জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫৮ / সালেহা খাতুন


শান্তিনিকেতনে নরেশবাবুসহ আমরা এম.ফিল.- এর সহাধ্যায়ীরা

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫৮ / সালেহা খাতুন 

শান্তিনিকেতন যাওয়ার জন্য আমরা এম. ফিল.- এর সহাধ্যায়ীরা এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়  অধ্যাপক ড.নরেশ চন্দ্র জানা, অধ্যাপক তুষার মহাপাত্র এবং প্রভাসদা সবাই হাওড়া স্টেশনের বড়ো ঘড়ির তলায় সকাল নটায় মিট করলাম। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস আসতে তখনও দেরি আছে। নরেশবাবু আমাদের চা খাওয়ালেন। সেই প্রথম টি ব্যাগের ব্যবহার শিখলাম। গৌতম শিক্ষিত করলো। ওকে বললাম, এই কী করে চা খাবো শিখিয়ে দে। নিজেকে হামবড়া কোনোদিনই ভাবিনি, আজো ভাবি না।

 “যাবৎ বাঁচি তাবৎ শিখি” মন্ত্র জপেই চলেছি। মনে আছে অনার্সে পড়াকালীন নিজেদের উদ্যোগে কফি বানাতে গিয়ে ছাঁকনি খুঁজছি দেখে বন্ধু রীতা খুব হেসেছিল। ও তখন সুগৃহিনী। বিয়ের পর অনার্স পড়ছিল। এম. ফিল.-এর বন্ধু শান্তনু পটলের দারুণ একটা রেসিপি শিখিয়েছিল। সে রান্না দিয়ে বাবাকে অনেকবার তাক লাগিয়ে দিয়েছি। বিতান শিখিয়েছিল সর্ষে পোস্ত চিকেনের অপূর্ব এক রেসিপি। শ্যামনগর থেকে রান্না করে একবার শ্বশুরমশাইয়ের জন্য নিয়ে গিয়েছিলাম টিফিন বক্সে ভরে। তিনি আঙুল চাটতে চাটতে বলেছিলেন আর পড়াশোনার দরকার নেই। তোমাকে একটা হোটেল খুলে দিই। দারুণ চলবে।

ট্রেনে হুল্লোড় করতে করতে বন্ধুরা চললাম। আমাদের মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা হলো পূর্বপল্লি গেস্টহাউসে। আর ছেলেদের আলাদা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা হলো। তবে কাছাকাছি। খাওয়া হতো একই জায়গায়। একটি হলঘরে ডরমেটরিতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। সবকটা সিঙ্গেল বেড আমরা জুড়ে নিলাম। এক একজন গড়িয়ে গড়িয়ে বিছানার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে যেতে থাকলাম। রাতে কায়দা করে সিঙ্গেল মশারির মাঝখানে ফাঁক তৈরি করে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প হতে থাকলো। 

আর সব থেকে মজার ছিল শুক্লাদির দুই কন্যার আমাদের সাথে যাওয়া। শুক্লাদি তখন কলেজে পূর্ণ সময়ের অধ্যাপক। আমাদের সঙ্গে এম.ফিল. করছেন। ক্লাস চলাকালীন মেয়েদের ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে চলে আসতেন। ছোটো মেয়ে তো আমাদের সঙ্গে ক্লাস করে অবাক, “তোমরা এখনও অ আ পড়ো, তোমাদের থেকে আমি অনেক বেশি পড়তে পারি”। মাঝে মাঝে সালাউদ্দিন  আমার সঙ্গে ইউনিভার্সিটি গেলে বাচ্চাদুটো সালাউদ্দিনের জিম্মায় থাকতো। শুক্লাদি ভরসা করতো দেখে ভালো লাগতো। অনেক পরে মানাইয়ের এক জন্মদিনে বাচ্চারা সালাউদ্দিনের সঙ্গে মেতে আছে দেখে নীলাঞ্জনা বলেছিল খুব ভালো বেবী সিটারের কাজ করতে পারবি তোরা।

শুক্লাদির ছোটোমেয়েকে পারমিতা বাউল সাজিয়ে দিল। সে মেয়ে নরেশবাবুকে দাদু ডাকায় স্যার আপত্তি জানালেন। “আমি কি এতোই বুড়ো? বড়ো জোর জ্যেঠু ডাকতে পারিস”। দুপুরে গেস্টহাউসে পৌঁছে রেস্ট নিয়ে সন্ধের দিকে সবাই মিলে ভুবনডাঙার মাঠ পেরিয়ে বিভিন্ন দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ আমার পেট ব্যথা করে উঠলো। গেস্টহাউসে ফিরে যেতেই হবে। বন্ধুরা আনন্দ করতে বেরিয়েছে তারা সঙ্গে সঙ্গে ফিরবে কেন? আর নরেশবাবু একা একা ছাড়বেনও না। তিনি আমাকে রিকশা করে গেস্টহাউসে ফিরিয়ে আনলেন। ওষুধ কিনে দিলেন। বার বার খোঁজ নিতে লাগলেন শরীর ঠিক আছে কিনা। এখন শিক্ষার্থীদের ফিল্ড সার্ভেতে নিয়ে গিয়ে যে সজাগ দৃষ্টি রাখতে পারি সে তো এঁদের কাছ থেকেই শিখেছি। এজন্যই বার বার বলি কোনো কিছু একদিনে হয় না। 

ওষুধপত্র খেয়ে শরীর মোটামুটি ঠিক হয়ে গেল। পরের দিন খুব ভোর ভোর উঠে আমরা কয়েকজন বন্ধু নরেশবাবুর সঙ্গে রেললাইন পেরিয়ে সাঁওতাল জনবসতিতে চলে গেলাম। ওঁরা আমাদের আপ্যায়ন করলেন। খাটিয়া পেতে দিলেন বসার জন্য। গল্প হলো। ফেরার পথে একটা বাড়ির উঠোনে দেখলাম বৃত্তাকার করে গোবর দিয়ে লেপা রয়েছে। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম এগুলিকে মারুলি বলে। 
শুক্লাদির কন্যা , পারমিতা, নমনা ও আমি পূর্বপল্লির সেই ডরমেটরিতে।

দশটার পর রেডি হয়ে পুথিপাঠের জন্য পুথি সংগ্রহশালায় স্যার আমাদের নিয়ে গেলেন। তুলোট কাগজ, ভূর্জপত্র, তালপাতার বিভিন্ন পুথি দেখলাম। পঞ্চাননবাবু আমাদের সব বুঝিয়ে দিলেন। বেশ কয়েকদিন এ নিয়ে চর্চা চলে।

🍂
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সব বাড়িগুলির ইতিহাস ঘুরে ঘুরে আমাদের চিনিয়ে দিলেন , জানিয়ে দিলেন। কোনার্ক,শ্যামলী, উদয়ন, পুনশ্চ, উদীচী, উপাসনা গৃহ, ছাতিম তলা সব চিনিয়ে দিলেন। বৈতালিকও একদিন দেখলাম। সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে গেলাম। শ্রীনিকেতন, আমার কুটির, সমবায় সমিতি, বল্লভপুরের অভয়ারণ্য, কঙ্কালীতলা, কোপাই নদী , খোয়াই সব ঘোরালেন। খাওয়াদাওয়ারও কী অপরিসীম যত্ন যে নিয়েছিলেন আজ প্রায় তিরিশ বছরের কাছাকাছি হয়ে গেল তবুও ভুলিনি।

আর একটি ব্যাপার আমাদের বিস্মিত করেছিল। ফেরার দিন সবাই রেডি। নরেশবাবুকে আমরা দেখতে পাচ্ছি না। স্যার কোথায় গেলেন করে করে আমরা অস্থির হচ্ছি। তারপর জানা গেল আমরা মেয়েরা যে বাথরুম গুলি ব্যবহার করেছি নরেশবাবু সেগুলি নিজে হাতে পরিষ্কার করে দিয়ে আসছেন। যাতে তার শিক্ষার্থীদের কোনো নিন্দা না হয়। সত্যি সত্যিই অনুভব করেছিলাম দুজন অধ্যাপক তুষারবাবু এবং নরেশবাবু আমাদের বাবা-মা-র ভূমিকাই যেন পালন করছিলেন। ফিল্ড সার্ভে মানে শুধু ফিল্ডের নলেজ নয় ক্লাসরুমের বাইরে যাঁদের সঙ্গে যাচ্ছি পড়ানোর বাইরেও যে তাঁরা কতখানি বাস্তব জ্ঞানে আমাদের পরিপূর্ণ করতে পারেন সে শিক্ষাও আমরা পেতে পারি।

(ক্রমশ)

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments