জ্বলদর্চি

ইস্কুল ফিস্কুল পর্ব -৮/সৌমেন রায়

ইস্কুল ফিস্কুল 

পর্ব -৮

সৌমেন রায়

চিত্র – অসিত কুমার সেনাপতি

পায়ে মারি শিক্ষা  (১)

হেডিংটা ধার করা। সুধীর চক্রবর্তী মহাশয়ের প্রায়  কুড়ি বছর আগে শিক্ষার উপর লেখা বই থেকে। ছোটবেলায় ছেলেমেয়েদের শিক্ষা হয় প্রাইমারি স্কুলে। সেখানেই সরকার, সমাজ, শিক্ষক সবাই মিলে এমনভাবে পায়ে মারে যে সে আর সারা জীবন শিক্ষা জগতে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। বছরের পর বছর যে স্কুল গিয়েও শিখতে পারছে না এর শুরুটা প্রাইমারি স্কুল। এই সময় শিশুর শেখার বিষয় মূলত তিনটি। প্রথমত অক্ষর চিনে রিডিং পড়তে পারা ,মূলত বাংলা ও খানিকটা ইংরেজি। দ্বিতীয়ত  গণিতের ভাষা, সংখ্যা চিনে যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ শেখা। তৃতীয়ত এই দুটি শিক্ষার ওপর এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। মুখের ভাষা পশু পাখি থেকে মানুষকে আলাদা করেছিল। তেমনি এই কটি ব্যাপার গুহাবাসী আদিম মানুষ থেকে আধুনিক মানুষকে আলাদা করেছে। এই যে অক্ষর চেনা, লেখা, অংক করা এগুলো কিন্তু মানুষের সহজাত নয়। কথা বলা, ব্যবহারিক কাজ করা অর্থাৎ জীবন যাপন করতে যেগুলো সবার প্রয়োজন হয় সেগুলো মানুষের সহজাত। কিন্তু অক্ষর চেনা, লিখতে পারা, সংখ্যা চেনা, যোগ বিয়োগ করা এগুলি মানুষকে অর্জন করতে হয়। সেই কারণে নিরবিচ্ছিন্ন অনুশীলন করতে হয়,  শ্রম করতে হয়। কিন্তু এই  শিক্ষায় উদাসীনতা  দেখলে চোখে জল আসবে। সমস্ত আয়োজন সত্বেও নিদারুণ ব্যর্থতা। অক্ষরহীনতার অভিশাপ  বইতে  হচ্ছে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে। পরিসংখ্যান চাইলে এ এস ই আর(ASER ) রিপোর্টে খানিক আভাস পাবেন । জানবেন ওটা হিমশৈলের চূড়া। তাহলে যে বছর বছর জাতীয়স্তরে এবং বর্তমানে শুরু হয়েছে রাজ্যস্তরে বিদ্যার মান যাচাই করতে পরীক্ষা। তার  ফলের উপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা কি নেওয়া হচ্ছে না?  আইজ্ঞা ওসকল খাতার ফল বাইরে আসেনা। অবিশ্যি বাইরে এলেও বুঝতে পারতেন না। আমরা ওসব ‘ম্যানেজ’ করে  নিই । কিভাবে জানতে পারবেন আস্তে আস্তে। 

        তা শিশু শেখে না কেন? শহরের এক গৃহবধূ প্রথম জীবনে চাকরি করতেন। অসুস্থতা জনিত অসুবিধার কারণে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছেন। ইচ্ছে হল কিছু ছেলে মেয়েদের পড়াবেন। স্বামীও সাহায্য করতে প্রস্তুত। দুজনে জোগাড় করে আনলেন চারজন পড়ুয়াকে। যারা ফোর ফাইভে  পড়ে কিন্তু অক্ষর  ভালো  করে চেনেনা। প্রথমে তো তারা মুখস্থ করাকে শিক্ষা বলে জানতো। প্রথম দিনই বলল, হ্যাঁ পড়তে পারি। পড় দেখি। তুমি বলে দাও, আমি  মনে  রেখে  দেব। মনে রেখে দেওয়াটা যে পড়া নয় সেটা বোঝাতেই লাগলো বেশ কিছুদিন। তারপর শুরু হল পড়া। সবার জন্য বই এল, স্লেট এল, পেন্সিল এল, চার্ট এল, ব্লক এল। এক বছরের মধ্যে চারজনের দুজন বানান করে পড়া, সহজ যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ, ঘড়ি দেখা ক্যালেন্ডার দেখা ,ঠিকানা, আধার নম্বর, ফোন নম্বর লেখা শিখেও গেল। সমাজ, অভিভাবক ও  ছেলেদের অনাগ্রহ ইত্যাদি ছিল। সে বিষয়ে  পরে  আলোচনা  করা  যাবে। মোটামুটি ক্লাস খুব বেশি হলে হয়েছে ২০০ ঘন্টা। তাতেই খানিকটা তো শেখানো গেছে। মানে শেখানো যায়। তাও স্কুলগুলিতে হচ্ছে না কেন ?

                     প্রথমত এখানে চারজনকে পড়িয়েছেন দুজনে। মানে ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসা। সেখানে যথেষ্ট ইন্ডিভিজুয়াল কেয়ার নেওয়া গেছে। বিদ্যালয়ে এটিই হবে অন্তত ২৫ জনের ক্লাস। সুতরাং এমন কেয়ারের প্রশ্নই নেই। তাছাড়া সেই পরিমাণ কেয়ার দিতে গেলে যে শ্রম দরকার  সেটা  কি  সবার কাছে আশা করা যায়? শিশু মনোবিজ্ঞান বিষয়ে  আগ্রহীই বা কতজন? প্রাইমারির  D.El.Ed  বা সেকেন্ডারির B . Ed কোর্সগুলি  হয়ে  দাঁড়িয়েছে অনর্থক কতগুলি কথা মুখস্ত করা আর লেসন প্ল্যান তৈরি করা। শিশু- মন বোঝার সময় কোথায়? এইসব কেউ পড়াশোনা করে না।যদিবা  কেউ পড়ে তাহলে সে উপহাসের পাত্র হয়। সকলে বলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিখন এরকম কটা কথা মুখস্ত করলেই ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া যায়। সমাজ মনে করে শিক্ষাদান সহজাত। সহজাত শিক্ষাও যে অনুশীলনে পরিশীলিত হয় সে কথা শুনবে কে? আবার প্রাইভেট  বি এড কলেজগুলিতে যেহেতু ছাত্রছাত্রীরা পয়সা দিয়ে পড়ে তাই সেখানে বিশেষ ব্যবস্থা আছে। এদের সবাই প্র্যাকটিস টিচিং  পর্যন্ত  নিয়মিত করেনা। বিস্তারিত ব্যাখ্যা  এই প্রবন্ধের বিষয় নয়।

               আগে প্রাইমারি শিক্ষকরা অনেকেই হতো মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক বড়জোর  বি  এ পাস। তাদের জানার পরিধি ছিল কম । তাই পড়ানোটাকে তারা তাদের কাজ মনে করতেন। এখন চাকরি আকালে এম এ, এম এস সি ছেলেরা প্রাইমারি টিচার। দূর-দূরান্ত থেকে যাতায়াত করেন। তাদের মধ্যে অনেকের ভাবটা এদের আর আমি কি পড়াবো?  আমি কত কি পড়েছি। সে পড়া কাজে লাগল না। প্রান্তিক শিক্ষার্থীরা অনিয়মিত উপস্থিতি ও অনভ্যাসের ফলে পুরানো পড়া ভুলে যায়। একই জিনিস বারবার পড়াতে হয়। উচ্চশিক্ষিতরা বুঝতেই পারেনা যে এই সামান্য পড়া ভুলে যায় কি করে। একে যাতায়াতের ক্লান্তি, তার উপর হতাশ মন। শিশুদের যত্ন নেবে কি করে? তারা বলে যার হওয়ার তার এমনিতেই হবে। তাহলে স্যার আপনার চাকরিটা কি জন্য?  প্রশ্ন করার লোক নেই। জানালা বানান বল, চা   ক মা। দূর তোর দ্বারা হবে না। এই তুই বল। জা না লা। দেখ কেমন বলে দিল। এইভাবে চলছে শিক্ষা। 

       ডেলি যাতায়াত যে বাসে তার মধ্যেই এক প্রাথমিক শিক্ষিকা অপর একজন শিক্ষককে জিজ্ঞেস করছেন, ‘এই তোদের প্রতিদিন যেতে হয়!?’ সহযাত্রী অবাক। যেতে হবে না কেন? ‘আমরা চারজন আছি। সবাই সপ্তাহে তিন দিন করে যাই।‘ মানে গড়ে দুজন উপস্থিত থাকে চারজনের স্কুলে। এক প্যারাটিচার প্রাথমিক শিক্ষক হিসাবে জয়েন করেছেন দূরের প্রাথমিক স্কুলে। তিনি  কাজের প্রতি নিষ্ঠাবান। কিন্তু এখন পড়েছেন বিপদে। নিজে এক জায়গায়, স্ত্রী-পুত্র আর এক জায়গায়। জয়েন করে ফিরে এসে বলছেন হেডমাস্টার খুব ভালো। একদিনেই কি করে বুঝলেন? দশ দিন অলিখিত ছুটি দিয়েছেন। হেডমাস্টার মশাই ভালো হলেন, শিক্ষকেরও ভালো হল। স্টুডেন্টদের কি হল জানার লোক নেই। অবশ্যই সবাই  তেমন  না। বাচ্চাগুলোকে পড়ানো জীবনের ব্রত কারো কারো কাছে। এখনও যতটুকু হচ্ছে তা তাদেরই অবদান। উপরের দুটি উদাহরণের প্রতিবিষও ব্যবস্থার মধ্যেই আছে। ক্রমশ জানতে পারবেন।

🍂

                 অভিভাবক, সমাজ এরা কি চায় ছেলেটা শিখুক? ওই দম্পতি বলছেন সেখানে চরম হতাশা। এদের চারজনের বাবা, মা শ্রমজীবী। জীবনের প্রতি পদে তারা লেখাপড়া না শেখার যন্ত্রণা ভোগ করে। তবুও তারা খুব উদ্বিগ্ন নয় পড়ালেখা  শেখানোর ব্যাপারে। তারা বই খাতা কিনে দেয়, স্কুলে পাঠায় কিন্তু কি হচ্ছে খোঁজ নেয়না । মানছি তারা পড়ার অগ্রগতি খোঁজ নিতে পারেন না। কিন্তু পড়তে আসছে কিনা এটা দেখতে পারেন। বছরের অনেকগুলো দিন তারা আসন পেতে বসে থেকেছেন কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা আসেনি প্রায় বিনা কারণে। অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোন কাজ হয়নি। তাই বারবার অক্ষর, সংখ্যা চিনতে ভুল করছে। এখনও ভুলে যায়। মনে করাতে হয়। একটা সময় ভদ্রমহিলা তো বিরক্ত হয়ে বন্ধই করতে চেয়েছিলেন। তারা স্পষ্ট বলছেন এ তাদের নিজেদের ইচ্ছা পূরণ । তেমন কিছু পরিবর্তন হবে না। চারজনের মধ্যে একটি মেয়ে, নাম দেবী। তাকে অন্তত কিছু বেসিক এডুকেশন দেওয়া এখন তাদের অন্যতম লক্ষ্য। জানে বেশি দিন পড়তে আসবে না। বিয়ে হয়ে যাবে। ও কিছুটা  শিখলে যদি ওর বাচ্চাটা অন্তত শেখে। বাড়িতে এরা বই খুলে দেখে না। অনুশীলনের অভাবে পড়ার অগ্রগতি খুব কম। এখনো সেই বানান করে পড়াতেই আটকে আছে। 

