জ্বলদর্চি

ইস্কুল ফিস্কুল /পর্ব -৪ / সৌমেন রায়

ইস্কুল  ফিস্কুল                                                               পর্ব -৪
                                                                        সৌমেন  রায়
                                                                                চিত্র – অসিত কুমার সেনাপতি
                                                      
খাঁচাটি সোনার হইল
                    
এখন আর  অতীতের  মত ভাঙ্গা জানালা গলে জায়গা রাখার ‘সুবিধা ‘ নেই। এখন প্রায় সব স্কুলেরই পরিকাঠামো যথেষ্ট ভালো। শ্রেণীকক্ষের  অভাব প্রায় নেই, ভাঙ্গা জানলা তো  একেবারেই নেই। প্রায় সব স্কুলে শৌচাগার, পানীয় জল, মাথার ওপর ফ্যান সব আছে। কোনও কোনও স্কুল তো দেখে বোঝা যায় না সরকারি স্কুল বলে। ঝকঝকে রঙিন বিল্ডিং, দেওয়ালে শিক্ষনীয়  সুখদৃশ্য, দেওয়াল হয়ে উঠেছে টি এল এম। কত কি রঙিন আঁকি বুঁকি। কোথাও লেখা আছে মহাপুরুষের বাণী তো কোথাও পৌষ্টিকতন্ত্রের ছবি। কোথাও দেশকে চেনার জন্য ম্যাপ  তো কোথাও preposition এর ব্যবহার। প্রায় প্রতিটি স্কুলে কোনও  না কোনও  মহাপুরুষের মূর্তি আছে। কেউবা করেছে ভেষজ উদ্যান, কেউ  সব্জি, কেউ ফুলের বাগান। অধিকাংশ বিদ্যালয়  প্রাচীর ঘেরা, সুদৃশ্য গেটও আছে। আগে এইসব ছিল অভিজাত বিদ্যালয়গুলির অভিজ্ঞান, এখন  তা  প্রায় সব বিদ্যালয়ে   আছে। কোথাও সুসজ্জিত অডিটোরিয়াম , কোথাও মাল্টিজিম ।  কোথাও বা সুদৃশ্য পাথ ওয়ে। কোথাও জল সংরক্ষণ প্রকল্প, তো কোথাও সোলার লাইট। কোথাও বা দুটিই । মিড ডে মিল খাওয়ার পরিচ্ছন্ন স্থান, জীবাণুমুক্ত জলের একোয়াগার্ড সব আছে। আছে কম্পিউটারযুক্ত স্মার্ট ক্লাসরুম , সমৃদ্ধ লাইব্রেরী। কোন কোন মাধ্যমিক স্কুলে ল্যাবরেটরি পর্যন্ত  আছে । একটি স্কুল তো আবার দেখলাম ‘আই লাভ  মাই ওয়ার্ড’ এর মত ‘আই লাভ  মাই স্কুল’ লেখা বিরাট গ্লো সাইন বোর্ড লাগিয়েছে। ফেসবুকে প্রশংসার বন্যা।  নিশ্চিত যে পরের বছর আরো কয়েকটি স্কুলে তা গড়ে উঠবে। কিছু কিছু বিদ্যালয়ের সুসজ্জিত অডিটোরিয়াম একদম অত্যাধুনিক। সেখানে স্টেজ , পোডিয়াম, বসার জায়গা, সাউন্ড সিস্টেম সমস্ত কিছুই আছে। যা এক দশক আগেও ভাবতে অবাক লাগত। কিছু কিছু আদিবাসী বিদ্যালয় এবং সরকারি বিদ্যালয় অবশ্য অধিক সুবিধা প্রাপ্ত । এদের ঝকঝকে হেডমাস্টার রুম, স্টাফ রুম, ক্লাস রুম , এমনকি এদের বেঞ্চগুলো দেখলেও বোঝা যায় এরা অন্য স্কুলগুলি থেকে ভিন্ন। এদের শ্রেণীকক্ষেও প্রজেক্টর সহ স্মার্ট বোর্ডের ব্যবস্থা আছে। যাই হোক উন্নয়ন অগ্রগতির লক্ষণ। তাই বইয়ের উপর এখন আর নিম ফুল ঝরে পড়ে না বা ভাঙ্গা প্রাচীর গলে হিসি করার সুখ আর নেই, এসব ভাবা অর্থহীন।
                     মাঝে মাঝে খবরে প্রকাশিত হয়  কোথাও  হয়ত  স্কুল বিল্ডিং নেই। কোথাও ছাদের চাঙ্গড় খসে পড়ছে । কিছুদিন আগে একটা খবর হল কোন একটি বিদ্যালয়ে পানীয় জলের উৎসই নেই। এগুলি কিন্তু নেহাতই ব্যতিক্রম। বিভিন্ন প্রকল্পে টাকার খুব একটা অভাব নেই। অভাব হচ্ছে সদিচ্ছার, ম্যানেজমেন্টের । যদি কোথাও এসব সমস্যা থেকে থাকে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্কুল প্রশাসনের  গাফিলতির কারণে। অবাক হবেন না, সত্যিই  বিভিন্ন  প্রকল্পের জন্য টাকা পাওয়া যায়। তবে হ্যাঁ সেসব আনতে গেলে অবশ্যই ঝোপ বুঝে  কোপ  মারতে  হয়। একটু যোগাযোগ রাখতে হয়। অর্থাৎ হেডমাস্টারমশাই এবং প্রেসিডেন্টকে একটু ‘ করিৎকর্মা’ হতে হয় । হয়ত প্রশ্ন করতে পারেন শিক্ষার পরিবেশ পাওয়া প্রতিটি শিশুর অধিকার। তারজন্য অর্থ সমভাবে বন্টিত হবে না কেন ? তার জন্য  করিৎকর্মা হতে হবে কেন?  যেখানে হেড মাস্টার মশাই ‘করিৎকর্মা’  সেখানে শিশুরা সুন্দর পরিবেশ পাবে অন্যত্র নয় কেন ? প্রশ্নটা অস্বীকার করা যায় না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্যি। ‘দাবা খেলা’র নিয়ম আপনি না জানলে আপনার স্কুলে ক্লাসরুমের চাঙ্গড় ভেঙে পড়বে, কিছু করার নেই। কিন্তু এটাও ঠিক সবাই কিছু না কিছু পাচ্ছে। ব্যবস্থা যেমন হয় মেনে নিতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়। কি আর করা যাবে!
🍂
                      তবে রক্ষণাবেক্ষণ এর ব্যায়ভার স্কুলকেই সামলাতে হয়। সে ব্যয়ভারও সামান্য নয়। যার যত পরিকাঠামো তার ব্যয়ভার তত বেশি । আর সেজন্য স্কুলের ভরসা ছাত্র সংখ্যা অনুযায়ী কম্পোজিট গ্রান্ট। সরকারি দপ্তর গুলি এই কম্পোজিট  গ্রান্ট (স্টুডেন্ট সংখ্যা অনুযায়ী  বার্ষিক 25000 থেকে 100000, বছর বিশেষে পরিবর্তন হয়)  কে কুমির ছানার মত  দেখায় । সে আপনার বেঞ্চ  করা হোক, ব্ল্যাকবোর্ড করা হোক, ফুটবল কেনা হোক বা ইলেকট্রিক বিল হোক, আর যাই হোক সব করতে হয় কম্পোজিট গ্রান্ট থেকে। সেই কারণে বেশিরভাগ স্কুলে নিয়মিত  শৌচাগার পরিষ্কার হয় না। ছাত্রীদের শৌচাগারের অবস্থা খুব খারাপ  এবং তা অনেক বড় স্কুলেও। ছাত্রীরা অনেকে প্রাকৃতিক বেগ চেপে রাখে,  অনেকেই ইউরিন ইনফেকশনে  ভোগে। এক গ্রান্ট দিয়ে সবকিছু চালাতে গিয়ে  ঘাটতি তো হবেই। সেই কারণে হেড মাস্টারমশাইকে আবার ‘ ম্যানেজ ‘ করতে হয়। এটা ওপেন সিক্রেট। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানেন। তার হাতে দুটি উৎস। এক যদি হোস্টেল থাকে তবে হোস্টেল । আর আরেকটি মিড ডে মিল। ঠিক কিভাবে করেন সেটা এখানে আলোচনা সমীচীন নয়। ‘ ম্যানেজ’ করতে গিয়ে অনেক হেডমাস্টারমশাই কেস খান। চুরির দায়ে পড়ে ন । সত্যি চুরি করেন কিনা কোন কোন ক্ষেত্রে তা আমার জানা নেই। এক হেডমাস্টমশাই আপসোস করে বলছিলেন, ‘বছর বছর ক্লাবের মত কিছু এক্সট্রা টাকা যদি  স্কুলে পাওয়া যেত তাহলে আরো কিছুটা কাজ করা যেত।‘  তিনি নিজেও জানেন এটা কোনদিনই হবে না। 
                      মোটের উপর যা দাঁড়ালো দু একটি ছোট ত্রুটি ছাড়া এখন পরিকাঠামো যথেষ্ট উন্নত। ঝকঝকে স্কুল বিল্ডিং,  অধিকাংশ  ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীরা একটি মনোরম পরিবেশে পাঠ গ্রহণ করতে আসে। আবার সরকার কিছু সুস্থ প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা রেখেছেন।  নির্মল বিদ্যালয় পুরস্কার, শিশু মিত্র পুরস্কার  দিচ্ছেন।  পাশাপাশি বিদ্যালয়গুলির মধ্যে এ ব্যাপারে সুস্থ প্রতিযোগিতা চলে। যা বিদ্যালয় গুলির উন্নয়নের পক্ষে সহায়ক। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারা গেছে খাঁচাটি সোনার হয়েছে। পাখিটির কি হইল? ক্রমশ প্রকাশ্য।

Post a Comment

4 Comments

  1. AnonymousJuly 02, 2024

    অপেক্ষায় র‌ইলাম

    ReplyDelete
  2. AnonymousJuly 02, 2024

    Outstanding writing, I would like to request you to continue this NOBLE TASK,God and we all with you, best regards

    ReplyDelete