জ্বলদর্চি

চালতা /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ২৮
চালতা

ভাস্করব্রত পতি

'পাঁচ ভাই তাঁর আঁকাবাঁকা
এক ভাই তাঁর শিকননাখা'! 
এই ছড়াটি গ্রামেগঞ্জে জন্মানো অতি পরিচিত ফল চালতা সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে। আসলে চালতার ফলের যে অংশগুলো খাওয়া হয়, তা আসলে ফুলের বৃতি। এর মধ্যে ফল লুকিয়ে থাকে। সেটি বাঁকানো নলের মতো। ভিতরে চটচটে এবং হড়হড়ে আঁঠার মধ্যে বীজ থাকে। সেটিকেই বলা হয় 'শিকননাখা'! ঠিক এরকমই একটি ছড়া কিশোরগঞ্জের লোকেদের মুখেও শোনা যায় --
'একটা ঘরে সাতটা বাটী
যে না বলতে পারে তার কান কাটি'। 

আসলে চালতা ফল হল পাঁপড়িরই অবস্থান্তর পরিণতি। চালতার ফল দিয়ে সুস্বাদু চাটনি এবং আচার তৈরি হয়। গরিবগুর্বো মানুষদের কাছে চালতার টক পরম উপাদেয় খাদ্য। ইংরেজিতে চালতাকে বলে 'এলিফ্যান্ট অ্যাপেল'। আসলে এশিয়ার হাতিদের কাছে খুবই প্রিয় ফল এটি। এছাড়াও ইন্ডিয়ান ক্যাটমন, হোন্ডাপাড়া ট্রি, মা-তাদ নামেও পরিচিত। সংস্কৃতে অবর্তকি, হিন্দিতে চতুর ফল, করম্বেল, চলতা, পাঁচকুলে, রামফল, অসমীয়াতে ঔটেঙা, কন্নড়ে কালটেগা, মুচ্চিলু, গুড়িগনা, নেপালিতে পঞ্চফল, ঠুলো তাতারি, থুলো তাতারী, পাঁচকুলে, তেলুগুতে পেদ্দা কলিঙ্গ, রেওয়াদি চেট্টু, উপ্পু পোন্না, মালয়লাম ভাষায় পিন্নে, পুন্না, মারাঠীতে মোটা কারমেল,  করম্বেল, মিজোরামে কাওয়ারথিনডেঙ বলে চালতাকে। হাওড়া জেলার লোকজন এই চালতার বিচিত্র দেহগঠন সম্পর্কে ছড়া বানিয়ে বলে --
'ঠাকুরবাড়ির পাতিহাঁস 
খায় খোলা তার ফেলে শাঁস'। 
তেমনি খুলনা এলাকার মানুষজন চালতা ফলের গঠনশৈলী নিয়ে ছড়া করে শোনায় --
'রাজার বাড়ির পাতিহাঁস
খায় খোলা ফেলে শাঁস'। 
তেমনি যশোহর এলাকায় চালতা নিয়ে আরও একটি ছড়া লোকমুখে প্রচলিত আছে --
'রাজার মাইয়ে উড়োলি
কাট কাটে কুড়োলি
রাজার নাম শঙ্খদাস
খায় খুলা ফ্যালে শাঁস'
চালতা ফুল

চালতাকে প্রাচীন সাহিত্যে 'ভব্য' বলে বলা হয়। 'ভব্য' শব্দটির উল্লেখ মেলে যজুর্বেদের ১২। ১১৭ সূক্তে। এখানে 'ভব্য' শব্দটি জনিষ্যমান কামের প্রসঙ্গেই উল্লেখিত। এই 'ভব্য' নামটিই চরক সুশ্রুত বাগ্‌ভট ইত্যাদি গ্রন্থে কয়েকবারই উল্লেখ করা হয়েছে। ভব্য ফলের ভেষজ শক্তি এবং প্রয়োগফলও সংহিতাগ্রন্থে দেখানো হ'য়েছে।
চরকে বলা হ'য়েছে -
"মধুরাম্প কষায়ঞ্চ বিটম্ভি গুরুশীতলম্। 
পিত্ত শ্লেষ্ম হরং ভব্যং গ্রাহি বস্তু বিশোধনম্"॥ 
(চরক সূত্রস্থান - ২৭।১০৩)
আবার সুশ্রুতে বলা হ'য়েছে -
"হৃদ্যং স্বাদু কষায়াম্ল ভব্যং আস্য বিশোধনম্। 
পিত্ত শ্লেষ্ম হরং গ্রাহি গুরু বিষ্টম্ভি শীতলম্"॥
(সুশ্রুত সূত্রস্থান - ৪৬।১৫৭)

চালতার বিজ্ঞানসম্মত নাম Dillenia indica। এটি Dilleniaceae পরিবারের অন্তর্গত। ক্যারোলাস লিনিয়াস ১৭৫৯ সালে Systema Naturae তে প্রথম চালতার কথা উল্লেখ করেন। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভারত সহ ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, চিন, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশে জন্মায়। 
শৈশবের আনন্দ চালতা ফল নিয়ে

চালতা একটি চিরহরিৎ বৃক্ষ। উপরের অংশ গোলাকার। প্রায় ১৫ মিটার লম্বা হয়। গায়ে লালচে রঙের চকচকে বাকল থাকে। পাতার কিনারা খাঁজ কাটা এবং শিরাগুলি উঁচু ও সমান্তরাল। সিলেটের মানুষেরা পুরো চালতা গাছ নিয়ে সুন্দরভাবে বর্ণনা করে বলে --
"উচা গাছও বইছে টিয়া
সোনার মুকুট মাথাত দিয়া
কুন পুরে ফলাইছে গাছ
সার ফালাইয়া বাকল গাছ
চিরল চিরল পাতা
কাঞ্চা কাটা কাটা
খুব ভালা না অইলেও
ফল হয় নাটা
আঠে বাজারে ফল
মাঝে মাঝে বিকায়
অচল না অইলেও
কি বলিয়া চালায়"! 

চালতার সাদা রঙের সুগন্ধি ফুল দেখতে খুবই সুন্দর। ১৫ - ১৮ সেন্টিমিটার ব্যাস হয়। মোট পাঁচটি মোটা মোটা পাঁপড়ি দিয়ে ঘেরা মধ্যস্থলে প্রচুর হলুদ পুংকেশর থাকে। বৃতিগুলো দিয়ে সেইসব পাঁপড়িকে আঁকড়ে ঘিরে রাখা থাকে। সাধারণত মে জুন নাগাদ ফুল ফোটে চালতা গাছে। জীবনানন্দ দাশ এই চালতা ফুল নিয়ে কবিতায় লিখেছেন --
"সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি -
এই নদী নক্ষত্রের তলে
সেদিনো দেখিবে স্বপ্ন -
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
আমি চলে যাব বলে
চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে
নরম গন্ধের ঢেউয়ে?"
কবি বিষ্ণু দেও চালতা ফুল নিয়ে লিখেছিলেন --
"আকাশ নীলের তারাখচা পথে বৃষ্টি পড়ে
চালতা ফুলে ফলের বাগান মদির করে..."! 

ভিটামিন এ এবং সি প্রচুর রয়েছে এতে। অম্বলের রোগীদের পক্ষে চালতা মহৌষধ। । মচকে যাওয়া ব্যথায় চালতা গাছের পাতা ও মূলের ছাল  খুব উপকারী। ফোঁড়া পাকাতে পাকা চালতার রস কাজে দেয়। বমি, পায়খানা হলে চালতার মূলের রস খাওয়া যায়। যেসব মহিলার স্তনাল্পতা রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে চালতার রস কার্যকরী। চালতার রসে মাথার চুল বাড়ে। মূর্ছা রোগ নিরসনে এবং শুক্রাল্পতা নিরসনে চালতার কার্যকরী ক্ষমতা পরীক্ষিত। চালতা কখনো কখনো বিপ্লব আন্দোলনের হাতিয়ারও হয়ে উঠতে পারে। কবির কবিতায় পাই --
"সবজির বাজারেতে মুলাে মােচা সস্তায়
পাওয়া গেল বাসি মাল ঝকা ঝুড়ি বস্তায়।
ঝুড়ি থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মেরেছিল চালতা,
যশােরের কাগজেতে বেরিয়েছে কাল তা।
‘মহাকাল’ লিখেছিল, ভাষা তার শানানাে,
চালতা ছোড়ার কথা আগাগােড়া বানানো—
বড়ো বড়াে লাউ নাকি ছুঁড়েছে দু পক্ষে,
শচীবাবু দেখেছে সে আপনার চক্ষে"।

🍂

Post a Comment

1 Comments

  1. আপনার এই লেখাগুলি বই আকারে পেতে চাই।

    ReplyDelete