দূরদেশের লোকগল্প—আলবেনিয়া (দ.-পূ. ইউরোপ)
জুতোজোড়া রানির পায়ের
চিন্ময় দাশ
এক ছিল রাজা। তার ছিল এক রানি আর একটি মেয়ে।
একদিন হঠাৎ রানি পড়ল অসুখে। কিছুতেই সারে না। কতো বদ্যি-পথ্যি করা হোল। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। রানি আর সারে না। রানিও বুঝতে পেরেছে, সময় শেষ হয়ে এসেছে তার।
রানি রাজাকে ডেকে বলল—মুচিবুড়োকে খবর দাও। আমি একজোড়া জুতো বানাবো।
মুচি বুড়ো এসে জুতো বানিয়ে দিল, রানির পায়ের মাপ নিয়ে। এবার রানি রাজাকে বলল—আমি মারা যাওয়ার পর, জুতো জোড়া নিয়ে একদল সেপাই পাঠিয়ে দেবে। গোটা রাজ্য ঘুরে, মিলিয়ে মিলিয়ে দেখবে সে। যে মেয়ের পায়ের মাপ মিলে যাবে, সে মেয়েকেই বিয়ে করে আনবে তুমি।
--আচ্ছা, সে দেখা যাবে।
রানি ধরে পড়ল--দেখা যাবে নয়। তুমি কথা দাও আমাকে।
রাজা আর কী করে? বলল—ঠিক আছে। কথা দিলাম।
ক’দিন না যেতে রানি মারা গেল। যেমনটি কথা ছিল, সেপাই বেরোল জুতোজোড়া নিয়ে। কিন্তু ঐ বেরোনই সার। কারও পায়েই মেলে না। কারও পায়ে জুতো বড় হয়ে যায়, তো কারও পায়ে ছোট।
সেপাই ফিরে এলো ঘুরে ঘুরে হয়রাণ হয়ে। রাজার মন খারাপ। রানিকে কথা দিয়েও, রাখা হচ্ছে না।
রাজার মেয়ের ভারি কৌতুহল হোল। এত বড় একটা রাজ্য। ঘরে ঘরে কতো না মেয়ে। তাদের কারও পায়ে মাপমতো হোল না জুতোজোড়া!
সে মেয়ে একদিন এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসেছে। ভাবল, নিজে একবার পরখ করে দেখি তো! কী এমন বেঢপ মাপ? জুতোয় পা গলাতেই, আর কী আশ্চর্য! এক্কেবারে ঠিকঠাক মিলে গেছে জুতোজোড়া!
রাজা তো এ কথা জানে না। কী করা যায় ব্যাপারটা নিয়ে, মেয়ের সাথে পরামর্শ করবে—এই ভেবে মেয়েকে ডেকে পাঠিয়েছে। বাবা ডাক পাঠিয়েছে। মেয়েও চলে এল সাথে সাথে। পায়ের জুতোজোড়া পায়েই থেকে গেছে। বাবার কাছে এসে হাজির মেয়ে। নিজের মেয়েকে কি আর রাজা বিয়ে করতে যাবে? নিশ্চিন্ত মনে বাবার কাছে চলে এসেছে মেয়েটি।
ব্যাপার দেখে রাজা তো অবাক। মেয়েকে বলল—এখন তো কিছু করবার নাই আর। রানিকে কথা দিয়েছি। তোমাকেই আমি বিয়ে করব।
মেয়েটি বলল—তুমি যা বলবে তাই হবে। তবে বাবা, বিয়ে নিয়ে আমার অনেক দিনের একটা সাধ আছে মনে।
রাজা বলল—বলো, কী সাধ? নিশ্চয় পূরণ করা হবে।
--আমার বিয়ে বাড়িতে, দু’দিকে বড় মাপের দুটো লন্ঠন জ্বলবে। তবে, আমার পছন্ত মত বানাতে হবে সে দুটো।
রাজা বলল—সে আর এমন কী কথা। এখনই মিস্ত্রীকে ডেকে পাঠাচ্ছি।
মিস্ত্রী এলো। বড়সড় মাপের দুটো লন্ঠনও বানানো হোল। খোলা বন্ধ করা যায়, তেমন জুতসই একটা করে দরজাও আছে সেগুলোতে।
বিয়ে বাড়ির দিন গোটা রাজবাড়িতে হুলুস্থুল কাণ্ড। বিয়ের সব আয়োজন তৈরি। কিন্তু মেয়ের দেখা নাই। সে কী সর্বনেশে কাণ্ড! সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা হোল। পাত্তাই পাওয়া গেল না মেয়ের।
কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছে না রাজা। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দু’-দুটো লন্ঠন বানালো তাহলে কী জন্য? বিরক্ত হয়ে একজন সেপাইকে ডেকে আনল রাজা। বলল—এই অপয়া লন্ঠন দুটোকে দূর কর আমার সামনে থেকে।কেউ নিতে চাইলে, বিক্রি করে দে।
সেপাই বলল—কী দাম বলব, হুজুর?
