বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে
৪৩তম পর্ব
তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
দেবস্থান সমিতির কার্যালয়ে অনুসন্ধান করে পরে জানতে পেরেছিলাম যে এই ধ্বজা লাগানোর বুকিং প্রায় দু বছর আগে টাকা জমা দিয়ে করতে হয়। অর্থাৎ যে পুণ্যার্থী আজকে ধ্বজা লাগানোর টাকা জমা দেবেন তার ধ্বজা লাগানোর তারিখ আজ থেকে দু'বছর পরে সাধারনতঃ নির্ধারিত হবে। শ্রী দ্বারকাধীশ মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি দেখে রাত্রি আটটায় হোটেলে ফিরলাম।
পরের দিন সকালে আমরা স্নান করে পুনরায় মন্দিরে গেলাম শ্রীদ্বারকাধীশের পুজো দেওয়ার জন্য, কারণ গতকাল সন্ধ্যার সময় আমরা কেবলমাত্র আরতি দেখে চলে এসেছিলাম, পূজো দেওয়া হয়নি। আজ মন্দিরের মোক্ষদ্বার দিয়ে প্রবেশ করলাম। মোক্ষদ্বারের বেলেপাথরের দেওয়ালে কাঠের দু পাল্লার ভারী দরজা। প্রবেশ মুখে ডানদিকে মা আশাপূরণ দেবীর ছোট মন্দির। এখানে প্রণাম করে তীর্থযাত্রীরা শ্রী দ্বারকাধীশ মন্দিরে প্রবেশ করেন। সকলের বিশ্বাস মা আশাপূরণ বা আশাপুরা দেবী প্রত্যেকের মনের ইচ্ছে পূরণ করেন। মন্দির অঙ্গনে ঢুকে ডান হাতে প্রথমে সত্যনারায়ণ ও নবগ্রহ মন্দির। সত্যনারায়ণের প্রায় চার হাত উঁচু পাথরের বিগ্রহ, পাশেই কুশেশ্বর শিব মন্দির। এরপরে অম্বাজী মায়ের মন্দির, পাশে পুরুষোত্তম মন্দির। তারপরে দত্তাত্রেয় ভগবানের মন্দির। এই মন্দিরের এক পাশ দিয়ে সিঁড়ি উপরে উঠে গেছে। যে তীর্থযাত্রীরা মন্দির শিখরে ধজা তোলার মানত করেন তাদের এই সিঁড়ি দিয়ে খানিকটা উপরে যাবার অনুমতি দেওয়া হয়। মোক্ষদ্বারের বাম দিকে সর্বপ্রথমে কোলবা দেবতার চতুর্ভুজ মূর্তি। পাশেই আরেকটি ছোট মন্দির যেটি কাশী বিশ্বনাথের। শ্রী দ্বারকাধীশ মন্দিরে যাবার পথে চওড়া অঙ্গনের দুপাশে এরকম অনেক দেবদেবীর মন্দির আছে। অম্বাজী মায়ের মন্দিরের বিপরীত দিকে প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধের মন্দির। এই মন্দিরগুলি পেরিয়ে সামনে শ্রী দ্বারকাধীশ মন্দিরের মূল মণ্ডপ। দেবকী মন্দিরের সামনে দিয়ে শ্রী দ্বারকাধীশকে দর্শনের জন্য ভক্তরা হাতে হলুদ গাঁদাফুল ও তুলসীর মালা নিয়ে এগিয়ে যান। দেবকী মন্দিরের এক পাশে পিপুল গাছ যেখানে অনেকেই সুতো বেঁধে মানত করেন। শ্রী দ্বারকাধীশের বিগ্রহের বিপরীতে মাতা দেবকীর মন্দির। মন্দির দালানটি ৭২টি চওড়া স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল আকৃতির একটি পাথর কেটে এই স্তম্ভগুলিকে তৈরি করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। পাঁচতলা বিশিষ্ট লাডভাম মন্ডপ ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়েছে বলে প্রত্নতত্ত্ববিদদের অনুমান। শ্রীদ্বারকাধীশ মন্দিরের বিভিন্ন জায়গায় এমন অনেক শিল্পকলা চোখে পড়ে যাতে বিদেশী শিল্পকলার ছাপ সুস্পষ্ট। মানুষের মুখবিশিষ্ট শরীরটা কোন প্রাণীর, হাতির গায়ে পাখির ডানা ইত্যাদি। শ্রীবিষ্ণুর মৎস্য অবতার, নরসিংহ, বরাহ, পরশুরাম এরকম আরো অনেক অবতারের ভাস্কর্য মন্দিরের দেওয়ালে খোদাই করা আছে। জৈন ও বৌদ্ধ যুগের শিল্পকলাও রয়েছে। বেলেপাথর কেটে ভাস্কর্যগুলি তৈরী হয়েছে বলে মনে হয়। শ্রী দ্বারকাধীশ মন্দিরের গায়ে বিভিন্ন সভ্যতার পরিচয় অপূর্ব সব শিল্পকলার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে যা একে এক আন্তর্জাতিক মন্দিরের চেহারা দিয়েছে। একসময় মিশর, মেসোপটেমিয়া ও আরো কয়েকটি দেশ থেকে বাণিজ্যতরী দ্বারকা বন্দরে নিয়মিত আসা-যাওয়া করত। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দ্বারকা ক্রমশঃ পশ্চিম ভারতের অন্যতম প্রধান বন্দর হয়ে ওঠে। দ্বারকার সমুদ্রতট থেকে যে সব পাথরের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে সেগুলির গায়ে এক ধরনের চিহ্ন আছে। এই চিহ্নগুলি পরীক্ষা করে গবেষকেরা প্রাগৈতিহাসিক যুগের দ্বারকা সম্বন্ধে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে শ্রীকৃষ্ণের এখানে আসার আগেই চক্রতীর্থের অস্তিত্ব ছিল। তাছাড়া গোমতীর অন্য তীরে পঞ্চপান্ডব তীর্থে যে পাঁচটি মিষ্টি জলের কূপ আছে সেগুলিও প্রাচীন দ্বারকার প্রমাণ দেয়। হরপ্পা সভ্যতার কিছু কিছু নিদর্শন দ্বারকার আশেপাশে বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গেছে। খ্রীষ্টপূর্ব ২০০০ বছর আগেও যে দ্বারকাতে জনবসতি ছিল সে ব্যাপারে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ একমত পোষণ করেন।
🍂
আরও পড়ুন 👇
শ্রীদ্বারকাধীশের মন্দিরের ভেতরের চত্বর উত্তর দক্ষিণে ৭০ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৮৮ ফুট লম্বা। যেখানে দাঁড়িয়ে শ্রীদ্বারকাধীশকে ভক্তরা দর্শন করেন সেটি লোহার রেলিং দিয়ে দু ভাগে বিভক্ত। এক দিক দিয়ে পুরুষেরা এবং অন্য দিক দিয়ে মহিলারা সারিবদ্ধ ভাবে এগিয়ে যান। গর্ভগৃহের সামনে ভিড় কম থাকলে তীর্থযাত্রীরা বেশি সময় নিয়ে শ্রী ভগবানের বিগ্রহ দর্শন করতে পারেন। আর ভিড় বেশি হলে তখন এক ঝলক দর্শন করে বেরিয়ে যেতে হয়। গর্ভগৃহের সামনে লোহার রেলিং দিয়ে আটকানো এবং এই লোহার রেলিংয়ের পাশ দিয়ে বাইরে বেরোনোর রাস্তা। শ্রী দ্বারকাধীশ মন্দিরের গর্ভগৃহে কেবলমাত্র মন্দিরের পূজারী ও ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছাড়া অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই। তবে কোন বিশেষ প্রয়োজনে দেবস্থান সমিতির কোন দায়িত্বশীল কর্মী অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে পারেন। শ্বেতপাথরের বেদীর উপরে রূপোর সিংহাসনে শ্রী দ্বারকাধীশের কষ্টিপাথরের তিনফুট উচ্চতাবিশিষ্ট দণ্ডায়মান চতুর্ভূজ বিগ্রহ। দ্বারকায় তিনি রণছোড়জী। তাঁর মস্তকে হিরে জহরতের বহুমূল্য মুকুট এবং তার উপরে স্বর্ণছত্র। সর্বাঙ্গ বিভিন্ন অলংকার দিয়ে সুশোভিত। উপরের বামহস্তে সুদর্শন চক্র এবং নীচের বামহস্তে পাঞ্চজন্য মহাশঙ্খ যেটি দানব পঞ্চজনকে বধ করে লাভ করেছিলেন। উপরের ডানহস্তে কৌমুদকী গদা এবং নীচের ডানহস্তে পদ্মফুল। শ্রী ভগবানের বুকে ভৃগু পদচিহ্ন যা ‘শ্রীবৎস’ চিহ্ন রূপে পরিচিত। বাম স্কন্ধে যজ্ঞোপবীত, কোমরে নাগপাশ পরনে মল্লকচ্ছ এবং কন্ঠে বহুমূল্য বৈজয়ন্তীমালা যা কণ্ঠদেশ থেকে হাঁটু পর্যন্ত লম্বভাবে বিরাজিত। বৃন্দাবনে থাকাকালীন কালীয়দহে কালীয়নাগকে দমন করার সময় সেই মহাসর্প শ্রীকৃষ্ণের কোমর জড়িয়ে ধরেছিল। সেই কালীয়নাগ দমনের চিহ্নস্বরূপ ভগবান তাকে নিজ অঙ্গে ধারণ করেছিলেন। কংসের রাজসভায় চানুর ও মুষ্টিকের বিরুদ্ধে মল্লযুদ্ধের সময় শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গে যে বস্ত্রটি পরিধেয় ছিল সেই মল্লকচ্ছ তিনি ধারণ করে আছেন। আর স্বয়ম্বর সভায় যেখানে সমস্ত দেবতা ও অসুরেরা সমাগত, সেখানে স্বয়ং মালক্ষী নারায়ণের গলায় যে বরমাল্য দিয়েছিলেন সেটিই বৈজয়ন্তী মালা। শ্রীদ্বারকাধীশের চরণ প্রান্তে বসে রয়েছেন নন্দ রাজা প্রার্থনার ভঙ্গিতে। ব্যজন হস্তে লক্ষ্মী দেবী ও সরস্বতী দেবী শ্রীকৃষ্ণের সেবা করছেন।
প্রতিদিন শ্রী দ্বারকাধীশের পরিধেয় বস্ত্রের রং বিভিন্ন রঙের হয়। সোমবারে গোলাপী, মঙ্গলবারে হলুদ, বুধবারে সবুজ, বৃহস্পতিবারে কমলা, শুক্রবারে সাদা, শনিবারে নীল এবং রবিবারে লাল বস্ত্র পরিধান করেন তিনি। শ্রী দ্বারকাধীশের মন্দিরে এসে আদি শঙ্করাচার্য পুজো করেছিলেন এবং তার অনুসৃত পূজা পদ্ধতি এখানে পালন করা হয়। সেই সময় থেকেই 'গুগ্গুলী' সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ পরিবারের হাতে শ্রীদ্বারকাধীশের সেবা-পূজার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল যারা বেদজ্ঞ পন্ডিত বলে সুপরিচিত ছিলেন। তাদের পরিবারের বংশধরেরাই পরম্পরাক্রমে এখানে সেবা-পূজার অধিকারী।
0 Comments