জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—গ্রীণল্যাণ্ড (ইউরোপ)বউ চেয়েছিল দাঁড়কাক /চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প—গ্রীণল্যাণ্ড (ইউরোপ)
বউ চেয়েছিল দাঁড়কাক

চিন্ময় দাশ

একটা চড়ুইপাখির মনে খুব কষ্ট। আগের দিন রাতে ঝড় হয়েছিল। তার বর মারা গেছে তাতে। সেই দুঃখে কতক্ষণ বসে বসে কাঁদছে বেচারি। 
একটা দাঁড়কাক তাকে দেখছিল গাছের ডালে বসে। সে নেমে এসে বলল—কী হয়েছে গো? তখন থেকে দেখছি, কাঁদছো বসে বসে? ব্যাপারটা কী? 
–কী বলব তোমাকে। কাল ঝড় হোল না? আমার বর মরে গেছে তাতে। 
--আহারে, তাই নাকি? কাকের গলায় দুঃখু-দুঃখু ভাব। বলল--তা বাছা, মারাই যখন গেছে, সে তো আর ফিরবে না। কেঁদে আর কী করবে তুমি?
চড়ুই বলল—তাই বলে, মন কি মানে, তুমি বলো? কত কাজের লোক ছিল সে। পোকা-মাকড় বলো, গমের দানা বা যবের দানা বলো, খুঁটে খুঁটে এনে দিত আমাকে। কোন ঝামেলাই ছিল না জীবনে। এখন একেবারে একলা হয়ে গেলাম আমি। দেখবার মতো কেউ রইল না মাথার উপর। 
কাক একটু কাছে এগিয়ে এল—একটা কথা বলি তোমাকে। আমারও অবস্থা তোমারই মতো। বউ নাই আমার। সবই নিজেকে সামলাতে হয়। একই কষ্ট আমাদের দুজনেরই। 
এমনিতেই মন ভালো নাই। তার উপর উনি এলেন তার দুঃখের বাখানি গাইতে। বিরক্তির একশেষ। চড়ুই খেঁকিয়ে উঠল—তোমার বউ নাই তো, আমি কী করতে পারি। আমাকে শোনাতে এসেছ কেন? 
আসলে হয়েছে কী, বউ মারা যাওয়ার পর, একটাই ভাবনা তার মনে। একটা বউ দরকার। যেভাবেই হোক, একটা বউ জোগাড় করতেই হবে। কাক বলল—রাজি থাকলে, অনেক কিছুই করতে পারো তুমি। 
চড়ুই বলল—আমি? আমি কী করতে পারি? 
কাক বলল—তুমি আমাকে বিয়ে করো। দুজনেরই কষ্ট ঘুচে যায় তাতে। আনন্দে সংসার করব দুজনে। 
চড়ুই বলে উঠল—তোমাকে বিয়ে করব? আমি?
কাক বলল—কেন নয়? খাওয়া-দাওয়ার কথা বলছিলে তুমি। পোকা-মাকড় খেতে যাবে কেন? কত বড়ো দুটো ঠোঁট দেখেছ আমার? আস্তাকুঁড় ঘাঁটা লোক আমি। কতো উপাদেয় সব খাবার এনে দেব তোমাকে। জীবনে সেসব চেখেও দ্যাখোনি কোনদিন। থাকবার ঘর পাবে। তাছাড়া, দেখছ না, ইয়াব্বড় দুটো ডানা আছে আমার। তার তলায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকতে পারবে। এত সুখে রাখব তোমাকে, কল্পনাও করতে পারবে না তুমি।
চড়ুই বলল—বাবারে বাবা। এত সুখ? এ আমার সইবে না গো। মনে মনে বলল, কেলে-কুচ্ছিত হতভাগা। বদের ধাড়ি কোথাকার। বয়েই গেছে এমন একজনকে বিয়ে করতে। 
রইল পড়ে কান্নাকাটি। ফুড়ুৎ করে উড়ে বেরিয়ে গেল চড়ুই।    
দাঁড়কাক ভাবতে বসল, কী করা যায়? একটা বউ না হলে যে সংসার চলছে না। ভারি ঝামেলা হোল। 
একটা বউ পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে কাকটা। যে করেই হোক, একটা বউ জোগাড় করতেই হবে। অনেক ভেবে ভেবে, বুনো হাঁসেদের কথা মনে এল।
শীত পড়ে গেছে। নদীর জল জমে উঠতে শুরু করেছে। উড়ে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে বুনো হাঁসেদের। এখনই যাওয়া দরকার।
সাগরের ধারে পৌঁছে দেখল, যা ভেবেছিল তাই। হাঁসেরা ফিরে যাওয়া শুরু করে দিয়েছে। দুটো হাঁসকে বেছে নিয়ে, কাক বলল—একটা জরুরী কথা ছিল তোমাদের সাথে। 
হাঁসেরা বলল—আমাদের তো সময় নাই গো। আমরা ফিরে যাচ্ছি এখন।
--তাহলে, আমিও যাই তোমাদের সাথে। যেতে যেতে কথাটা বলা যাবে।
হাঁসেরা বলল—তা কী করে হবে? যা বলবার এখনি বলো। তবে তাড়াতাড়ি। নইলে দলছুট হয়ে যাব আমরা। 
কাক ঝটপট নিজের কথাটা বলে ফেলল—তোমাদের দুজনকে বিয়ে করতে চাই আমি। 
এমন কথা কোনদিন শোনেনি হাঁসেরা। তারা তো হেসে আকুল। কিন্তু মজাও পেয়েছে বেশ মনে মনে। ভারি কৌতুকের ব্যাপার তো! তারা রাজি হয়ে গেল। বলল—ঠিক আছে। বাসা তৈরি করে রাখো তোমার। পরের বার যখন ফিরে আসব, তোমার ঘরেই উঠব দুজনে। একটু বড় করেই বানিয়ো কিন্তু। 
এক কথায় দু’দুটো বউ পাওয়া গেছে। ভারি গদগদ অবস্থা তার। কাক বলল—না, না। যাবে কেন আর। থেকেই যাও তোমরা। 
🍂
হাঁসেরা বলল—তা কী করে হয়? বলা কওয়া নাই দলের কাউকে। দুম করে কি থেকে যাওয়া যায়? তুমিই বলো।  
কাক তখন মরীয়া। এমন সুযোগ ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় মোটেই। সে বলল—তাহলে চলো, আমিও যাচ্ছি তোমাদের সাথে। 
হাঁস দুটো আঁতকে উঠেছে-- তা আবার হয় না কি? আমাদের সাথে উড়ে যাওয়া তোমার দ্বারা হবে না। 
হাঁসেদের কথা কানে তুলল না কাক। সে নাছোড়বান্দা। সঙ্গে যাবেই। হাঁসেরা আবার বলল—কথা শোন আমাদের। আমরা জলের পাখি। আমরা যা পারি, তোমরা তা পারো না। যারা সাঁতার কাটতে পারে না, বা জলে ভেসে থাকতে পারে না, তারা পারবে না এতটা পথ পাড়ি দিতে। জেদ কোর না। 
কিন্তু কাক রাজি নয়। একটা বউ চাইছিল সে। দু-দুটো বউ পেয়ে গেছে। কোন মতেই তাদের কাছ ছাড়া করা যাবে না। সে বলল-- কোন অসুবিধা হবে না আমার। দরকার মতো তোমরা জলে নেমে, জিরিয়ে নেবে। আমি বাতাসে ভেসে ভেসেই চলে যেতে পারব।
কী আর করা যায়, হাঁস দুটো উড়তে শুরু করে দিল। কাকও চলেছে তাদের সাথে। অনেকখানি যাওয়ার পর, বিপদ এসে হাজির।  ডানা আর নাড়ানো যায় না। ভয়াণক কষ্ট হচ্ছে। শরীর শিথিল হয়ে আসছে তার। সে ককিয়ে উঠল—একটু জিরিয়ে নেওয়া যায় না কোথাও? 
--এখানে কোথায় জিরোবে তুমি? আকাশে কি বিশ্রামের জায়গা থাকে? তখনই বলেছিলাম তোমাকে। শুনলে না তো আমাদের কথা। 
হাঁস দুটো ভয় পেয়ে গিয়েছে। কাক বলল—যা পারো, কিছু একটা করো। দোহাই তোমাদের। আর পারছি না আমি। 
হাঁসেরা ভেবে নিয়ে, বলল—চটপট নীচের দিকে নামতে থাকো। আমরাও নামছি। 
হাঁস দুটো জলে নেমে পড়েছে। গায়ে গা লাগিয়ে ভাসছে দুজনে। কাককে বলল—আমাদের পিঠে নেমে পড়ো। 
কাক বিড়বিড় করে কী জবাব দিল, বোঝা গেল না। ঝুপ করে নেমে পড়েছে হাঁসগুলোর পিঠে। নেমেই এলিয়ে পড়েছে। ঘুম, না কি জ্ঞাণ হারিয়ে ফেলেছে, বোঝা যাচ্ছে না। 
তখনই দেখা গেল, দলের শেষ হাঁসগুলো পেরিয়ে গেল জলের হাঁস দুটোকে। একটু একটু করে দূরে চলে যাচ্ছে তারা। দেখেই বুকটা ছাঁৎ করে উঠল দুজনের। দলের সাথে থাকতে না পারলে, পথ হারিয়ে যাবে তাদের। সমুদ্র বিছিয়ে আছে চারদিকে। যেদিকে তাকাও, শুধু জল আর জল। কুল দেখা যায় না কোথাও।
পথ হারিয়ে ফেললে, একমাত্র মৃত্যুই লেখা হয়ে যাবে কপালে। ওদিকে শেষ দলটা মিলিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট একটা বিন্দু হয়ে। 
এক মূহুর্তও বিলম্ব নয় আর। ডানা ঝাপটে জল ছেড়ে উঠে পড়ল হাঁস দুটো। সঙ্গীদের পিছন ধরতেই হবে। যে ভাবেই হোক, দলের সাথেই থাকতে হবে তাদের। ডানা মেলে দিল তারা। 
হাঁসেরা উড়ে যেতে, কাকটা জলে পড়ে গেছে। কনকনে ঠাণ্ডা সে জল। সামান্য সময় ছটফট  করল বেচারা। তার পর? তার পর আর কী? বুকের ধুকপুকানি থেমে গেল একটু বাদেই। ধীরে ধীরে জলের গভীরে নেমে যেতে লাগল তার দেহটা। একাই চলেছে অচেনা অজানা নাম না জানা কোনও এক দেশে। সেখানে হিমশীতল শয্যা পাতা আছে। চিরকালের মতো ঘুমিয়ে থাকবে সেখানে।
একাই নীচে নেমে যাচ্ছে কাক। একজন বউও সাথে নাই বেচারার।
[প্রাণীবিজ্ঞানীরা বলেন, সমুদ্রের তলার তীব্র ঠাণ্ডায়, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল দাঁড়কাকের প্রাণহীন দেহটা। সমুদ্রের তলদেশে কালো রঙের ছোট ছোট যে শামুক (small black mollusc) ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, তাদের না কি জন্ম হয়েছিল কালো দাঁড়কাকের দেহের সেই টুকরোগুলো থেকেই।]

Post a Comment

0 Comments