--সে তোর যা মন চায়, তাই বলবি। যা দাম পাবি, সে তোর নিজের।
সেপাই তো নেচে উঠল। দু-দুটো এতো বড় লন্ঠন। তাও আবার রাজ্যের সেরা মিস্ত্রীর হাতে বানানো। ভালো দামই পাওয়া যাবে।
ঘোড়ার গাড়িতে লন্ঠন চাপিয়ে ঘুরে বেড়ায় সেপাই। ভীড় করে দেখে লোকে। এতো বড় লন্ঠন সাত পুরুষে কেউ দেখেনি অখনও। পছন্দও হয় অনেকের। কিন্তু রাজার জিনিষ কিনবে, সাহস হয় না কারও। সাধ্যেও কুলোবে না হয়তো।
ঘুরতে ঘুরতে পাশের রাজ্যে গিয়ে হাজির হয়েছে সেপাই। সে দেশের রাজকুমারের পছন্দ হোল লন্ঠন দুটো। বলল—দাম কতো হে লন্ঠনের।
সেপাই নিজেই কি জানে, কত দাম হতে পারে? হাত কচলে বলল—আমি কী করে আপনাকে বলি, হুজুর। আপনার পছন্দ হয়েছে, এই কত ভাগ্যের কথা। আপনি যা মন চায়, দিন।
দুটো সোনার মোহর ধরিয়ে দিল রাজকুমার। আনন্দে ডগমগ হয়ে, লাফাতে লাফাতে সেপাই ফিরে চলল।
হয়েছে কী, কদিন বাদেই রাজকুমারের বিয়ে। এক রাজার মেয়ের সাথে কথা পাকা হয়ে আছে। মন মেজাজ বেশ ফুরফুরে। রাত নামলেই ঘুমিয়ে পড়ে। বাউর্চি-খানসামারা এসে খাবার সাজিয়ে রেখে যায়। মাঝ রাতের দিকে উঠে, খেতে বসে রাজকুমার।
সেদিনও খাবার সাজানো আছে টেবিলে। সেই ঘরেই সাজিয়ে রাখা হয়েছে লন্ঠন দুটো। আসলে হয়েছে কী, রাজকুমারি নিজে ঢুকে ছিল একটা লন্ঠনের ভিতর। নিজের বাবাকে কেউ আবার বিয়ে করে না কি? মাথা খাটিয়ে, লন্ঠন বানিয়ে এভাবে পালিয়ে এসেছে সে।
সামনে খাবার সাজানো। রাজকুমার ঘুমিয়ে কাদা। এদিকে মেয়েটিরও খিদে পেয়েছে। সারা দিন পেটে কিছু পড়েনি। লন্ঠন থেকে বেরিয়ে এলো মেয়েটি। সব খাবার থেকে একটু একটু করে খেয়ে, আবার সেঁধিয়ে গেল লন্ঠনের ভেতরে।
মাঝরাতে বিছানা ছেড়ে উঠল রাজকুমার। যেমনটা সে নিত্যদিন ওঠে। কিন্তু খেতে বসে থমকে গেল। খাবারগুলো কেমন যেন এলোমেলো।
হাঁকডাক শুনে সবাই দৌড়ে এসেছে। কিন্তু কেউ কোন কারণ বুঝে উঠতে পারছে না। সবাই হতবাক। পরের দিনও একই কাণ্ড।
তৃতীয় দিন। রাজকুমার ভাবল, যা করবার আমাকেই করতে হবে। ঘুমের ভান করে বিছানায় শুয়ে রইল সে। খাবার দিয়ে যেতেই, মেয়েটি বেরিয়ে এসেছে গুটিগুটি পায়ে। গপগপ করে খেয়ে হাত মুছছে, রাজকুমার উঠে পড়ল—তাহলে, তুমিই আমার খাবার খেয়ে যাচ্ছো।
কী উত্তর দেবে? ধরা পড়ে গিয়ে, জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। রাজকুমার বলল—ব্যাপারটা কী? তোমার এই দশা কেন? কে তুমি? এলে কোথা থেকে? সব খুলে বলো আমাকে।
এক এক করে সব কথা বলে গেল মেয়েটি। রাজকুমার বলল—ওহ, এই ব্যাপার। শোন মেয়ে, যদিও আমার বিয়ের কথাবার্তা হয়ে গেছে, কিন্তু তোমাকে ভারি পছন্দ হয়েছে আমার। তোমাকেই বিয়ে করব আমি।
এ কথা শুনে মেয়ে তো ভারি খুশি। মস্ত একটা ফাঁড়ার হাত থেকে বাঁচা গেছে। সে আনন্দে মাথা নেড়ে দিয়েছে।
কোন ধুমধাম নয়। একেবারে সাদামাটা করে বিয়েটা সেরে নেওয়া হোল। কেন না, ঘুম থেকে উঠেই রাজা খবর পেয়েছে, যুদ্ধে যেতে হবে তাকে। বিয়ে নিয়ে হৈ-হুল্লোড় করবার সময় নাই হাতে। যুদ্ধে যাওয়ার সময়, রাজা তার বউকে বলে গেল—চাকর-বাকররা আছে। চিন্তা কোর না। সময় মতো খাবার-দাবার সব পেয়ে যাবে। একটা কথা-- এই লন্ঠনের বাইরে বেরোবে না তুমি। যেদিনই ফিরে আসি, এইখানেই দেখতে পাই যেন তোমাকে। কিছুতেই বাইরে থাকবে না।
রাজা যুদ্ধে চলে গিয়েছে। এদিকে হয়েছে কী, তার হবু শ্বশুর খবর পেয়ে গেছে, রাজা একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছে। রাগে গরগর করতে করতে, বুড়ো রাজা এসে হাজির হয়ে গেছে রাজবাড়িতে। দুমদাম করে সোজা ভিতর মহলে ঢুকে পড়েছে সে। দেখতেও পেয়ে গেছে মেয়েটিকে।
--ওহ, তাহলে তুই সেই শয়তানি। দেখাচ্ছি বিয়ে করবার মজা। বলেই একটা চাকরকে হুকুম করল—একে নিয়ে গিয়ে একটা বিছুটির জঙ্গলে ছুঁড়ে দিয়ে আয়। ওখানেই জ্বলে পুড়ে পুড়ে মরুক।
জঙ্গলে পড়ে আছে, এক বুড়ির চোখে পড়ে গেল মেয়েটি। বুড়ি আঁতকে উঠল—কেরে মা তুই? এখানে পড়ে কেন? মেয়েটি এক এক করে তার দুর্ভাগ্যের কথা খুলে বলল বুড়িকে। অনুনয় করে বলল—তুমি আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো, দয়া করে। তোমার ঘর-গেরস্তালির সব কাজ করে দেব আমি।
বুড়ির বলে নিজেরই পেট চলে না। তবু এ অবস্থায় কাউকে কি আর ফেলে যাওয়া যায়? মেয়েটিকে বাড়ি নিয়ে চলল সে।
কদিন বাদে যুদ্ধ জিতে বাড়ি ফিরে এল রাজা। কিন্তু মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল ঘটনা শুনে। মনে মনে খুব ভালোও বেসেছিল মেয়েটিকে। এমন বেঘোরে মরতে হয়েছে মেয়েটাকে, এটা ভেবেই অসুস্থ হয়ে পড়ল সে।
এমনই অবস্থা বিছানা ছেড়ে নামেই না। একদিন হুকুম করল—সারা রাজ্যে ঢেঁড়া পিটিয়ে দাও। পেস্ট্রি খেতে সাধ হয়েছে আমার। মরবার আগে একটা পেস্ট্রি খেয়ে, তবে যাবো। ঘোষণা করে দাও—যার হাতের পেস্ট্রি পছন্দ হবে, মুঠো ভর্তি মোহর দেব তাকে।
বুড়িও শুনেছে রাজার ঘোষণা। সে মেয়েটিকে বলল—তুমি তো রাজার মেয়ে, বাছা। পেস্ট্রি বানাতে পারবে নিশ্চয়। ভালো মতন পেস্ট্রি বানাও তো। রাজার পছন্দ হলে, কপাল ফিরে যাবে আমাদের।
ভারি যত্ন করে পেস্ট্রি বানালো মেয়ে। সেই সাথে আরও একটা কাজ করে রাখল। বিয়ের সময় আংটি পরিয়ে দিয়েছিল রাজা। সেই আংটি পেস্ট্রির ভিতরে ভরে দিল মেয়েটি।
সেদিন দরবারে বেজায় ভীড়। অনেকেই এসেছে পেস্ট্রি বানিয়ে নিয়ে। একটার পর একটা পরখ করে দেখছে রাজা। বুড়ির পেস্ট্রি মুখে তুলতে হোল না। ভাঙতেই চোখে আলো জ্বলে উঠল তার। এ আংটি তো আমিই পরিয়ে দিয়েছিলাম মেয়েটিকে! মুখ ফুটে কিছু ভাঙল না রাজা। বুড়িকে বলল-- তুমি বাড়ি যাও আজ। কাল আমি নিজেই যাব তোমার বাড়ি।
পরদিন জুড়িগাড়ি হাঁকিয়ে রাজা গিয়ে হাজির হোল বুড়ির কুঁড়েঘরে। গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছে সেখানে। দেশের রাজা নিজে এসেছে এক অভাবী মানুষের কুঁড়েঘরে! লোকে তো ভীড় করে আসবেই।
বসেছে রাজা। কিন্তু তার চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিকে একবার, ওদিকে একবার। কোথাও দেখা যাচ্ছে না সে মেয়েকে। এক সময় একটা বড়সড় গম পেষার কল চোখে পড়ল রাজার, দেওয়ালের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা।
রাজা বলল—ওটা কী তোমার?
বুড়ি বলল—গম ভাঙাই ওতে। অভাবের ঘর। গাঁয়ের লোকের গম ভেঙে দিই। দুটো পয়সা আসে হাতে।
--বাহ, দারুণ তো জিনিষটা। দেখি তো ভালো করে। বলে, রাজা নিজে হাত লাগিয়ে, এক পাক ঘুরিয়েছে কলটাকে। মেয়েটি ছিল কলের আড়ালে। রাজা দেখে ফেলল।
দু’জনে চেয়ে আছে দুজনের দিকে। জল গড়াচ্ছে মেয়ের দু’চোখ বেয়ে। রাজার চোখেও চিকচিকে ভাব। তবে সেটা বউ ফিরে পাওয়ার আনন্দে।
খটখট আওয়াজ উঠল আবার। রাজার জুড়িগাড়ি ফিরে চলল রাজবাড়ির দিকে। মেয়েটি বসেছে পাশে। বুড়িকেও তুলে নেওয়া হয়েছে গাড়িতে।
রাজবাড়িতে ফিরে, ঝটপট চিঠি লিখতে বসল রাজা—যে রাজা এমন অমানুষের মতো কাজ করে, তার মেয়ে এবাড়িতে বউ হয়ে আসবে না কোন দিন।
ঘোড়া হাঁকিয়ে সেপাইরা ছুটল চিঠি নিয়ে। চিঠিটা সেয বুড়ো রাজার হাতে পৌঁছে দিতে হবে তাদের।
মেয়েটি অধৈর্য—রাখো তো তোমার চিঠি লেখা। এই বুড়িমানুষটাকে পুরষ্কার দাও আগে। এর জন্যই আজও বেঁচে আছি আমি। এর জন্যই আবার ফিরে পেয়েছি তোমাকে।
রাজার মুখে মিষ্টি হাসি। বলল-- কোনও পুরষ্কারই দেব না একে। এখানে এই রাজবাড়িতে রেখে দেব একে। তোমার মহলেই একটা ঘর দেওয়া হবে বুড়িমাকে।
ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন হোল। সারা রাজ্যের প্রজারা ভোজ খেল সেই আনন্দের মেলায়।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments