জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন/পর্ব -১৪/মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া

ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব -১৪
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনীয়া

মিলাই প্রাণের এ মোহনায় ...

স্বপ্ন দেখছিল ঝিনি। জয় জেঠু তাদের ছাদে মাদুর পেতে বসে গান গাইছে। ছাদের কোণে দড়ি বেঁধে উঠিয়ে দেওয়া  মালতি লতার ঝাড়ে এমন ঝেঁপে তাদের ফুল ফুটেছে, আর থইথই করছে তাদের সুবাস যে সেই গন্ধে জড়িয়ে মড়িয়ে উঠে যাচ্ছে জেঠুর গান।খুব গমগমে মেঘের মতো জেঠুর গলায় অনেক তো দিন গেল বৃথা এ সংশয়ে/এসো এবার দ্বিধার বাঁধা পার হয়ে ... ছোড়দা হঠাৎ তার সরু রিণরিণ গলায় জেঠুর সাথে গেয়ে উঠল তোমার আমার সবার স্বপন মিলাই প্রাণের এ মোহনায়... জেঠু তার পিঠ চাপড়ে বলছে সাবাস! জেঠু গাইলে মনে হয় তারাভরা আকাশ অবধি যেন পৌঁছে যাচ্ছে  তা।
 মা বাপি তারা তিন ভাইবোন গোল হয়ে বসেছে গানের চারদিক।
         জেঠু খুব পান খায়।আর ভালবাসে মায়ের হাতের ডিম ভাজা আর চা। বাড়ি ঢুকতে ঢুকতেই বৌঠান,একখানা কাঁচা লঙ্কা ঠেসে ডাবল ডিমের মামলেএএএএট আর আদা দিয়ে কড়া চাআআআ বলে হেঁকে উঠবে।অমনিই মা পেঁয়াজ কুচোতে বসে যাবে।
        ততক্ষণে তাদের তিনজনের হাতে জেঠুর আনা পপিন্স লজেন্সের ভাগ বাটোয়ারা চলছে।মোটাসোটা জেঠু ডিম আর চা খেয়ে পানের ডিবে খুলে পান জর্দা মুখে নিয়ে আয়েশ করে বসবে মাদুরে আর খানিক পরেই ম্যাজিক শুরু হয়ে যাবে গানের।
       আজ কিন্তু জেঠুর গান থেমে গেল হঠাৎই। মানে থামলো না ঠিক হাত মুখ নেড়ে স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে জেঠু গাইছে অথচ শোনা যাচ্ছে না। তোরা শুনতে পাচ্ছিস? বাপি শুনছো বলে তাকিয়ে দেখে পাশে তাদের বাবা তো নেই।মা ,বাপি কোথায় গেল গো বলতেই দেখল মা যেখানে বসেছিল; জায়গাটা  ফাঁকা। ছোড়দা ছোড়দা ওরা নেই কেন?ওরা কোথায় বলে গুঙিয়ে উঠেই তার ঘুম ভেঙে গেল।
         পথে এবার নামো সাথী গানের সঙ্গে সঙ্গেই ছাদে বসে থাকা সক্কলে মিলিয়ে গেল তক্ষুনি। জয় জেঠুর পান জর্দার গন্ধ,ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি, দরদী হাসিভরা চোখ,আর দরাজ গলায় কিসের ভরসা লেগে থাকে কে জানে। মনে হয় ঘাসে ঘাসে পা ফেলে খুব আনন্দে বনের পথে  কোথায়  কোথায় যে জেঠু যাচ্ছে ... মানে না বুঝলেও কী করে যে গানের কথা মনে বসে যায়? তুমুল ভাঙচুরের রাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার চরম উদ্বেগ ও হতাশার ভোরে সে  কিনা স্বপ্ন দেখল তাদের বাড়িতে আগের সেই পরিচিত রাত আর দরদী সুরের আশ্রয়কে!
