শতাব্দীর মন্দিরের ভগ্নাবশেষ থেকে ভগবান বিষ্ণু, শিব-পার্বতী, দেবরাজ ইন্দ্র, লক্ষ্মীসহ অনেক দেবদেবীর মুর্তি পাওয়া গেছে। সেই যুগের শিল্পীদের মন্দির নির্মাণের নৈপুণ্যতা এইসব ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রমাণিত হয়। দক্ষিণ ভারতের চালুক্য ও রাষ্ট্রকূট রাজাদের আমলের শিল্পীদের শিল্পশৈলীর পরিচয় পাওয়া যায় মন্দিরের গায়ে আঁকা পশুপাখি ও রেখাচিত্র থেকে।
🍂
আরও পড়ুন 👇
দ্বারকা অভিমুখে
২০১৮ সালের ৩০শে নভেম্বর রাত্রি এগারোটা বেজে চল্লিশ মিনিটে মেদিনীপুর স্টেশন থেকে ১২১৫২ নম্বর শালিমার-সমরসত্তা এক্সপ্রেসের শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কামরার সওয়ারী হয়ে আমি ও আমার যাত্রাপথের সঙ্গিনী আমার সহধর্মিনী সুমিতা পুনরায় পর্যটনে বেরিয়েছি। আমাদের এবারের ভ্রমণসূচীতে আমরা স্থির করেছি মুম্বাই, দ্বারকা, সোমনাথ, দিউ, জামনগর হয়ে গোয়া যাব এবং সেখান থেকে ফিরে আসব। মাঝখানে একদিন ট্রেনে কাটিয়ে তৃতীয় দিন সকালে আমরা মুম্বাই গিয়ে পৌছালাম। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র দ্বারকাধাম দর্শন সম্বন্ধে সেজন্য বিভিন্ন জায়গার দর্শনীয় স্থান সম্বন্ধে বিস্তারিত তথ্যের মধ্যে গেলাম না। মুম্বাইয়ে একদিন থেকে কয়েকটি দর্শনীয় স্থান দেখে পরের দিন রাত্রিতে আমরা মুম্বাই-ওখা এক্সপ্রেসে করে দ্বারকার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মোটামুটি নির্দিষ্ট সময়ে ট্রেন যাচ্ছে। রাজকোট স্টেশন থেকে কয়েকজন সন্ন্যাসী ট্রেনে উঠলেন। তাঁদের কথাবার্তা শুনে মনে হল তাঁরাও দ্বারকায় যাবেন। যাইহোক প্রায় নির্দিষ্ট সময়ে বিকেল তিনটের সময় যেয়ে ট্রেন দ্বারকায় পৌঁছালো। ট্রেনটি এখান থেকে শেষ গন্তব্যস্থল ওখা যাবে। কিন্তু এখানেই অধিকাংশ যাত্রী নেমে গেলেন।
পরের দিন দুপুর তিনটেয় আমরা দ্বারকা স্টেশনে গিয়ে পৌছালাম। এই লাইনের শেষ স্টেশন ওখা, দ্বারকা থেকে আরও ৩০ কিলোমিটার। দ্বারকা শহর খুব একটা বড় নয়, এর আগে প্রায় ১৫ বছর পূর্বে দ্বারকায় এসেছিলাম। সেই সময়ের সাথে আজকের দ্বারকার কোন তুলনাই হয়না। চারিদিকে প্রচুর সুদৃশ্য অট্টালিকা ও হোটেল গড়ে উঠেছে। হোটেলগুলির ভাড়া মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে, এছাড়াও বেশ কয়েকটি লজ, ধরমশালা ও আশ্রম আছে অল্প খরচে থাকবার সুবিধা। সমস্ত হোটেল রেস্তোরায় নিরামিষ খাবার। সকালের জলখাবার পুরি, সবজি, গাটিয়া, ধোকলা ইত্যাদি। একসময় নাম ছিল সৌরাষ্ট্র পরে নাম পরিবর্তন করে হয়েছে গুজরাট। দেশের গুরুত্বপূর্ণ এক তীর্থস্থান হিসেবে গুজরাটের এই দ্বারকার গুরুত্ব দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে রাস্তাঘাটের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। স্টেশন থেকে একটি অটো নিয়ে আমরা আমাদের নির্ধারিত থাকার জায়গা 'দ্বারকা রেসিডেন্সি' হোটেলে গিয়ে পৌছালাম। হোটেলের ব্যবস্থাপনা খুব সুন্দর। এখানে আমরা দুদিন থেকে দ্বারকা এবং সন্নিহিত অঞ্চলের দর্শনীয় স্থানগুলি দেখে সোমনাথ যাব। দ্বারকায় পূর্ণ পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীদ্বারকাধীশ নামে খ্যাত, সমগ্র দ্বারকার মন্দির’ এই হোটেল থেকে মিনিট কয়েকের দূরত্বে, হাঁটা পথ। সন্ধ্যার পূর্বে আমাদের