জ্বলদর্চি

ইস্কুল ফিস্কুল/ পর্ব -৫ /সৌমেন রায়

ইস্কুল ফিস্কুল 

পর্ব -৫ 

সৌমেন রায়

চিত্র – অসিত কুমার সেনাপতি  

মালিনী লো সই 

খাঁচাটি  তো সোনার হয়েছে, পাখিটির কি হয়েছে ? মাননীয় কৌশিক বসু মহাশয় একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষা কেমন হওয়া উচিত। যা কিছু যন্ত্র পারে তা  আর মানুষের করার দরকার নেই।তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষা এখন অচল।এখন শেখাতে হবে কি করে ভাবতে হয়, কি করে নতুন কিছু তৈরি করতে হয়, আবিষ্কার করতে হয় ,সমস্যার সমাধান  করতে  হয় এই  সব। মাননীয় কৌশিক বাবুর বক্তব্য নিয়ে সন্দেহের  অবকাশ নেই।  সত্যি  এখন  আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয় কাহিনি থেকে সফটওয়্যার ল্যাঙ্গুয়েজ বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স শেখা বেশি জরুরী।কিন্তু স্যার যদি শেখা টাই না হয়, পড়তেই না পারে তাহলে কি করা যাবে ? এ এস ই আর ( ASER ) রিপোর্ট দেখলে খানিক আন্দাজ করতে পারা যায়  কিরকম চলছে  শিক্ষা  জগৎ। পূর্ববর্তী ক্লাসের পাঠ্য সহজ গণিত, বাংলা রিডিং, ইংরেজি শব্দ পড়তে পারা ছাত্র-ছাত্রী, হিসাব করতে পারে এমন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা সব ক্ষেত্রে ফিফটি পার্সেন্টের আশেপাশে। মাপজোক করতে পারে আশি  শতাংশ ছাত্র ছাত্রী। কিন্তু মাপটি শুন্য থেকে শুরু না করে অন্য কোন স্থান থেকে শুরু করলে এক  লাফে  সংখ্যাটা নেমে আসে  চল্লিশ শতাংশে। এমনই সব নানা রকম নিদ্রাহর  তথ্যে ভরা সমীক্ষা রিপোর্ট। এসার রিপোর্ট নিয়ে বিশদে আলোচনার প্রয়োজন নেই। যে কেউ অন্তর্জালে দেখে নিতে পারেন। আমরা বরঞ্চ দেখি সাদা চোখে কি দেখা যায়। এ স ই আর রিপোর্টে পশ্চিমবঙ্গের একটি মাত্র জেলার  ( এই বৎসর কোচবিহার) তথ্য আছে। কিন্তু সাদা চোখে,  সাধারণ বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে যা দেখা যায়  তা আরও ভয়াবহ। উচ্চ প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত এমনকি তার উপরেও অনেক উঁচু  ক্লাস পর্যন্ত অনেকেই যুক্তাক্ষর বিহীন রিডিংও পড়তে পারে  না। সাধারণ যোগ-বিয়োগ পারেনা। মোটামুটি পনের শতাংশ ছেলে মেয়ে পড়ে, পরের পনের শতাংশ চেষ্টা করে, তারপরে  পনের শতাংশ পড়া পড়া খেলে। বাকি প্রায় পঞ্চাশ শতাংশের সঙ্গে পড়াশোনার  তেমন কোনো যোগাযোগ নেই। কিছু না জেনে, না পড়েই পরবর্তী শ্রেণীতে উঠে যায়। এমনকি বিদ্যালয়ের মুখ না দেখে, ঠিক  মত  নাম  সই করতে না পারলেও মাধ্যমিক পাস করতে পারে। কিভাবে তা ক্রমশ বোঝা  যাবে। অথচ দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এ সমস্ত শিশুরা কেউ জড়বুদ্ধি সম্পন্ন নয় । তারা যথেষ্ট চালাক চতুর। কিন্তু তা সত্বেও শিখতে পারছে না। যথাযথ পূর্ব জ্ঞানের অভাব পড়াশোনা ব্যাহত করে সবাই জানে। উচু ক্লাসে অনুপাতের অংক শিখিয়ে দিলেও সে অংকের শেষে গিয়ে গুন- ভাগ-নামতা   লাগবে। তা  না জানলে কি করে সম্ভব ?  কেউ  যদি গড় গড়  করে রিডিং পড়তেই না পারে তাহলে বিষয় শিখবে কি করে ? তার সমস্ত শক্তি তো ব্যয় হয়ে যায় রিডিং পড়তে । ফলে এই সমস্ত স্টুডেন্টরা ধীরে ধীরে স্কুল ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। স্কুলে আসে  অনিয়মিত। সরকারি সুবিধা গুলি নেওয়ার জন্য ক্লাসে  আসে। এলে গোলমাল করে। কারণ পড়ানোর বিন্দু বিসর্গ সে জানে না। তাহলে পাঁচ ঘন্টা কিভাবে চুপ করে  বসে থাকবে ?  তারা সারা বছর ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা   স্কুলে ব্যায় করছে কিন্তু শিখছে না। একটা গড় হিসাব  করা  যাক। প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত  দশ  বৎসর একটি  স্টুডেন্ট  স্কুল  আসে। ধরা  যাক  বছরে দুশো দিন  স্কুলে  ক্লাস হয়। ছেলেটি যদি মাত্র ফিফটি পার্সেন্ট উপস্থিত হয় ।দৈনিক পাঁচ ঘন্টা ক্লাস হলে সে গড়ে পাঁচ  হাজার ঘন্টা স্কুলে বসে থাকে। কিন্তু কিছুই শিখতে পারেনা ।  মালিনী লো সই সারা রাতি ফুল কুড়ালি, পয়সা পেলি কই!

🍂
আরও পড়ুন 👇
স্কুল শিক্ষার সবচেয়ে বড় দিক হল আত্মবিশ্বাস  অর্জন, আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদার বোধ  বিকশিত করা। সেটা কি হচ্ছে? প্রসঙ্গক্রমে একটা গল্প বলা যাক। গল্পগুলি প্রচলিত। সব ক্ষেত্রে সত্য নয়, তাই গল্প হিসেবে নেবেন। এক স্কুলের রেজাল্ট দেখতে এসেছেন স্কুলের সেক্রেটারি (এখন এই পদটি প্রেসিডেন্ট হয়েছে) প্রধান শিক্ষক তাকে ফলাফল বললেন,  রেজাল্ট  তো মোটামুটি হয়েছে কিন্তু  এগ্রিগেটে কম। সঙ্গে সঙ্গে সেক্রেটারি জানতে চাইলেন    এগ্রিগেট   বিষয়টা কে পড়ান। এখন  এই  এগ্রিগেট পড়ানোর জন্য  যেমন শিক্ষক থাকে না তেমন আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা , আত্মসম্মান পড়ানোর শিক্ষক থাকে না । এগুলো প্রকৃতপক্ষে শেখানো যায় না । বিদ্যালয়ের পাঠক্রমের মধ্যে, সহপাঠক্রমিকের মধ্য দিয়ে ছাত্রছাত্রীরা তা অর্জন করে।এখন সেই পাঠক্রম ই যদি সে পড়তে না পারে, সহপাঠক্রমিক গুলো যদি উৎসব হয়ে ওঠে তাহলে সেসব অর্জন করবে কোত্থেকে? তাই স্কুল শিক্ষা এগুলো বাড়ায়  না তো বটেই বরং আত্মবিশ্বাসকে দুমড়ে দেয়। কারণ ক্রমাগত তাকে  চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো  হয়  যে  সে কিছু পারে না। সেই কারণে দেখবেন খানিক পড়াশোনা করে বেশিদূর যেতে না  পারা   ছেলেমেয়েরা কোন কাজই ভালোভাবে করতে পারে না। বরং অশিক্ষিত, স্কুল না যাওয়া লোকেরা জলের কল সারায়, ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করে বেশ দক্ষতার সঙ্গে।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অনেক ছেলেমেয়ে তো বেশ ভালো ফল করে। বিশেষ করে একাডেমিক লাইনে তো ভালই সাফল্য পায় বলে শোনা যায়। না শিখলে কি করে সম্ভব? কেউ শেখেনা এমন নয়। তবে যারা শেখে তাদের বেশিরভাগ সম্পন্ন বাড়ির, অন্তত মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এদের সচেতন অভিভাবক। এরা যেকোন মূল্যে সন্তানের জন্য শিক্ষা কিনতে পারে।  হাতে ধরে, বুক দিয়ে সন্তানকে আগলে শিখিয়ে নেয়। এই স্টুডেন্টদের অনেকেই বাইরে গেলে আর ফেরেনা। থেকে যাওয়াটা হয়ত বা স্বাভাবিকও। দুজন ডাক্তারের বয়ান শুনলে হয়ত উপলব্ধি হতে পারে। এক অভিভাবকের সন্তান মেধাবী। বিদেশে গবেষণার সুযোগ মিলেছে। কিছু প্রয়োজনীয়  প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা ও হেলথ চেক আপ করতে ছেলেকে নিয়ে দুটি ডাক্তারের কাছে তাকে যেতে হয়েছিল। একজন সরকারি হাসপাতালের, আর একজন কলকাতার প্রখ্যাত বেসরকারি হাসপাতালের। ছেলে বিদেশ চলে যাচ্ছে সেই কষ্টের মধ্যেও পাশে দাঁড়িয়ে  বাবা শুনেছিলেন দুজনেই ছেলেকে পরামর্শ দিচ্ছেন,’ এ দেশে আর ফেরার দরকার নেই। পশ্চিমবঙ্গে তো কোনভাবেই ফিরে এসোনা’। যে কথাটা হচ্ছিল সেটা হল যাদের হচ্ছে তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফসল, সিস্টেমের নয়।

          আশ্চর্যের বিষয় হল যারা এই পাঠ বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে তারা সকলেই দরিদ্র বাড়ির সন্তান। দরিদ্র বাড়ির লোকেরা চায় তাদের  সন্তান লেখাপড়া শিখুক। কারণ তার নিজের হতমান জীবনে একমাত্র আশার আলো  ছেলে মেয়ের স্কুল ব্যাগটি। তারা বহু কষ্টে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনে দেয়, টিউশন দেয়। কিন্তু কিছু হয় না। কেন হয় না? ভগবানও কি বেছে বেছে বোকা বোকা ছেলেগুলোকে গরীব বাড়িতেই পাঠান? যে চাষী জাতির মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছে তার ছেলের পড়ার ভার রাষ্ট্র নিতে পারছে না কেন? সেই তো বিদ্যালয় ব্যবস্থার জন্য পয়সা যোগাচ্ছে। নিজে কঠোর পরিশ্রম করে দিনান্তে  তিনশ  টাকা রোজগার করছে কিন্তু ঝকঝকে বিদ্যালয়ের টাকা সেই দিচ্ছে। প্রতিদিন  প্রতি শিক্ষকের   হাতে  গড়ে  দেড় দু হাজার টাকা তুলে দিচ্ছে বেতন হিসেবে। এমন কি ছুটির দিনও বাদ যাচ্ছে না। তাও তার সন্তান লেখাপড়া শিখছে না কেন ? এসব  প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার লোক তো দূরের কথা প্রশ্ন করার লোকটিও  পাওয়া দুষ্কর। কারণ এই সংক্রান্ত আলোচনা খুব একটা ‘আকর্ষক’ নয়। তার চেয়ে আপনি শিক্ষা নীতির কথা বলুন, মিড ডে মিল বা তার দুর্নীতির কথা বলুন, নিয়োগ  দুর্নীতির কথা  বলুন, দিদিমণিদের পোশাকের কথা  বলুন অনেক অনেক মতামত পাবেন। আর কেউ  যদিবা  এই ‘ বাজে প্রশ্ন’ করেও দেন তাহলে   সরকার সহ স্কুলের চৌকাঠ না মাড়ানো  মদ্যপ বলাই  পর্যন্ত সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে মাস্টার মাস্টার, মাস্টার, মাস্টার । আমাদের স্বভাবই হলো সাফল্যের নেপথ্যে একজন, মাত্র একজন মহান ব্যক্তি খুঁজে বের করা, আর তার গলায় মালা দিয়ে নাচানাচি করা। অথবা  ব্যর্থতার একটা  স্কেপগোট জোগাড় করে তার ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে  দেওয়া। এখানে মাস্টার সেই বলির পাঁঠা। ভাবখানা এমন সব ঠিক ছিল; দীপ ছিল, শিখা ছিল শুধু মাস্টার ব্যাটার  অনীহাতে  আলো জ্বলল না।

                      অনেকে  আবার স্কুলে পড়তে পারেনা কিন্তু মোবাইল চালানোতে দক্ষ। যথেষ্ট সুন্দর রিল বানাতে পারে। ইউটিউবার হয়ে দুই পয়সা রোজগারও করছে। তার তো স্কুলের শিক্ষাটা লাগেইনি। তাহলে কি স্কুল শিক্ষা খুব দরকার?  সন্দেহ জাগতে বাধ্য। মোবাইল চালানো, ইউটিউবে ভিডিও বানানো এগুলো খানিকটা ব্যবহারিক শিক্ষার মত। যেমন আদিম মানুষ ব্যবহারিক প্রয়োজনে বিভিন্ন জিনিস নিজে নিজেই শিখে নিত। এই ধরনের যুক্তিবোধ মানুষের সহজাত । কিন্তু প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে যুক্তিবোধ লাগে তা পড়াশোনার অভ্যাস, গণিত চর্চা, ভাষা চর্চা, বিজ্ঞান চর্চা, সমাজ বিজ্ঞানের চর্চা, খেলা, হাতের কাজ ইত্যাদির মাধ্যমে গড়ে ওঠে। এটাই স্কুল শিক্ষার কার্যক্রম। যা তাকে পেশার বিভিন্ন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।যদি  ইউটিউব দেখে শিক্ষা, না পড়ছে তো কি রিল তো বানাতে পারে এটাকে মডেল হিসেবে ধরা হয় ( যা অনেক বুদ্ধিজীবীও এখন বলছেন) তাহলে যে সর্বনাশটা হবে তা হল এই শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ জীবনে দ্রুত তাদের স্বাধীনতা হারাবে। কুক্ষিগত হয়ে যাবে অন্যের। প্রভাবিত হবে অন্যের দ্বারা। নিজে প্রশ্ন করা, বিচার বিবেচনা  করার শক্তি গড়ে  উঠবে  না। জীবনটা চল্লিশ সেকেন্ডের রিলে বাঁধা পড়ে যাবে। শিক্ষার উদ্দেশ্যটাই সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ হবে। নতুন করে নতুন ধরনের এক দাস যুগের সূচনা হবে। হবে নয় হওয়া শুরু হয়েছে। অন্ধকার চারিদিকে  ঘনায়মান।

And the darkness

 falls from the wings of night,

As a feather is wrafted downward

From an eagle in his flight

                           আচ্ছা তাহলে যে শিখতে পারছে না  তার জন্য সত্যি কি মাস্টারই দায়ী?  হলে কি একমাত্র দায়ী ? চোখের সামনে এমন একটা ভয়াবহ ব্যপার ঘটে চলেছে সমাজ চুপ কেন ? সরকার চুপ কেন? মারাত্মক ভয় অনিদ্রার জন্ম দেয়। আবার ক্ষেত্রবিশেষে তা  নিদ্রা আকর্ষণও করে। ছোটবেলায় একানড়ের গল্প বললে মারাত্মক ভয়ে যেমন শিশু ঘুমিয়ে পড়ে সমাজও কি ঘুমিয়ে পড়েছে? যারা এই ব্যবস্থার মধ্যে শিখছে তারা কিভাবে শিখছে? ছাত্র, অভিভাবকের ভূমিকাই বা কি? এসবের কোন চটজলদি উত্তর নেই।  সমস্যাটি অনুধাবন করা এবং করানো এই ধারাবাহিক কথকতার উদ্দেশ্য।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

4 Comments

  1. AnonymousJuly 09, 2024

    Parbo-5 by Mr Soumen Roy is also a unique creativity like 24 Carat Gold, go ahead with creativity like this...., regards, Sirajuddin Bhunia

    ReplyDelete
  2. সোমনাথ মুখোপাধ্যায়July 24, 2024

    এই পর্বটিতে বোমাটা ফেটেছে। ছয় পর্বের খোঁজ নিই।

    ReplyDelete
  3. নির্মাল্য ঘোষOctober 10, 2024

    কুড়ি কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে গেলে সেই দুই জায়গার মানুষের মধ্যে কথায় কাজে, তাদের দিনযাপনে কিছু না কিছু তফাত ঠিক বেরিয়ে পড়ে তবুও সবাইকে একই সব বিষয় নিয়ে ঘাড় গুঁজে পড়তে হবে। এই প্রহসনে শিক্ষা নাই তাই সমাজের সকল ছেলেমেয়েদের শেখার কোন দায় নাই।

    ReplyDelete