জ্বলদর্চি

মহাভারতের স্বল্পখ্যাত কিছু চরিত্র/পঞ্চম পর্ব/ প্রসূন কাঞ্জিলাল

মহাভারতের স্বল্পখ্যাত কিছু চরিত্র
পঞ্চম  পর্ব 
প্রসূন কাঞ্জিলাল


গান্ধাররাজ সুবল 

গান্ধাররাজ সুবল ছিলেন  গান্ধারী ও শকুনির পিতা, ধৃতরাষ্ট্রের শ্বশুর, দুর্যোধনের দাদামশাই এবং উলূকের ঠাকুর্দা।

 শকুনি ছাড়াও এঁর বাকি অন্য সাত পুত্রের নাম ছিল — গবাক্ষ, শরৎ, বিভু, সুভগ, ভানুদত্ত, বৃষক এবং অচল।

গান্ধাররাজ সুবলের পুত্র ও গান্ধারীর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শকুনি। তিনি মহাভারতের প্রধান খলনায়ক। সুবলের কোনও এক পাপের কারণে দেবতাদের অভিশাপে তাঁর বংশে শকুনির জন্ম হয়। শকুনির জন্ম কলির অংশে; তাই তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধূর্ত ও কপট। গান্ধারীর বিবাহের পর থেকে শকুনি ধৃতরাষ্ট্রের সংসারেই থাকতেন এবং ভাগিনেয় দুর্যোধনের সঙ্গে ওঁর বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। তাঁর কারণেই মহাভারতের বিচিত্র ঘটনাগুলো আবর্তিত হয়েছে। তিনি অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী নন;তথাপি তাঁর কপট বুদ্ধিতেই সমগ্ৰ কুরুবংশ ধ্বংস হয়েছিল।এই প্রতিশোধের কাহিনীর শুরু গান্ধার রাজ সুবলের হাত ধরেই।
🍂
  গান্ধার রাজ সুবলের কন্যা গান্ধারীর বিবাহের পূর্বেই তাঁর পরিবার জানতে পারে যে, তিনি মাঙ্গলিক। তাই তাঁকে প্রথমে একটা ছাগলের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়। 
   তখন কৌরব মাতা গান্ধারী সংসারে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। একদিন পিতামহ ভীষ্মের কানে পৌঁছে গেল কেমন করে যে, গান্ধার রাজকন্যা বিবাহপূর্বে নাকি বিধবা ছিলেন। চারিদিকে গুপ্তচর ছুটল, জ্যোতিষীদের ডাক পড়ল সত্যাসত্য যাচাই করতে। জানা গেল সত্যিই নাকি গান্ধার রাজ সুবলকে সভার রাজজ্যোতিষী বলেছিলেন, গান্ধারীর প্রথম পতির আয়ু সীমিত, কিন্তু দ্বিতীয় পতির আয়ু হবে অনেক। তাই তড়িঘড়ি
একটি ছাগলের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দিয়ে সেই দোষ স্খলন করেছিলেন তিনি এবং ছাগ পুঙ্গবটি যথারীতি পরে পরেই সদ্গতি প্রাপ্ত হয়।সেই ছাগলের মৃত্যুর পর ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। এক বিধবাকে ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয়েছে জানতে পেরে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম ক্রোধান্বিত হন, এবং গান্ধাররাজ সুবল ও গান্ধারের সমগ্র রাজপরিবারকে কারাবন্দি করেন। তাঁদের জন্য দিনে এক দানা করে অন্ন বরাদ্দ ছিলো। তবে বাকি বন্দিরা জানতেন যে, এহেন অত্যাচারের প্রতিশোধ যদি কেউ নিতে পারেন তো এক শকুনিই নিতে পারবেন। তাই তাঁরা তাঁদের সবার অন্ন শকুনিকে দিয়ে দেন; শকুনিকে বাঁচিয়ে রাখেন।

রাজা সুবল শেষ নিঃশ্বাস কালে শকুনির পায়ে ছুরিকাঘাত করেন এবং তাঁকে ব্যাথা মনে রাখতে এবং কুরু পরিবারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের কথা স্মরণ করতে বলেন।

  তাঁর কথায়, "সৌবালা, এখন থেকে তুমি খুঁড়িয়ে হাটবে আর প্রতিবার খোঁড়ানোর সময় মনে পড়ে যাবে কৌরবরা ও ভীষ্ম আমাদের প্রতি কী ভীষণ অন্যায় করেছে, যার ক্ষমা নেই। কৌরবদের বিনাশেই আমার আত্মা শান্তি পাবে, সে কথা বিস্মরণ হয়ো না।" 

 সবাই মারা গেলে ধৃতরাষ্ট্র শকুনিকে কারাগার থেকে বের করে আনেন। শকুনি তাঁর পিতা গান্ধাররাজ সুবলের অস্থি দিয়ে পাশা নির্মাণ করেন , যা শকুনির কথা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। একেই তিনি বানান কুরুবংশের বিপক্ষে তাঁর ‌প্রতিশোধ নেওয়ার অস্ত্র। এই পাশা দিয়েই কপট অক্ষক্রীড়ার মাধ্যমে পাণ্ডবদের বনবাসে পাঠান। শকুনি মূলত পান্ডবদের শত্রু ছিলেন না,ভীষ্ম ও কুরু বংশের ধ্বংসের কারণ হতে চেয়েছিলেন।তিনি কৌরবদের মধ্যে বিভাজন নীতি চালিয়ে দুই পক্ষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে কুরুক্ষেত্রে কুরুবংশ ধ্বংস করে দেন।

   বেদব্যাস রচিত মূল এমন কোনো ঘটনার উল্লেখ নেই। পাশা যদি সুবলের অস্থি দিয়েই নির্মিত হতে হয়, তবে সুবলকে আগে মারা যেতে হবে। কিন্তু মূল মহাভারতের সুবল তাঁর রাজপরিবার নিয়ে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে এসেছিলেন, এবং পরে কুরুক্ষেত্রে শকুনির ভ্রাতারা লড়েওছিলেন। সেখানে তাঁরা মারা যান, কিন্তু তা পাশাপর্বের অনেক পরের ঘটনা।

   ওপরের গল্পটি অনেক পরের সংযোজন। গল্পটির সর্বপ্রাচীন উপস্থিতি দেখা যায় অষ্টম শতাব্দীর জৈন গ্রন্থ হরিবংশ পুরাণ-এ। একইরকম ঘটনা দেখা যায় একাদশ শতকের কথাসরিৎসাগর-এর নন্দবংশের ধ্বংসের ক্ষেত্রেও।।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments