জ্বলদর্চি

ইস্কুল ফিস্কুল/পর্ব -৬/সৌমেন রায়

ইস্কুল ফিস্কুল  
পর্ব -৬

সৌমেন রায়

চিত্র – অসিত কুমার সেনাপতি


আকাশেতে ঝুল ঝোলে কাঠে তাই গর্ত

ছেলেমেয়েরা স্কুল যাচ্ছে কিন্তু শিখছে না কেন ?  ঠোঙা ভরা বাদাম ভাজা, খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না কেন ? এর কারণ সবচেয়ে ভালো জানার কথা অভিভাবকের, তারপর শিক্ষকের। যাদের বাচ্চারা শিখছে না সেই সমস্ত অভিভাবকরা খানিক দুর্বল। তারা এই প্রশ্ন করার মত সংগঠিত নয়। তারা রাস্তা হয়নি কেন, জল নেই কেন, আলো নেই কেন এগুলো যেমন জোরের সঙ্গে বলতে পারেন শিক্ষা হয়নি কেন বলতে পারেন না। কারণ সে জগতের সঙ্গে তাদের পরিচিতি  কম।  শিখতে না পারাটাকে তারা নিজেদের সন্তানের ব্যর্থতা হিসেবে ধরে নেন। তার পিছনের কারণগুলি অনুসন্ধান করার ক্ষমতা তাদের নেই। আর যাদের ছেলেরা শিখছে এই ব্যবস্থার মধ্যে তারা সার বিষয়টা বুঝে গেছেন। চেঁচামেচি করে কিছু হবে না। তারা বুক দিয়ে নিজের ছেলেকে আঁকড়ে, হাতে ধরে শিখিয়ে নিচ্ছেন। স্কুল থেকেও আদায় করে নিচ্ছেন কিছু। কারণ স্কুলও জানে এরা সচেতন অভিভাবক এদের চাহিদার দিকে তাকাতে হবে। আর শিক্ষকের কথা প্রায়শই কেউ শোনে না। তারা বিশেষ কিছু সমস্যার কথা বললে শিক্ষাবিদ ,বুদ্ধিজীবী, নীতি রচনাকার কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দেন না। উত্তর পাবে না বুঝে শিক্ষকও ধীরে ধীরে নীরব হয়ে যান । প্রকৃত উত্তরের পরিবর্তে তারা সর্বদাই ভাষণ শোনেন।  আরও বেশি সংখ্যক ছাত্রকে শিক্ষার আঙিনায় আনতে হবে , তাদের নীতি শিক্ষা দিতে হবে, মানুষের মতো মানুষ করে তুলতে হবে, শিক্ষা কে বইয়ের পাতায় আটকে রাখা চলবে না আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। হয়ত কোন শিক্ষক সাহস করে বলে ফেললেন স্কুলেই যদি না আসে কি করব কিংবা অক্ষর পরিচয় হয়নি কি করব?  তখন হয় ঘুরে ফিরে উপরের কথাগুলো আবার শুনতে হবে অথবা শিক্ষকের উপর দেবত্ব আরোপ করা হবে। বলা হবে মাস্টারমশাই আপনি জাতির মেরুদন্ড, আপনিই  তো  ওদের হাতে ধরে শেখাবেন। কিভাবে আপনি স্কুল টাইমে সেভেনের  ছেলেকে অক্ষর পরিচয় করাবেন, যোগ শেখাবেন ? আগে কেন শেখেনি সেসব উত্তর কেউ আপনাকে দেবে না ( পাঠকও হয়ত ভাবছেন উত্তরটি তো শিক্ষকের ই জানা উচিত। ঠিক কথা। ধারাবাহিক ভাবে পড়তে থাকুন উত্তর কিছু একটা পাবেন)। ঠিক বাংলা রচনা লিখে নম্বর পাওয়ার মত। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য প্রবন্ধে অজস্র বৈচিত্রের সন্ধান দিয়ে শেষে লেখা হবে  তাও আমরা একজাতি একপ্রান। কিভাবে  তার কোন সন্ধান, এমনকি সূত্র পর্যন্ত নেই। অর্থাৎ আকাশে ঝুল ঝোলে কাঠে  তাই গর্ত। শিক্ষা ক্ষেত্রেও তাই। কেনো হচ্ছে না, কি করলে হবে এসবের উত্তরও ঐ আকাশেতে ঝুল ঝোলে কাঠে তাই গর্ত।

               এই সমস্ত ঘটনার গভীরে  ঢোকার আগে দেখে নিতে হবে সরকার কি করছে। সরকার সাধারণত নীতি নির্ধারণ করে। না, না জাতীয় শিক্ষানীতি বা এরকম বড় বড় বিষয় নিয়ে ভাবা এই কথকতার বিষয় নয়। এসব বড়  বড় লোকদের ব্যাপার। ‘ছোটলোকের ‘ ছোট ভাবনা । যেমন ধরুন সরকার ঠিক করল  ক্লাস  নাইন থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত প্রজেক্ট দিতে হবে। এতে ছাত্র-ছাত্রীদের মৌলিক ভাবনার বিকাশ হবে, হাতেনাতে কাজ করার সুযোগ হবে। উত্তম কথা। বিভিন্ন বিষয়ের গাইডলাইন এলো। গাইডলাইন মেনে প্রজেক্ট এর রূপরেখা তৈরি হল। বেশ একটা ফীল গুড ভাব । মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা করছি। ও মা, প্রজেক্ট কেউ জমা দেয় না। অনেক সাধ্য সাধনার পর এক মেয়ে বলল স্যার আপনারটা খুব কড়া। মায়া প্রকাশনী , সাই বার্টিন প্রজেক্টের বই বের করে দিয়েছে। ওর থেকে লিখে দেব? শেষ পর্যন্ত প্রজেক্ট গুলো যা দাড়াল তা হল দেখে টুকে দেওয়া। লাভ হল কম্পিউটার সেন্টার গুলোর। ওখানে ফ্রন্ট পেজ করাতে হয়। যাক কারও তো লাভ হল। একদম টোকাটুকি দেখে অম্বল হয় এরকম একজন স্যার   ক্লাস টেনে দিলেন নিজের বাড়ির সম্ভাব্য ইলেকট্রিক বিল তৈরি করে জমা দেওয়ার জন্য। স্যাম্পল হিসেবে  একটা  হিসাব করেও দিলেন। নিচে সতর্কবাণী হিসেবে লিখে দিলেন যে নিজের বাড়ির হিসাব করবে। হিসাব করতে গিয়ে ভুল হলেও পুরো নম্বর পাবে। কিন্তু যদি এটা টুকে দাও তাহলে শূন্য পাবে। অনেকেই সতর্কবাণী উপেক্ষা করেছিল। জনা সাতেক  তো    সতর্কবাণী সহ টুকে জমা দিল। তারই মধ্যে কেউ চেষ্টা করেন কিন্তু তার কষ্ট অনেক। ভাবছেন দায়িত্ব তো স্টুডেন্টের। না দিলে তো নম্বর পাবে না। ব্যাপারটা  অত  সোজা  না। স্টুডেন্ট প্রজেক্ট জমা না দিলে  মাস্টারকে  বলা হবে আপনি উদ্বুদ্ধ করতে পারেননি। দরকার হলে আপনি লিখে নেন কিন্তু নম্বর দিতে হবে। তাই অনেক শিক্ষক প্রজেক্ট এর উদ্দেশ্য বুঝে নাকি না বুঝে জানিনা সহজ পন্থা নিয়েছেন। তারা বলেন ৩০ এর উপপাদ্যটা লিখে আনবি। কেউ বলেন বই থেকে 10 আর 11 পাতা  টুকে আনবি  ইত্যাদি । ছাত্র খুশ, শিক্ষক খুশ, মার্কশিট  খুশ। শহরাঞ্চলে ছাত্রছাত্রীরা  আবার  নিজেরা কষ্ট  করে টোকে না  পর্যন্ত, মা বাবা লিখে দেয়। সেই সময় তারা নম্বর বাড়ানোর অনুশীলন করে।

🍂
আরও পড়ুন 👇
সরকারিভাবে রুটিনে স্পেশাল ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিটি শ্রেণীর স্পেশাল ক্লাস  নির্দিষ্ট করা আছে  নির্দেশিকায়। কিভাবে হবে তার একটা গাইডলাইন আছে। সে গাইডলাইন মেনে যাতে ফাইভ টু টেন অল্প সল্প করে  বিবিধ বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে  তার  ব্যাবস্থা  করা যায়। বিভিন্ন বিষয় বলতে যেগুলি পাঠক্রমের মধ্যে নেই। যেমন ধরুন ব্যাংকের ফর্ম  পূরণ, সোশ্যাল অ্যাওয়ারনেস, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, ফিনান্সিয়াল অ্যাওয়ারনেস, ডিজিটাল   অ্যাওয়ারনেস ,স্টোরি টেলিং, লিসেনিং, কালচারাল অ্যাক্টিভিটি  সহ  অনেক  বিষয়। কিন্তু ক্লাসগুলি মোটেও সঠিকভাবে হয় না। প্রথমত শিক্ষক উপস্থিতি কম থাকলে প্রথমে এই ক্লাসগুলি কাটা যায়। দ্বিতীয়ত শিক্ষকরা বিষয়ের ক্লাস নিতে অধিক স্বচ্ছন্দ। এই ধরনের ক্লাস নিতে তাকে বিশেষ অনুশীলন করতে হয়, প্রস্তুতি নিতে হয়। সেটাতে প্রবল অনীহা । তাই এই ক্লাসগুলি হয় গল্প, না হলে খানিক জিকে পড়ানো হয় বা স্মার্ট ক্লাসে নিয়ে গিয়ে টিভি দেখানো হয়। স্টুডেন্টরাও এই ধরনের ক্লাসে খুব আগ্রহী সেটা অবশ্য নয়। তারা ভাবে স্পেশাল ক্লাস মানে আমোদ করার ক্লাস। কোথাও কোথাও আবার ক্লাস গুলি রুটিন থেকে বেমালুম উড়ে গেছে। 

                     সরকারি স্তরে কম্পিউটার এডুকেশন এর ব্যবস্থা হয়েছে। এক ক্লাস ছেলের জন্য দশটা কম্পিউটার। মাঝে মাঝে দু’চারটা খারাপ থাকে। হ্যাঁ সমস্যা আছে কিন্তু চেষ্টাটাও আছে। শেখানোর জন্য একজন অস্থায়ী শিক্ষকও দিয়েছে  কোথাও কোথাও। তিনি যদিও কি পড়াবেন আর কি পড়াবেন না সে নিয়ে দিশেহারা। সামান্য ব্যবস্থায় কম্পিউটার লিটারেসি সম্ভব কিনা সে প্রশ্ন থাকবেই। কিন্তু শুরুটা করা হয়েছে। এই ক্লাসটা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ প্রবল। এই ক্লাস কোন কারনে বন্ধ থাকলে যথাযথ স্থানে তারা অভিযোগ জানায় ।কিন্তু সমস্যা তো তৃণমূলে। ভালো করে পড়তে লিখতে না পারলে সে শিক্ষাও বেশি দূর আগায় না। এটা টিপলে ওটা হয়, ওটা টিপলে সেটা হয় এখানেই শেষ।

               সরকার সিলেবাস পরিমার্জন করেছে। নতুন ধরনের  বই করেছে। সেখানে  দেখানো  আছে অজস্র এক্টিভিটির মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া সম্ভব । সরকার  বহু সামাজিক প্রকল্প চালাচ্ছে শিক্ষার্থীদের জন্য। কিন্তু কোনভাবেই  কোন লাভ হচ্ছে না। সে সমস্ত ভেস্তে  দিচ্ছে  কোথাও প্রকাশনী সংস্থা, কোথাও অভিভাবক, কোথাও শিক্ষক , কোথাও ছাত্র নিজে, কোথাও সামাজিক পরিস্থিতি। কিভাবে ভেস্তে দিচ্ছে  সেই  সব  নিয়েই  পরের  পর্ব  গুলি।


Post a Comment

4 Comments

  1. AnonymousJuly 19, 2024

    It's a great creation indeed, go ahead please🙏, thanks & regards

    ReplyDelete
  2. সোমনাথ মুখোপাধ্যায়July 24, 2024

    শূন্যতা প্রসারমান। প্রশ্নগুলো অনেক চেপে রাখা সত্যকে উন্মোচন করে।

    ReplyDelete
  3. নির্মাল্য ঘোষOctober 10, 2024

    সবাইকে একই রকম ভাবে শিখতে হবে এটাই তো দস্তুর সেখানে এক একজন ছাত্রের ইচ্ছা অনিচ্ছা, শিক্ষক মহাশয়দের থেকে নেবার ক্ষমতা অক্ষমতার জায়গা কোথায়?

    ReplyDelete
  4. ও ! কি অসাধারণ লেখা !

    ReplyDelete