তারা একবার ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন ছুটির সময়গুলো সারাদিন কি করিস? যা শুনেছিলেন তাতে তাদের চক্ষু চড়ক গাছ। দরিদ্র বাড়ির সন্তান সকাল আটটার পর ঘুম থেকে ওঠে। তারপর খেয়ে খেলতে বেরিয়ে যায়। খেলে, ঘোরাঘুরি করে এসে দুপুরে খায়, ঘুমায় । আবার খেলে, টিভি দেখে। সারাদিনে পড়ার, অন্তত পড়া পড়া খেলার কোনো গল্পই নেই। একবারও পড়তে বসেনা। গ্রামাঞ্চলে সমীকরণটি একটু এদিক ওদিক হলেও পড়তে না বসাটা এখানে ধ্রুবক রাশি। সকাল বিকাল পড়তে বসানো তো অভিভাবকের দায় নাকি? শিখবে কি করে? নতুন কিছু শিখতে না পারলে ইন্টারেস্ট কমে যায়। হচ্ছেও তাই। তবু তারা অনেক কায়দা কসরত করে ধরে রেখেছেন। স্কুলগুলিতে নিশ্চয়ই এদের মত অভিভাবক আছে। সেখানে তো আরো  গোলমেলে ব্যাপার । কারণ  গড়ে প্রায় একশ জন অভিভাবক। এখন তো আবার সবাই রাজা, কেউ  কারো  কথা শোনেনা। কোথাও সামান্যতম সামাজিক অনুশাসন নেই। সকাল, সন্ধ্যা বেলা ঘুরে বেড়ালে পাড়ার কাকু, জেঠু বকবে সে ভয় নেই। কারণে অকারণে চাঁদা আদায় করে উদ্ভট চুল- ছাটের দাদা, দিদিরা উৎকট স্বরে মাইক বাজাচ্ছে, ধামাকা করছে। গোটা সমাজ সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় জিনিসটার ব্যাপারে সর্বাপেক্ষা বেশি উদাসীন। মেতে থাকা, মাতিয়ে রাখাই বর্তমান সমাজের অভিজ্ঞান।

 (পরবর্তী অংশ পরের সংখ্যায়)

Post a Comment

8 Comments

  1. AnonymousJuly 30, 2024

    এবারের লেখাও খুবই মূল্যবান। সমাজ অর্থনীতি রাজনীতি শিক্ষার পরেয়া করে না। কারণ অশিক্ষিতরাই রাজশক্তি। শিক্ষিতরা চাকরি ও পুরস্কারের লোভে তাঁবেদার। কোথায় মুক্তি এই অবক্ষয়ী যাত্রা থেকে? আরো লিখুন। সবাই ভাবি। আমরা যারা এখনও মানুষের উজ্জ্বল উত্তরণে বিশ্বাস রাখি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ নেবেন।ঠিক বলেছেন।উত্তরণে বিশ্বাস রেখেই এগিয়ে যেতে হবে।🙏

      Delete
  2. সৌমেন আমাদের সামনে একটা বড়ো আয়না মেলে ধরেছেন। কেবল কতগুলো কথা সাজিয়ে একটা নিবন্ধ খাড়া করে আর পাঁচজন পরিচিত মানুষের সামান্য পিঠ চাপড়ানি পাবার আশায় তিনি এসব লিখছেন না, মনোযোগ সহকারে ধারাবাহিক নিবন্ধগুলো পাঠ করলেই তাঁর তীব্র অন্তর্দাহের‌ আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. Soumen RoyAugust 01, 2024

      অনুভূতির স্পর্শ পাওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

      Delete
  3. শিক্ষার নামে গোটা বিষয়টাই একটা শূন্যতার হাহাকার। আজকের প্রাথমিক বিদ্যালয় আর শিক্ষার নির্মাণবেদী নয় । এমন শূন্যতা নিয়ে পূর্ণতার সাধনা সম্ভব? সৌমেন অন্ধকারে পিদিম জ্বালানোর ব্রত নিয়েছেন। আমরা সবাই যেন তাঁর পাশে থাকি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. Soumen RoyAugust 01, 2024

      সহমর্মিতার জন্য ধন্যবাদ।অনেক নমস্য আঁধারে আলো হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।তাদের কথাও আসবে শেষের দিকে।

      Delete
  4. নির্মাল্য ঘোষOctober 10, 2024

    শিক্ষকতার চাকরি টি পেতে গেলে পরীক্ষা দিতে হয়। সে পরীক্ষা নিয়ে কেলেংকারি তে না হয় নাই গেলাম। আচ্ছা চাকরি টি ধরে রাখতে গেলে আর কোন পরীক্ষা দিতে হয় না কেন?

    ReplyDelete
  5. ওপরের প্রতিটি বক্তব্য আমার ও ।

    ReplyDelete