        অথচ শুনশান ফাঁকার মধ্যে ঘুম ভেঙেই তার মাআআ বলে চিৎকার দেওয়ায় দৌড়ে এল ছোড়দা। বোনের পেছনে লাগা নেই তার ,দুষ্টুমি নেই ,শুকনো মুখে পাশে দাঁড়িয়ে কেবল  ভয় নেই ,এই তো আমি বলে আস্তে আস্তে সে বোনের  মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।যেন সে নিজেই বড় হয়ে গেছে এক রাতে।  
🍂
       অথচ আশ্চর্য এই ঘটনায় আশ্বস্ত না হয়ে আরও বিচলিত হয়ে পড়ে ঝিনি। মা কই? মা কোথায় ? হঠাৎই দারুণ ভয় করছে তার। ঘুমিয়ে পড়ার পরে ওরা কি এসেছিল আবার?মাকেও কি ধরে নিয়ে গেছে আর কোনো কালো গাড়ি করে?কেউ কোনো কথা বলছে না তাই? ছোড়দামণি ও ছোড়দামণি মা কোথায়?
    ছোড়দার জামা খামচে ধরে ঝিনি,মা কখন আসবে? একটু পরেই আসবে,পোস্ট আপিস গেছে মা।কী হয় ওখানে গেলে?ওখানে ফোন আছে। রাঙা মেসোর ব্যাঙ্কে ফোন করবে।তা'লে কী হবে?মেসো আসলে মা তাকে নিয়ে বাপির কাছে যাবে।
         বাপি কোথায়? বাপি? বাপিকে কোথায় নিয়ে গেছে ওরা?জানি না।চাপবার চেষ্টা করে করেও আর না পেরে কেঁদে ফেলে ছোড়দা।সেও  ছোড়দার গলা জড়িয়ে জোরে জোরে কাঁদে।দাদামণি এসে দুজনকেই জড়িয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
    কী কততিচিস এহেনে?  কানতি কানতি আ্যম্বায় জ্বর আসে যাবানি কলাম।রুবিদি এসে চোখ মুছিয়ে ধমক দিল।মুক ধুতি অবে নানে? মুড়ি খাবি?কলপাড়ে চল দিনি।মুকখান ধুয়ে দেই।তারির পর গুড় দে মুড়ি দেবানে।বলে জোর করে তাকে নিয়ে যায়।  
       কাচ ঝাঁট দিয়ে ,মেঝে মুছে শোওয়ার ঘরখানা গোছগাছ করে রুবিদি। আলনা খাড়া হয় আবার।শাড়ি জামা পাট হয়। ট্রাঙ্ক বাক্সে কোনমতে জিনিস পাতি ঢুকিয়ে আবার থাক থাক সাজিয়ে রাখে রুবিদি। দাদামণি বইপত্র গোছায়।ছোড়দা কুড়িয়ে তোলে চশমার খাপ, মায়ের কিউটিকুরা পাউডার কৌটো,আফগান স্নোর ভাঙা শিশি। পেতলের সিঁদুর কৌটো,ঝিনির কাজললতা।   
           এই তো কেমন ভাল ছ্যামড়া অইছ দুইয়োজনে।রান্ধার ঘরে কাজ কততি যাতিছি তো আমি।বুনডিরে কলাম দেকপা এম পিলে।তোমরা বড়ো দাদা অইছ না?গুড়মুড়ি খাবা ও মণি?অন্যদিন হলে রুবিদির পেছনে লেগে মুখ ভেংচিয়ে অস্থির করে তুলত দাদারা।আজ শুধু মাথা নেড়ে  না বলে।
     রান্না ঘরে উনুন ধরিয়ে নিজের বুদ্ধিমত সেদ্ধভাত বসায় রুবিদি। বারবার সাধে তাদের মুড়ি খেতে।
         গুড়মুড়ি অবশ্য কেউই খায় না।বারান্দার তক্তপোষে দাদাদের পাশে গিয়ে বসে‌ ঝিনি। খিদে পেয়েছে? দুটো বিস্কিট খাবি?এনে দেবো রান্নাঘর থেকে?জল খাবি বোন?সে বারবার মাথা নাড়ে।ছোড়দা তার হাত ধরে থাকে। হঠাৎই  যেন বড় হয়ে উঠে ছোট বোনের দেখভাল শুরু করেছে মিতু। বারান্দার চৌকিতে মা'র পথ চেয়ে তারা বসে থাকে তিনজন। 
     সকাল বেলাতে রোদ উঠেছে এতো, মাজা পেতলের ঘটির মতো ঝকমকে সে আলো তবু বাড়ির ভেতর আসার কোনো রাস্তা পাচ্ছে না যেন।আস্তে আস্তে অন্ধকার ঝুপসি ছায়া স্থায়ী এক বাসিন্দে হয়ে চেপে বসল ঝলমলে তাদের বাড়ি ঘিরে।  ঝাউ গাছটার ডালপালা থেকে নীল অন্ধকার কিছুতেই পিছু হটল না আর। ঝাঁকড়া শিশু গাছ দুটোতেও মেঘ করে থাকে যখন তখন।আর সবকিছুর মতোই তাদের বাড়িটাও যেন বদলে ফেলল হাবভাব। হাসিখুশি স্বভাবের বাড়িখানায়  হইচই চ্যাঁ ভ্যাঁ, খিলখিল ,এদিক ওদিক থেকে ছোড়দা বা মায়ের গেয়ে ওঠা দু কলি, দাদামণির হেঁড়ে গলার বেসুর বা তাদের বাবার হঠাৎই আবৃত্তি করে ওঠা ক'লাইন রবি ঠাকুর সব থামিয়ে একেবারে ঠান্ডা মেরে গেল। দিনের বেলাতেও সেই অন্ধকার সামলাতে সামলাতে তারা হাঁটাচলা করার অভ্যেস করে ফেললো।
      ঝিনিদের গ্ৰামে প্রত্যেক শীতকালে বেদেরা তাঁবু ফেলে। মরা জীবজন্তু ফেলা হয় যে মাঠে সেই ভাগাড়ের মাঠে রাতারাতি কারা এসে দরমা পলিথিন দিয়ে বাসা গড়ে নেয়।এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখা যায় সার সার ক'খানা ঝুপড়ি থেকে ধোঁয়া উঠছে। ফ্যাকাশে চুলের ছেলে পুলে ঘুরছে। ছেঁড়া কাঁথা কানি মেলা আছে দড়িতে। একধারে দুতিনটে খচ্চর আর ছাগল ঘাস চিবোচ্ছে।
        ঘটি বাটি সাবধান!দোর আবজে রাখপা ,সুধা মাইমা তাদের পুকুরে জল নিতে এসে মা বা রুবিদিকে বলে, বেদেরা এসি গেছ তো, ওদের বলো হাতটানের স্বভাব আছ্। ও মাইমা,হাতটান মানে কী গো? শুনেই  উঠোনের ওধারে গিয়ে ছিক করে পিক ফেলেই একমুখ হেসে অন্য কথা পাড়ে সুধা মাইমা। মানেটা  পরে জেনে নিতে হবে  ভাবতে ভাবতেই রান্না ঘর থেকে কলা মুলো যা পায় কোচড়ে নিয়ে মণি, টেনি খোকনদের সঙ্গে বেদেদের বাঁদর  খচ্চর দেখতে দৌড়োয়।
           দলটার মধ্যে দু'তিনটে বাঁদর থাকে। বাঁদররখ জামাকাপড় পরা থাকলেও 
শেকলে বাঁধা দেখে মায়া করে খুব। কিন্তু বাড়ি  থেকে আনা পাকা কলা বা কাঁচা মুলো হাতে করে ওদের কাছে যেতে নিলেই খ্যাচম্যাচ করে দাঁত খিঁচোয় দেখে পিছিয়ে যায় ছোটোরা।বাঁদরের মালিকও হেসে ওদের হাত থেকে খাবার নিয়ে  ধরিয়ে দেয় মুন্নি বা ছোটুয়ার হাতে।সেও দাঁত খিঁচোনো বন্ধ করে দিব্যি সোনা মুখ করে খেয়ে নেয় কলা মুলো। তারপর একটা পাতা বা কাঠি চিবোতে চিবোতে অন্য বাঁদরের ল্যাজে পাক দেয়, উকুন বাছে।
        লোকগুলোর মধ্যে বাঁদর খেলা দেখায় কেউ। কেউ হাত দেখে। বনে বাদাড়ে ঘুরে মৌচাক ভেঙে মধু বেচে কয়জন।কেউ আবার  মাজা ব্যথার তেল আর কিসব শেকড় বাকড় বেচে। মেয়েরা ইঁদুরের গর্ত থেকে ইঁদুর মারে। বন বাদাড় ঢুঁড়ে কচুর শাক আর কন্দ খুঁড়ে তোলে।পোলতার খাল থেকে তুলে আনে চুনো মাছ,গুগলি ও ঝিনুক। ময়লা জামা পরা ছোট ছেলে মেয়ে মায়েদের সাথে শুকনো কাঠ পাতা কুড়োয়।দিন শেষে রান্না চাপে। খোলা উনুনের চারপাশে আগুন পোহায় সবাই। রেডিও বাজে।
        আবার মাস দু তিন পরে যখন তাদের থাকাটা সকলের অভ্যাস হয়ে পড়ে ; তখন শীত শেষের এক সকালে দেখা যায় মাঠ ফাঁকা। রাতারাতি ঝুপড়ি উঠিয়ে সব নিয়ে তারা কোথায় যেন চলে গেছে।
        মাটির ঢেলার উনুন, বাঁশ পোঁতার গর্ত শুধু হাঁ হয়ে আছে। ওরা হলো ভবঘুরে  বলাবলি করত বড়রা এক জায়গায় ওদের মন দাঁড়ায় না।
      কোথা থেকে আসে ওরা, কোথায় আবার চলে যায় কেউ তা জানে না। ঝিনি ভাবে রাত্তির মানেই কি তাইলে ভবঘুরেদের আস্তানা?সারাদিন ঘুরতে ঘুরতে যারা ঢুকে পড়ে কালো তাঁবুতে আর যে কোন রাতের গায় ঠেস দিয়ে ঝিমোয়?নোংরা জুতোসমেত  ওরা পা ছড়িয়ে দেয় প্রান্তরে।স্বপ্নে ঘুমন্ত মুখগুলি জ্বলে ওঠে দূর আকাশে।ভাগাড়ের মাঠে নেশার ঘোরে হেসে ওঠে কারা।
      গরম ভাত আলুভর্তা দিয়ে ভরপেট খেয়ে যেন গান গাইছে একদল যাযাবর মানুষ; কুয়াশায় শিস দিতে দিতে খচ্চরের পিঠে বোঁচকা উঠিয়ে  পেরিয়ে যাচ্ছ লম্বা  রাত্তিরের ক্যারাভান।হাত নেড়ে হালকা হাওয়ায় যেন ভেসে পড়ে পিঠে বাঁধা কালো তাঁবুর জাহাজে।
         ঝিমুনি কেটে সোজা হয়ে বসলো সে আবার।
     পোস্ট আপিস থেকে মা ফিরে এল। কেমন কুঁচকে থাকা ঘোঁচামোঁচা এক শাড়ি পরা। চোখদুটো বসে গেছে। গলা ভাঙা। রুবিদি তাড়া দিয়ে সবাইকে চানে পাঠালো এক এক করে।সর্ষের তেল আর নুন কাঁচা মরিচ আলু বেগুন ভাতে দিয়ে ভাত বেড়ে খেতে ডাকে।  
      বেলা তিনটের সময় ছেলেপুলে নিয়ে ভাতের থালার সামনে বসে ফের ডুকরে উঠল মা।খাতি তো অবেনে মাসি।ওরম ওরলি ওরাই বা খাবেনে কেম্বায়? খুব নরম করে রুবিদি মাকে বলল। ভেঙে পড়া বাড়ির অভিভাবক হয়ে উঠেছে সে একাই।
পরদিনই রাঙা মেসোকে নিয়ে হেম এলো কলকাতা থেকে। আর মেসোকে নিয়ে মা বসিরহাট জেল, কোর্ট, উকিল এইসব দৌড়োদৌড়ি করতে লাগল।
       ঝিনি আজকাল বায়না করে না,ভাত ছড়ায় না।ডালভাত নিরিমিষ খেয়ে নেয় চুপ করে।দাদারাও শান্ত।মা বাড়ি না থাকলেও তাকে জ্বালায় না। নিজের ইস্কুল আর তাদের বাবার জন্য নানা দিকে ছুটোছুটি করে মা বাড়িতে থাকার সময় পায় না মোটে।কখনো দুতিন দিন কলকাতা থেকে যেতে হলে মা হেমের শ্বশুরবাড়িতেই থেকে যায়। রাঙা মেসোও খুব ছুটোছুটি করে মার সঙ্গে। জামিন, উকিল, রাজনৈতিক বন্দী এইসব অচেনা শব্দরা ঘোরাঘুরি করে তাদের বাড়ির ছায়া ছায়া ঘরবারান্দায়।
    বাবার সঙ্গে যেদিন দেখা করতে দেয় তার আগে থেকেই মা গুছিয়ে নেয় তাদের বাবার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
             রাতে তার কান্না পায় বিশেষ করে মা কলকাতা থেকে গেলে সে মা'র একখানা শাড়ি দুহাতে জড়িয়ে চুপ করে শোয়। কখনো রুবিদি গল্প বলে বলে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়।সে দেওয়ালের দিক ফিরে শুয়ে শুয়ে ফোঁপায়।কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়েও পড়ে।বাড়ি থাকলে সন্ধেবেলা মা মাস্টার মশাইয়ের কাছে দাদাদের সাথে তাকে পড়তে  বসিয়ে শোবার ঘরে  রেডিও চালিয়ে খবর শোনে। 
         সেদিনকার পর থেকে অবশ্য ঝিনি আর জিজ্ঞেস করেনি  তাদের বাবা কোথায় গেছে,কবে ফিরবে। সত্যি বলতে এই ব্যাপারে সে একেবারেই চুপ। আসলে কথা বলতে গেলেই  মস্ত ঝুঁটি আর লাল জিভের কী একটা রাগী জন্তু তার বুকে এমন চেপে বসে ভয়ে গলা শুকিয়ে যায়। মস্ত জন্তুটা কবে থেকেই থাবা গেঁড়ে  তাদের  বাড়িতে বসে আছে আর লাল দলমলে ঝুঁটি নেড়ে সবসময়ই কী যেন চিবোচ্ছে। যে কোন সময়েই লাফ দিয়ে চড়ে বসে তার ঘাড়ে।এত বড় আর খড়খড়ে প্রাণীটাকে ঠেলে নামাতেও পারে না।নিজের মধ্যে খুব জোর দৌড় দিয়ে সেটাকে সে এড়াতে চায় সবসময়। বাপির প্রসঙ্গ উঠলেই দৌড়ে  তাই পালিয়ে যায় সে। কতদূর গেছে তাদের বাবা? পৃথিবীর শেষ দূর অবধি সে ছুটে যায় মনে মনে অথচ তার কাছে ঠিকানাবিহীন সেই দূরত্বের কোনো সীমা নেই বলেই এত ভয় লাগে!
        তবু কান চেপে রাখলেও  কথার টুকরো  ঢুকে যায় কানে। কথারা গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে ঢোকে মাথায়।এই যেমন রাঙা মেসোর সঙ্গে মা'র আলোচনায় সে শুনতে পেল দুমাস পড়েই ছেড়ে দেবে বাপিকে।
      জষ্টি মাস তো পড়ে গেল,হেম বলছিল রুবিদির সাথে রান্না করতে করতে; ডেটের পর ডেট ফেলছে। এদিকে জামাইবাবুর মাইনেও বন্ধ। যতবার ডেট ফেলবে টাকা পয়সা তো উকিলের পকেটেই ঢুকবে। দিদি একা হাতে কত চালাবে?  বাচ্চাগুলোর দিকে তাকানো যায় না।
 দুদিন হলো হেম এসেছে। বাপির সাথে দেখা করে  ভালো খবর আছে বলে মেসো মাংস কিনে এনেছে হাটখোলা থেকে।কতদিন তাদের বাড়িতে মাংস রান্না হয়নি।
       আয় দেখি গায় সাবান দিয়ে দি' বলে মা তাকে কলপাড়ে নিয়ে যাচ্ছে কতদিন পর। মার হাতের শাঁখা আর ব্রোঞ্জের চুড়ি ঢলঢল করছে। তাকিয়ে দেখলো ইট চাপা দেওয়া ঘাসের মতো মার রোগা মুখে রোদ এসে পড়েছে। তোমাকেও সাবান মাখিয়ে দেই মা? অবেনে। তোমারে আর কত্বাত্তি অরতি অবে না।মাসির পিটে ধুন্দুলের ছোবড়া দে সাবান ডলে দেবানে আমি। মূর্তিমতী রসভঙ্গ রুবিদি এসে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো।মা তাকে ছাড়িয়ে দেবে বলেছিল।
      এখন তো টানাটানির সময়।দেখতেই পাচ্ছিস। আবার সময় এলে তোকে নিয়ে আসব। তোমার কাছে মাইনে চাতিছি আমি? তুমি তো ইস্কুল কলকেতা বসিরহাট চাদ্দিক বাড়োয় নে বেড়াতিছ।এই মাইয়েডারে দেকপা কেডা? হাতে আমার কুড়িকুষ্ট হয়নি যে ওগে দুটো ভাত রান্ধে দিতি পারব না।তুমি কলিউ এই বেপদে ছোড ছোড ছলপল ছাড়ে আমি যাবনানে।তোমাগের ছাড়ে আমি যাবই বা কোয়ানে ?
             তোর মাকে কী বলব আমি?মারে আমি কোয়ে দেবানে। ওগের ব্যাপার আমি বোজবানে তুমি এটটু খালি নিজের শরীলের দিক তাকায় দ্যাহো দেহি। না খাইয়ে, ঘোম না পড়ে ,কানতি কানতি আ্যম্বায় নিজেরে শ্যাষ কততিছো তোমার কিছু হলি ওগে কী অবেনে কতি পারো?  সোমসারে কিছুই তো অততি পাততিছি নে তেউ ছেমড়িডারে দেহি, ছলদুডোরে রান্ধে দেই , গতরখান দে  যদ্দুর পারি। তোমারে মাসি মানা অরতিছি কলাম।এইডা নিয়ে চেন্তা অইরো না। রুবিদি যেন মায়ের মা এমন করে গায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল।মা আর রুবিদির চোখ দিয়ে জল পড়ছে দেখে সে দৌড়ে ঘরে গিয়ে বিছনায় উপুড় হয়ে পড়ে।
       বাপি আসার খবর পেয়ে আজ রুবিদিও ছুটে ছুটে কাজ করছে।হেমের রান্নার গন্ধে বাড়ি ম ম। অকারণে দাদারা হাসছে আবার। লাল ফিতে বেঁধে রোববার ক্যালেন্ডার থেকে নেমে বেড়াতে এসেছে যেন তাদের বাড়িতে আজ। নাঃ!মন বসছে মোটেও বই বন্ধ করে ছোড়দা বলল।চান করি গে।অংক খাতা থেকে মুখ তুলে তাকাল দাদামণি। মাংসের গন্ধেতো আদ্দেক খাওয়া খেয়েইছিস। তুইও চল পুকুরে ডুব দিয়ে এসে বাকিটাও সেরে ফেলি। 
 বুঝলি অরু,বাপি আসলে  কুড়িটা করে মাছ খাব।পাবি কোথায়? মিলেঙ্গা মিলেঙ্গা।লেকিন কাঁহাসে মিলেঙ্গা?একলাই ছিপ দিয়ে ধরেঙ্গা। ছোড়দা নিজের রোগা বুকে গুমগুম করে কিল মেরে নিল আনন্দে।
      কালবেলা এভাবেই কাটে তাহলে? বুকের ওপর পা ফেলে ফেলে সে হেঁটে যায় দারুণ অহংকারে।আর বুক চেপে মুখে কাপড় গুঁজে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে তার হেঁটে যাওয়া রাস্তায়। মরতে মরতে অপেক্ষা করে ক্ষীণ এক আশা নিয়ে।কোনো একদিন সুসংবাদ আসবেই।আর এভাবেই হঠাৎ একদিন টান মেরে খুলে ফেলে সব দোরকপাট। ভ্যাপসা জামাকাপড়ের মতো মন আর পুরোনো ঘরদোরে রোদের গন্ধ লেগে যায়।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments