জ্বলদর্চি

সতীশচন্দ্র দাশ (জাতীয় শিক্ষক, পাঁশকুড়া) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১১৯
সতীশচন্দ্র দাশ (জাতীয় শিক্ষক, পাঁশকুড়া) 

ভাস্করব্রত পতি

তিনি একজন জাতীয় শিক্ষক। তিনি রঘুনাথবাড়ির সতীশচন্দ্র দাশ। আজও তাঁর মননে, চিন্তনে, স্মরণে এবং প্রকাশে শিক্ষাই প্রধান গুরুত্ব পায়। তিনি সকলের কাছে গুরুদেব। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় তাঁর মতো শিক্ষাগুরুর খুব প্রয়োজন। ১৯৯৭ সালে শিক্ষকতা থেকে অবসর নিলেও এখনও কর্মোদ্যোগে ছেদ নেই জাতীয় শিক্ষক সতীশচন্দ্র দাশের। শিক্ষার প্রসারে এখনও ছুটে যান বিভিন্ন স্কুলে, কলেজে, ক্লাবে। বয়সের সেঞ্চুরি ছুঁতে আর বেশি বাকি নেই। কিন্তু তিনি তো লম্বা রেসের ঘোড়া। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মার মতো হুক, পুল, কভার ড্রাইভে ব্যাট করার মতো চালিয়ে খেলছেন 'নড়বড়ে নব্বুই' এর কোঠায়। 

১৯৩২ এর ২২ শে আগস্ট তমলুক ব্লকের পূর্বনূখা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শরৎচন্দ্র দাস এবং মা শৈলবালা দেবী। পরবর্তীতে শরৎচন্দ্র দাস চলে আসেন পুরুষোত্তমপুর গ্রামে। এখানে এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে চণ্ডীমণ্ডপে একটি পাঠশালা খুললেন। যা কিনা এলাকার শিক্ষাবিস্তারে দারুণ ভূমিকা নিয়েছিল সেসময়। শরৎচন্দ্র দাশের উদ্যোগে ১৯১৭ সালে পুরুষোত্তমপুর আংশিক বুনিয়াদি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সতীশচন্দ্র দাশের ছোটভাই জগদীশচন্দ্র দাশ ছিলেন বৈষ্ণবচক মহেশচন্দ্র উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক। জ্যাঠতুতো দাদা যতীন্দ্রনাথ দাশ ছিলেন পুরুষোত্তমপুর আংশিক বুনিয়াদী বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। 
রাষ্ট্রপতি পুরস্কারজয়ী জাতীয় শিক্ষক সতীশচন্দ্র দাশের সাথে লেখক

১৯৪৪ সালে পূর্বনূখা গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক পাঠ শেষ করে পুরুষোত্তমপুরে চলে আসেন। মূলতঃ দাদা যতীন্দ্রনাথ দাশ তাঁকে এখানে নিয়ে চলে আসেন। এখানে এক সম্পন্ন গৃহস্থ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী রবীন্দ্রকুমার মাইতির (যিনি 'বাঘাযতীন' নামে একটি বই লেখার জন্য কারারুদ্ধ হয়েছিলেন) বাড়িতে থাকতেন। নিজের চোখে দেখেছেন সেসময়ের স্বাধীনতা আন্দোলন। ভগ্নিপতি জ্ঞানেন্দ্রমোহন ভৌমিকও ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িত। ভর্তি হন রঘুনাথবাড়ি রামতারক হাইস্কুলে। যদিও পরবর্তীকালে রঘুনাথবাড়ি  ঠাকুরবাড়িতে খেয়ে বিদ্যালয়ে পড়তে যেতেন। পড়াশোনা করে বড় কিছু হওয়ার অদম্য ইচ্ছে ছিল তাঁর মননে। 

পড়াশোনা শেষে কিন্তু অন্য কোনো চাকরিতে যুক্ত হননি। তিনি ১৯৫৫ সালে রঘুনাথবাড়ি আংশিক বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এরপর ১৯৫৭ সালে ঝাড়গ্রাম শিক্ষক শিক্ষণ মহাবিদ্যালয় থেকে বুনিয়াদি শিক্ষণ গ্রহণ করেন। আসলে তিনি ছিলেন স্বদেশ প্রেমে দীক্ষিত এক কর্মঠ যোদ্ধা। তাঁর চিন্তায় প্রতিফলিত হত স্বাধীনতার রুদ্রতেজ। 
রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিংয়ের হাত থেকে জাতীয় শিক্ষকের পুরস্কার নিচ্ছেন সতীশচন্দ্র দাশ

রঘুনাথবাড়ি রামতারক হাইস্কুলে পড়ার সময় নিকট সান্নিধ্যে আসেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সাথে। যিনি ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রত্যক্ষ ছাত্র। কবিগুরু তাঁকে স্নেহভরে বলতেন 'ধী. মু.'। এ প্রসঙ্গে সতীশচন্দ্র দাশ লিখেছেন, 'আমার শিক্ষক জীবন শুরু হওয়ার অল্প সময় পরে অধিক বেতনের সরকারী চাকরির সুযোগ এলে শ্রদ্ধেয় হেডস্যার বলেছিলেন, সতীশ, শিক্ষকতা কর। শিক্ষকতা পবিত্র বৃত্তি। তিনি আরও বলেছিলেন, বিদ্যালয়কে মাতৃজ্ঞানে ভক্তি করো। উনি অন্নদাত্রী মাতা বিদ্যামন্দির। ওই মন্দিরে যারা নৈবেদ্যের ডালি নিয়ে আসছে তাