জ্বলদর্চি

জানকীরঞ্জন রাজপণ্ডিত (শিক্ষক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, কোলাঘাট)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১১৫
জানকীরঞ্জন রাজপণ্ডিত (শিক্ষক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, কোলাঘাট) 

ভাস্করব্রত পতি

দাসপুরের বরুণা উদয়চক গ্রামের এক অধ্যাপক পণ্ডিত বংশে জন্মগ্রহণ করেন ১৩১৭ বঙ্গাব্দের ১৬ ই ভাদ্র (১৯১০)। বাবা যোগেন্দ্রনাথ এবং মা নগেন্দ্রনন্দিনীর তিন সন্তান -- রেবতীরঞ্জন, জানকীরঞ্জন এবং কিশোরীরঞ্জন। আমাদের আলোচিত 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' জানকীরঞ্জন রাজপণ্ডিত ছিলেন ভিন্নধর্মী। দেশের জন্য কারাবরণ করেন। পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ফের পড়াশোনা শুরু করেন। বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। সেইসাথে সাংবাদিকতা এবং সাহিত্য চর্চার সাথেও যুক্ত করেন নিজেকে। জীবনের ৩২ টি বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র ইংরেজ বিরোধিতা এবং জনহিতকর কাজের মাধ্যমে। 

সোনাখালি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই বাবা যোগেন্দ্রনাথ রাজপণ্ডিত অনুপ্রাণিত করেন স্বাধীনতা আন্দোলনকে ভালোবাসতে, আত্মীকরণ করতে। জড়িয়ে পড়েন দেশের কাজে। এরপর দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন (১৯৩০) দাসপুর থানার শ্যামগঞ্জে লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৩০ এর ৩ রা জুন দাসপুরের চেঁচুয়াহাটে বিপ্লবী জনতার হাতে মারা পড়েন তৎকালীন কুখ্যাত বড় দারোগা ভোলানাথ ঘোষ এবং ছোট দারোগা অনিরুদ্ধ সামন্ত। এরপর ব্রিটিশ পুলিশের অমানবিক দমন পীড়ন এবং গুলিবর্ষণের দরুন ৬ ই জুন মৃত্যু হয় এলাকার ১৪ জন সাধারণ মানুষের। এরপর ব্রিটিশ সরকার মামলা শুরু করে। সেই মামলায় জড়িয়ে যায় কিশোর জানকীরঞ্জন রাজপণ্ডিতের নাম। 

এর পরের বছর ১৯৩১ এর ২৬ শে জানুয়ারি পূর্ণ স্বরাজের দাবিতে জাতীয় পতাকা তোলার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় কংগ্রেস। সেসময় সোনাখালি হাটে 'বন্দেমাতরম' ধ্বনি সহযোগে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অভিযোগে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন জানকীরঞ্জন এবং অন্য এক কংগ্রেস কর্মী রাধানাথ সামন্ত। বিচারে ৬ মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে। কিন্তু গান্ধী আরউইন চুক্তির বদান্যতায় ঐ বছরের ১১ মার্চ তিনি মুক্তি পান। সেসময় বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীর সংস্পর্শে আসেন। এইসময় প্রত্যক্ষভাবে সম্মুখসমরে নেমে পড়ায় পড়াশোনায় কিছুটা বাধা পড়ে। ফলে কয়েক বছর পড়াশুনা স্থগিত রাখতে হয় তাঁকে। 
জানকীরঞ্জন রাজপণ্ডিত এবং তারা রাজপণ্ডিত

কিন্তু তিনি চাইতেন পড়াশুনা করতে। যদিও ভীষণ রকম পুলিশী তৎপরতায় তাঁর সেসময় পড়াশোনা করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে তিনি ফিরে এলেন পড়াশোনার জগতে। হাওড়ার শিবপুর দীনবন্ধু ইন্সটিটিউশন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করলেন। কয়েকটি বিভাগে লেটার সহ প্রথম বিভাগে পাশ করেন। এরপর নরসিংহ দত্ত কলেজে প্রথম বিভাগে আই এ পাশ করার পর ১৯৩৯ এ কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এ. অনার্স এবং পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে প্রাইভেটে এম.এ. পাশ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। 

১৯৪০ এর ১৫ ই জুলাই গোলগ্রাম বিশ্বেশ্বর হালওয়াশিয়া ফ্রি হাইস্কুলে শুরু করলেন শিক্ষকতা। স্বাধীনতার সেনানী হয়ে উঠলেন শিক্ষাদানের সেনানী। এখানে ১৯৪৫ এর মার্চ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৪৬ এর মার্চ পর্যন্ত করেন সোনাখালি হাইস্কুলে। ফের পরিবর্তন। ১৯৪৬ এর ২ রা এপ্রিল থেকে ঐ বছরের ১৯ শে জুন পর্যন্ত কোন্নগর হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু ব্রিটিশ শাসিত শিক্ষাবিভাগের নির্দেশে এই স্কুল ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হন। প্রায় ৯ মাস বাড়িতে বসে থাকতে হয় চাকরিহীন অবস্থায়। 

আবারও চাকরি পেলেন ১৯৪৭ এর মার্চ মাসে। সাগরপুর স্যার আশুতোষ হাইস্কুলে যোগদান করলেন। তবে এখানেও তাঁর শিক্ষকতার মেয়াদ ছিল ১৯৪৯ এর জানুয়ারি পর্যন্ত। খুকুড়দহ আই সি এম এম হাইস্কুলে সহ প্রধানশিক্ষক হিসাবে যুক্ত হন ১৯৪৯ এর জানুয়ারি থেকে ১৯৫০ এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ফের দু'বার সাগরপুর স্যার আশুতোষ হাইস্কুলে, একবার চাঁইপাট হাইস্কুলে এবং সবশেষে ১৩ ই মে ১৯৫২ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত কোলা ইউনিয়ন হাইস্কুলে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। এখানে তিনি পড়াতেন বাংলা এবং সমাজ বিজ্ঞান। 
ড. শ্যামল বেরা সম্পাদিত 'জানকীরঞ্জন রাজপণ্ডিত : ইংরেজ তাড়ানো এক মাস্টারমশাই' বই

ড. শ্যামল বেরা এই মহান মানুষটিকে নিয়ে সম্পাদনা করেছেন "জানকীরঞ্জন রাজপণ্ডিত : ইংরেজ তাড়ানো এক মাস্টারমশাই" বই। জীবনের বিভিন্ন সময়ে সংস্পর্শে এসেছেন মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, হেমেন রায়, সুধীর বেরা, হীরেন মুখার্জী, সুশীল কুমার ধাড়া, অজয় মুখোপাধ্যায়, গীতা মুখোপাধ্যায়, শম্ভু মুখোপাধ্যায় শ্যামাপ্রসাদ ভট্টাচার্য, রজনী দোলুই, সুবল বেরা, শ্রীদাম বেরাদের সঙ্গে। চেঁচুয়াহাট ঘটনার সাথে যুক্ত অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী মৃগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যর সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক ছিল জানকীরঞ্জনের। এ প্রসঙ্গে প্রয়াত তাপসকান্তি রাজপণ্ডিত লিখেছেন স্মৃতিকথায়, "বাবার কৈশোর জীবনে সংগ্রামের সহযোদ্ধা ছিলেন মৃগেন ভট্টাচার্য, যিনি জেল থেকে বেরিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং পরবর্তী সময়ে সি.পি.আই (এম) এর জেলাব্যাপী সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিধায়ক থাকাকালীন কলকাতা যাওয়ার পথে আমাদের পুলশিটার বাড়িতে রাত্রিবাস করতেন, পুরোনো বন্ধুর সাথে গল্পগুজবে মেতে উঠতেন। সোনাখালি হতে সাইকেলে এসে, এখানে সাইকেল রেখে কোলাঘাট স্টেশন হতে ট্রেনে কলকাতা যেতেন। ফেরার পথে আবার আমাদের বাড়িতে রাত্রিবাস। তাঁর সাইকেলে বাঁধা চামড়ার পোর্টফোলিও ব্যাগে থাকত ধুতি, শার্ট, গামছা, তেলের শিশি। দুই বিপরীত রাজনীতির মানুষ হয়েও এই সখ্য আমাদের মুগ্ধ করত"। 

শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। বসুমতী, প্রবাসী, ভারতবর্ষ, প্রদীপ সহ বিভিন্ন বিখ্যাত পত্রিকায় লিখেছেন। শুধু তিনি নন, তাঁর পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের অনেকেই লব্ধ প্রতিষ্ঠিত হয়েও সাহিত্যচর্চায় যুক্ত রয়েছেন। জানকীরঞ্জন এবং তারাদেবীর চার সন্তান তপনকান্তি, তপতী, তাপসকান্তি এবং মালবিকা। প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে বিরাজমান। কন্যা মালবিকা রাজপণ্ডিতের কথায়, "ধর্মীয় গোঁড়ামি একেবারেই ছিল না। সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিলেন। কুসংস্কারমুক্ত, দৃঢ়চেতা উদার মনের রসিক মানুষ ছিলেন। কখনও শুনিনি কারও দুর্নাম করতে। নারীজাতির সচেতনতার জন্য নানান বিষয় তাঁর বক্তব্যে উঠে আসত"। মহাত্মা গান্ধীকে সামনে থেকে পেয়েছেন। একটা সময় মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। এহেন মানুষটির জীবনাবসান ঘটে ১৯৮৬ এর ২২ শে অগ্রহায়ণ।

🍂

Post a Comment

0 Comments