জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব- ২৬/স্বপন কুমার দে

চিত্র- শুভদীপ ঘোষ
এক মুঠো রোদ
পর্ব- ২৬

স্বপন কুমার দে

আজ রেজাল্ট বেরিয়েছে। এম এস সি ( ম্যাথ) ফাইনাল সেমিস্টারের রেজাল্ট দেখে মল্লিকার মধ্যে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল না। শুধু দেখল রেজাল্ট লিস্টে তার নামের আগে দুজনের নাম আছে। কুশল চক্রবর্তী, শ্রীমন্ত সরকার আর নাইনটি ফোর পার্সেন্ট পেয়ে তিন নম্বরে আছে চন্দ্রমল্লিকা সামন্ত। ইউনিভার্সিটিতে মার্কশীট আনতে গিয়ে দেখা হল সব সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে। হালকা কুশল বিনিময়, শুভেচ্ছা যেমন হয়, সবই হল। মল্লিকা দেখল, যারা এতদিন তাকে বস্তির মেয়ে বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে এসেছে, আজও তারা তার থেকে দূরে সরে আছে,তবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে নয়, তাচ্ছিল্য করা চলে না, তাই। তারা কেউই মল্লিকার নাম্বারের ধারে কাছে নেই।

ক্লার্ক ব্যানার্জিবাবুকে হঠাৎ দেখা গেল তাদের ডিপার্টমেন্টের দিকে আসতে। কেউ কেউ যেচে তার সঙ্গে কথা বলল। তিনি সবার দিকেই এক নজরে দেখে নিলেন। ডিপার্টমেন্টের নোটিশ বোর্ডে একবার চোখ বোলালেন তারপর সোজা ঢুকে গেলেন এইচ ও ডি'র ঘরে। মল্লিকার মুখোমুখি হলেও তার প্রতি বিন্দুমাত্র কৌতূহল দেখালেন না।

মল্লিকা এখন অভিরূপের সঙ্গে কথা বলছে। অভিরূপের মধ্যে কেমন একটা লজ্জা লজ্জা ভাব। মনে হচ্ছে যেন মল্লিকার কাছ থেকে চলে যেতে পারলেই বাঁচে। মল্লিকা বলে, "এবার কী করবি?"
" ভাবছি বি এড করে নেব।"
" পি এইচ ডি  করবি না?"
" না, তা হয়তো হবে না। বাবা রিটায়ার্ড করেছে। একটা চাকরির দরকার। বি এড করলে এস এস সি-তে বসতে পারবো। তাই, এখানেই ইতি। তুই কী করবি ভাবছিস?"
" চাকরি তো আমারও খুব দরকার। কিন্তু আমি ভাবছি আগে পি এইচ ডি করবো, তারপর না হয় কলেজ সার্ভিসে বসবো।"
" আগাম অভিনন্দন রইল মল্লিকা। তোর স্বপ্ন সফল হোক।"
" এইজন্যই তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর কেউ না বুঝুক, তুই আমাকে ঠিক বুঝবি।"
" এই বন্ধুত্ব আর কতদিন? এরপরই তো আউট অফ সাইট আউট অফ মাইন্ড। আর হয়তো দেখাই হবে না।"
মল্লিকা অভিরূপের বেদনা বুঝতে পারল কিন্তু প্রকাশ করতে পারল না। শুধু হেসে বলল," দেখা হবে না মানে, তোর বিয়েতে পেট পুরে খেয়ে আসবো। নেমন্তন্ন করতে ভুলবি না কিন্তু।"
উত্তরে অভিরূপের মুখ থেকে একটা মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়ল।

🍂

হাতে মার্কশীট পাওয়ার পর যে যার নম্বর মিলিয়ে মিলিয়ে দেখতে লাগল। মল্লিকাও দেখল। এরপর তাকে যেটা করতে হবে, এম এস সি'র মার্কশীট সহ যাবতীয় অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেটের জেরক্স কপি সমেত পি এইচ ডি'র জন্য অ্যাপ্লিকেশন অফিসে জমা দিতে হবে।

অভিরূপ আগেই জানিয়ে দিয়েছে, সে এরপর বি এড পড়বে কাজেই এ বিষয়ে অভিকে আর না বলাই ভালো। সে আজই বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। ঘন্টাখানেক পরেই ট্রেন, তাই তার তাড়া আছে। মার্কশীট নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাইকে টা টা জানিয়ে বেরোনোর উদ্যোগ নিল। মল্লিকা পিছনে ডাকল," অভি "।
" কিছু বলবি?" অভি থমকে দাঁড়াল।
" আবার কবে ফিরবি?"
" তোকে তো বললাম, আর হয়তো আমার আসা হবে না।"
মল্লিকা চেয়ে রইল অভিরূপের দিকে, দৃষ্টি সরাল না। অবশেষে একটু হেসে বলল," ভালো থাকবি। আর মাঝে মাঝে ফোন করে জ্বালাতন করবো, কিছু মনে করিস না।"
" হ্যাঁ, তুইও ভালো থাকবি। কোথায় পি এইচ ডি করছিস, জানাবি।"
" কোথায় আবার করবো, এখানেই। বলছি, তোর ক'টায় ট্রেন? আর একটু থাকলে হয় না।"
" না রে এক্ষুনি স্টেশন পৌঁছাতে হবে। এবার আসি।"
" হ্যাঁ আয়, ভালো থাকিস। টা টা..।"
অভিরূপ চলে গেল। মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা খারাপ লাগা, একটা বেদনা বোধ জেগে উঠল। এত ভালো একজন বন্ধু! একজন সত্যিকারের আপনজন ছেড়ে চলে গেলে যে ধরনের বিষন্নতা গ্রাস করে ঠিক সেই রকমই। যাই হোক, মল্লিকার থেমে থাকলে চলবে না এবার তাকে অফিসে যেতে হবে। অ্যাপ্লিকেশন জমা দিতে হবে।

অফিস থেকে জানতে পারল, এ বছর তাদের ব্যাচ থেকে পাঁচজন পি এইচ ডির সুযোগ পাবে। মল্লিকা সহজেই সেখানে চান্স পেয়ে যাবে। অফিস থেকে ফর্ম নিয়ে ফিলাপ করে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস্ অ্যাটাচড্ করে জমা দিল। জমা দিতে হল আবার সেই ব্যানার্জিবাবুর টেবিলে।

বাড়ি ফিরে দেখল, নিমাইকাকু মল্লিকাদের বাড়ির সামনে অপেক্ষায় আছে তার নিজের রিকশোতে বসে। বোধহয়, সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম পেয়ে গেছল, তাই রিকশোর সিটে বসে বসে ঝিমোচ্ছিল।
" কী ব্যাপার কাকু, তুমি এখানে?" মল্লিকার ডাকে তন্দ্রা কেটে যায় নিমাইকাকুর," ওঃ, তুই চলে এসেছিস। দাঁড়া তোর জন্য একটা জিনিস এনেছি, এই নে।" বলেই একটা মিষ্টির প্যাকেট মল্লিকার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
" এটা কী? কীসের জন্য?"
" তুই সেদিন বললি না, আজ তোর রেজাল্ট বেরোবে, তাই তো দাশুবাবুর দোকান থেকে গরম গরম জিলিপি এনেছি। আমি তো জানি, আমার মেয়ে সবসময় ভালো রেজাল্ট করবে।"
" তার জন্য তোমাকে মিষ্টি কিনে আনতে হবে? কী দরকার ছিল অতগুলো টাকা নষ্ট করার?"
মেয়ের বকুনি খেয়ে নিমাইকাকু চুপ হয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে," এইজন্যই তোর উপর আমার রাগ হয়। তুই শুধু শুধু আমাকে বকিস। তুই যে এত ভালো রেজাল্ট করিস, আমার বুঝি আনন্দ হয় না?"
মল্লিকা এবার না হেসে পারল না," ঠিক আছে, ঠিক আছে। এসো ঘরে এসো। মল্লিকা একটা চেয়ার পেতে নিমাইকাকুকে বসতে দেয়।

একটু পরেই গরম গরম পকোড়া ভেজে মুড়ি মিষ্টি দিয়ে থালায় করে নিমাইকাকুকে খেতে দেয়, নিজেও খায়। খেতে খেতে কত গল্প করে! ছেলেমেয়েদের কথা নাতি নাতনিদের কথা, একে একে সব জেনে নেয় মল্লিকা।
" কাকু, তুমি তো তোমার মেয়ের বাড়ি এক আধবার ঘুরে আসতে পারো। ছেলে বৌমার সঙ্গে দেখা করতে পারো।"
" কখনো সখনো যাই কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। মেয়েকে বলি মাঝেমাঝে আসতে। সেও সংসারের ঝামেলায় আসতে পারেনা।"
" তাই বুঝি তোমার মনখারাপ হলে এই মেয়ের কাছে ছুটে আসো?"
" তুই তো আমার আর একটা মেয়ে রে মা। তোর সঙ্গে একটু দেখা হলেও ভালো লাগে।"
" ঠিক আছে, তুমি আজ রাতের খাবার এখানে খেয়ে যাবে।"
" না রে মা, তুই যা খাইয়েছিস, আজ আর কিছু না খেলেও চলবে। এবার উঠি।"
" যাবে? ঠিক আছে এসো। তবে যদি দেখি, ছাইপাঁশ খেয়েছো তাহলে আর তোমার সঙ্গে কথা বলবো না।"

নিমাইকাকু চলে গেলে রাতের খাবার তৈরি করতে লাগল। আজ এখন তার টিউশন নেই, সন্ধ্যায় পাড়ার বাচ্চাদের নিয়ে পড়াতে বসে। এমন অনেক বাচ্চা আছে, যাদের পড়াশোনার পরিবেশ নেই, দেখাবার কেউ নেই অথবা পড়বার সামর্থ্য নেই। তাদের নিয়ে সপ্তাহে দু'তিনটে দিন বসে। এরজন্য কোনও পারিশ্রমিক নেয় না।

Post a Comment

0 Comments