জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—ডেনমার্ক (ইউরোপ)সাগরের জল লোনা কেন /চিন্ময় দাশ

চিত্র-শুভম দাস

দূর দেশের লোকগল্প—ডেনমার্ক (ইউরোপ)
সাগরের জল লোনা কেন
চিন্ময় দাশ


এক বুড়ি থাকে এক গ্রামে। আর থাকে তার এক নাতি। ছেলেটা বয়সে তখন খুবই ছোট। বাবা মা দুজনেই মারা যায় তার। সমুদ্রে ঘেরা দেশ তাদের। মাছ ধরতে গিয়েছিল সাগরে। ডিঙ্গি নৌকা উলটে, ডুবে যায় দুজনে।

ভাগ্যিস ঠাকুমা বেঁচেছিল তখন। নাতিকে বুকে করে বড় করেছে বুড়ি। ছেলেটা একটু বড় হয়েছে, তাকে লিখতে শেখাল ঠাকুমা। কিছুদিন বাদে পড়তে শেখাল। এইভাবে বড় হতে লাগল ছেলেটা। 
নাতি বড় হচ্ছে, সেইসাথে ঠাকুমা বুড়ি হচ্ছে। সময় যায়, ঠাকুমা বুড়ি হয়। আরও বুড়ি হয়। 
জীবন তো একদিন ফুরোবেই। বুড়িও বুঝে গেল আর নয়। এবার যাবার ডাক এসে গিয়েছে। নাতিকে ডেকে বলল—আমার যাবার সময় হয়ে গিয়েছে। তেমন কিছু তো নাই আমার, তোমাকে দিয়ে যাবার মতন। আছে কেবল একটা জিনিষ। সেটাই দিয়ে যাব তোমাকে। 
বুড়ি বলল-- ঘরের কুলুঙ্গুতে একটা বাক্স আছে। ওটা নামিয়ে আনো।
বাক্স খুলে, ছোট্ট একটা যন্ত্র বের হোল। বুড়ি বলল—আমরা বলি কফি-যন্ত্র। আসলে এটা হোল একটা যাদু যন্ত্র। তোমার নিজের প্রয়োজনের জিনিষ যা চাইবে, এ তোমাকে সাথে সাথেই হাজির করে দেবে।
নাতির তো বিশ্বাস হয় না-- বলছ কী?
--ঠিকই বলছি, ভাই। ভুল কিছু নয়। তোমার ঠাকুরদারও ঠাকুরদার নাকি ছিল কফি খাওয়ার নেশা। চাইলেই কাপ ভরা কফি হাজির হয়ে যেত তার সামনে। এই যন্ত্রটাই কেবল এই বংশের সম্বল। তোমাকে দিয়ে গেলাম। সাবধানে যত্ন করে রেখো। 
ছেলের তো আনন্দ ধরে না। যন্ত্রটার গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে দেখছে। বুড়ি বলল—তবে ভাই, একটা কথা। কখনও যতটুকু দরকার, তার বেশি চাইবে না কখনও। ততটুকু পেয়ে গেলে, থেমে যেতে বলবে যন্ত্রকে। যন্ত্র  থেমে যাবে। এর এদিক ওদিক হলে কিন্তু বিপত্তি হবে। 
বুড়ি মারা গেল ক’দিন বাদে। ফাঁকা ঘরে মন খারাপ ছেলের। যন্ত্রটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ছেলেটা। বাইরে অনেক বড় দুনিয়া পড়ে আছে। দেখা যাক, কপালে কী আছে। 
কতদূর পথ চলে, খিদে লেগেছে। ছেলে ভাবল—যন্ত্রটাকে পরীক্ষা করে নেওয়া যাক এই সুযোগে। গাছে ঠেস দিয়ে বসল আরাম করে। যন্ত্রকে বলল—ভারি খিদে পেয়েছে। কিছুটা রুটি আর মাখন পেলে, ভালো হয়। 
মুখের কথা শেষ হোল না। এক প্লেট রুটি আর মাখন তার সামনে হাজির। ছেলেটাও সাথে সাথে বলে উঠল— থেমে যাও। এতেই হয়ে যাবে। আর নয়।
যন্ত্রও থেমে গেল সাথে সাথেই। 
পরদিন আবার পথ চলেছে। সমুদ্রে ঘেরা দেশ তাদের। যেদিকে তাকাও, কেবল নীল জল আর জল। সমুদ্রের তীরে এসে পড়েছে ছেলেটা। সে অবাক হয়ে ভাবে, এই জলের সীমানা কোথায়? কত দূরে? কারা থাকে সেই দূরের দেশে? 
সমুদ্রের পাড় ধরে চলেছে। চলতে চলতে একটা বন্দরে এসে পড়েছে ছেলে। ছোট-বড় কত রকমের জাহাজ সেখানে। একটা জাহাজে চোখ গেল তার। নোঙর তুলে, দড়ি-দড়া গোছানো চলছে। নিশ্চয় সাগরে পাড়ি দেবে। 
ছেলেটা নাবিকের কাছে গিয়ে হাজির। বলল—আমাকে কাজে নেবে তোমরা? আমি কাজ করতে চাই। 
ছেলেটাকে দেখে বেশ পছন্দ হয়ে গেল লোকটার। যুবক ছেলে। ছোটখাটো ফাই-ফরমাস খাটতে পারবে নিশ্চয়। তাছাড়া, অবসর সময়ে গল্পগুজবও করা যাবে। ছেলেটাকে তুলে নিল নাবিক। 
হঠাৎ একটা উটকো লোক এসে জুটে গেছে। মালিকের পেয়ারের লোক হয়েও উঠছে দিন দিন। মাঝি-মাল্লাদের একেবারেই পছন্দ নয় ব্যাপারটা। কেউ কেউ আবার তার পিছনে লেগে গেল। এটা ওটা বলে, উত্যক্ত করতে থাকে ছেলেটাকে। ছেলেটা গা করে না। জলে ভেসে, অজানা কোনও দেশে যেতে পারছে, এতেই তার আনন্দ। 
ছেলেটা গা করছে না, তাতে মাঝি-মাল্লাদের আরও রাগ। শেষে করল কী, খাবার কম দিতে লাগল তাকে। নিজেরা চেটেপুটে ভর পেট খেয়ে নেয়। যেদিন যতটুকু বাঁচে, তাই জোটে ছেলেটার কপালে। 
দেখা গেল, তাতেও কিছু যায় আসে না ছেলেটার। ভালো করে খেতে পাচ্ছে না। কিন্তু অবাক ব্যাপার, রোগা তো হচ্ছে না একটুও। এবার মাঝিমাল্লাদের অবাক হওয়ার পালা। এটা হচ্ছে কী করে? 
এক খালাসি ভাবল, ব্যাপার একটা কিছু আছে নিশ্চয়। রহস্যটা খুঁজে বের করতে হবে। 
🍂
রাতের খাবার সারা। সবাই যুক্তি করে, সব খাবার খেয়ে ফেলেছে সেদিন। এক টুকরো রুটিও রাখেনি ছেলেটার জন্য। কী আর করে? নিজের ঘরে চলে গেছে ছেলেটা। ছোট একটা কেবিন বরাদ্দ হয়েছিল ছেলেটার জন্য। সেখানেই চলে গিয়েছে সে। পেটে খিদে। গিয়ে যন্ত্র বের করে, খাবার সাজিয়ে বসেছে।
খালাসি যে চুপিসাড়ে তার পিছু নিয়েছে, ছেলেটা তো জানে না। খালাসি দরজার ফুটো দিয়ে দেখে, ছেলেটা ছোট্ট একটা যন্ত্র বের করল নিজের পোঁটলা থেকে। বলল—বড্ড খিদে লেগেছে। খাবার ব্যবস্থা করো। অমনি প্লেট ভর্তি হতে লাগল খাবারে। নানা রকমের পদ। 
দেখে তো লোকটার চোখ কপালে। দৌড় লাগিয়েছে অন্যদের খবর দেওয়ার জন্য।
শুনল সকলে। কিন্তু কেউ কিচ্ছুটি বলল না। পরদিন তারা ছেলেটাকে ধরে পড়ল—তোমার ওই যন্ত্রটা আমাদের দিতে হবে। 
সে ছেলে রাজি হবে কেন? সে বলল—তাই কখনও হয় না কি? কেন দেব আমি? 
--আরে, ভায়া! ঐটুকু তো পেট তোমার। তার জন্য এমন একটা জিনিষ আটকে রাখবার কী দরকার তোমার? অনেক টাকা দেব তোমাকে আমরা। তিন পুরুষ ধরে খেয়েও, ফুরোতে পারবে না। পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে খাবে। দেবে না কেন? 
--শুধু একটা পেটের খাবার কী বলছ? আমি যা চাইব, তাই দেবে এ জিনিষ। নিজেদের চোখে দেখবে, ডাঙায় নামতে দাও। সাত মহলা বাড়ি বানাব। দাস-দাসি রাখব। জাহাজও বানাব কয়েকটা। বাণিজ্যে যাব সাগরে ভেসে ভেসে। 
লোকগুলোর তো চোখ ট্যারা! বলে কী এ ছেলে? এইটুকু জিনিষের এতো কেরামতি? নিতেই হবে জিনিষটা। যে করেই হোক। 
কিন্তু নেব বললেই তো আর নেওয়া যায় না। যার জিনিষ সে যদি না দেয়, নেবে কী করে? 
প্রথমে সাধাসাধি। পরে জোরাজুরি। কিন্তু ছেলেটা কিছুতেই রাজি হয় না—আমার ঠাকুরদারও ঠাকুরদার আমলের জিনিষ। এ আমি হাতছাড়া করব না। 
লোকগুলো একরোখা। বলল—ধুত্তেরি তোর ঠাকুরদার আমলের জিনিষ। দেব না বললেই হোল? দিতেই হবে তোকে। বলেই এক ঠ্যালা। ঝুপ করে একটা শব্দ। মাঝ সমুদ্রে ফেলে দিল ছেলেটাকে।
এবার এক দৌড়ে ছোট্ট কেবিন থেকে যন্ত্রটা বের করে আনা হোল। আনা তো হোল। এখন কী দিয়ে পরীক্ষা শুরু করা যায়? সেই খালাসি বলে উঠল—কেন? কাল রাতে বাবুর্চি বলেছিল না, লবণ ফুরিয়ে আসছে আমাদের। লবণ চাওয়া যাক।
সবাই সে কথায় রাজি। তাই হোল। খালাসি লোকটা বলল—এই যন্ত্র, লবণ চাই আমাদের। লবণের জোগাড় করো। 
সময় লাগল না। অমনি লবণ বেরিয়ে আসতে লাগল যন্ত্র থেকে। আসছে তো আসছেই। লবণ ডাঁই হতে থাকল জাহাজের পাটাতনে। আসবার আর বিরাম নাই।
হই হই করে উটল মাঝি-মাল্লার দল। আরে, আরে, এত লবণ নিয়ে আমরা কী করব?  সবাই চেঁচাচ্ছে—আর  নয়। আর চাই না। এবার বন্ধ করো। কিন্তু থামবার কোন লক্ষণই নাই। লবণের স্তুপ জমে জমে উঠছে দ্রুত। 
আসলে হয়েছে কী, যে খালাসি উঁকি মেরে দেখতে গিয়েছিল, সে কেবল খাবার চাইতে শুনেছিল। থামতে বলবার আগেই তো ছুট লাগিয়েছিল, সবাইকে খবরটা দেবে বলে। ঠিক কী বললে, যন্ত্রের কাজ বন্ধ হবে, শুনে আসেনি সে। সে কথা বলা হচ্ছে না। কাজ থামছে না যন্ত্রেরও। পাটাতন ভরে উঠেছে গাদা গাদা লবণে। এবার জাহাজটাই না ডুবে যায়?
ভয়াণক ঘাবড়ে গিয়েছে লোকগুলো। নাবিক দৌড়ে এসেছে তার কেবিন থেকে। এক টান মেরে যন্ত্রটাকেই সাগরে ছুঁড়ে ফেলে দিল তাড়াতাড়ি। তাতেই কোন রকমে জাহাজটা রক্ষা করা গিয়েছিল সেদিন।
কিন্তু যন্ত্রের কাজ বন্ধ করবার হুকুম তো করাই হয়নি। সাগরের একেবারে তলায় গিয়ে পড়েছে যন্ত্রটা। সেখানে থেকেই সে তার কাজ করে চলেছে আজও। সমানে লবণ ঝরিয়ে যাচ্ছে সে। 
সাত সমুদ্র এই দুনিয়ায়। সাতটা সাগর পার হও। দুনিয়ার যেখানেই যাও না কেন, সাগরের জল কিন্তু লোনাই।

Post a Comment

0 Comments