হোটেল থেকে হাঁটা পথ দূরত্বে গোমতী নদীর তীরের অপরূপ সূর্যাস্ত দেখে আমরা গোমতী নদীর দিক থেকে শ্রী দ্বারকাধীশ মন্দিরের যে সিঁড়ি উঠে গেছে, যেটি স্বর্গদ্বার নামে পরিচিত, সেইটি দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। সিঁড়ির পাশেই আদি শংকরাচার্য প্রতিষ্ঠিত সারদাপীঠ অবস্থিত। মন্দিরে আদি শঙ্করাচার্যের বিগ্রহকে প্রত্যহ পুজো করা হয়। আমরা মন্দির দর্শনে যেয়ে সেই যুগন্ধর মহাপুরুষকে প্রণাম জানিয়ে শ্রীদ্বারকাধীশ মন্দিরে গিয়ে প্রবেশ করলাম। এটি দক্ষিণদ্বার বা স্বর্গদ্বার নামে পরিচিত। ৫৬টি সিঁড়ি পেরিয়ে মন্দির চত্বরে পৌঁছাতে হয়। গোমতী মায়ের মন্দির থেকে এই সিঁড়িগুলি ও দ্বারটি পরিষ্কার দেখা যায়। তবে মুখ্যদ্বার দিয়ে যাওয়াই ভালো সেখানে সিঁড়িতে ওঠার কষ্ট নেই। দুটি দ্বারেই নিরাপত্তারক্ষীরা মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে যাত্রীদের তল্লাশি করে মন্দিরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন। মোবাইল, ক্যামেরা ইত্যাদি নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করা যায় না।
বর্তমানের শ্রী দ্বারকাধীশের মন্দির কবে নির্মাণ করা হয়েছিল তা নিয়ে বিভিন্নজনের বিভিন্ন মত। তবে বেশিরভাগ প্রত্নতত্ত্ববিদ মনে করেন শ্রী দ্বারকাধীশের নিজ মন্দির বা গর্ভগৃহ দ্বাদশ শতাব্দীতে অথবা তারপরে নির্মাণ করা হয়েছিল। গর্ভগৃহের উপরে সাততলা মন্দির চূড়ার গঠনশৈলী অপূর্ব। মন্দিরের একতলার মেঝে থেকে মন্দিরশীর্ষে যে স্বর্ণকলস দেখা যায় তার উচ্চতা ১২৫ ফুট এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই দ্বারকাধীশ মন্দির ৪৫ ফুট উপরে। মন্দিরটি চার ভাগে বিভক্ত - ১) বিরাম ঘর ২) ভদ্রপীঠ ৩) লাডভই মন্ডপ ও ৪) অর্থ মন্ডপ। স্বর্ণ কলসের সামান্য নিচে গোলাকৃতি পাথরের খাঁজের সঙ্গে একটি লোহার পাঠাতন যুক্ত আছে। লোহার পাটাতনের সঙ্গে সুপারি গাছের একটি কান্ড বাঁধা এবং সেই কান্ডের মাথায় আবার সীশম কাঠ যুক্ত। কান্ডটির উচ্চতা ২০ ফুট এবং এর সঙ্গে ত্রিভুজ আকৃতি চল্লিশ মিটার ধ্বজা লাগানো থাকে। ধ্বজার রঙ পুরো সাদা অথবা বিভিন্ন রঙের কাপড়ের টুকরো জুড়ে তৈরি করা হয়। কিন্তু কালো রংয়ের কাপড় কখনই দেওয়া হয় না। ধ্বজার মাঝখানে অর্ধচন্দ্র ও সূর্যের চিহ্ন। ওই লোহার পাটাতনের উপরে দাঁড়িয়ে ধ্বজা পাল্টানো হয়। এখানে উল্লেখ্য যে গুজরাটের ত্রিবেদী পরিবারের সদস্যরাই এই ধ্বজা লাগানোর দায়িত্বে থাকেন। যারা এই ধ্বজা লাগান উপরে উঠে তাদেরকে ধ্বজাপান্ডা বলা হয়। প্রতিদিন চার বার ধ্বজা পাল্টানো হয়। সারাদিনে তিনবার এবং সন্ধ্যার সময় একবার। পূর্ণিমার দিনে আরও একবার ধ্বজা পাল্টানো হয়। তীর্থযাত্রীদের মানত পূরণের জন্য এই ধ্বজা পাল্টানো বা লাগানো হয়। এই ব্যাপারে শ্রী দ্বারকাধীশ মন্দির দেবস্থান সমিতির কার্যালয়ে যোগাযোগ করে কবে ধ্বজা লাগানো হবে সেই ব্যাপারে দিনস্থির করা হয় এবং তার জন্য আগের থেকে টাকা দিয়ে বুকিং করতে হয়। সেই টাকার পরিমান প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকা এবং তার সঙ্গে 'গুগ্গুলি' সম্প্রদায়ের সমস্ত ব্রাহ্মণকে এক বেলা আহারের বন্দোবস্তর খরচও ধ্বজা উত্তোলনকারী সেই তীর্থযাত্রীকে জমা দিতে হয়।
পরবর্তী অংশ ৪৩তম পর্বে
0 Comments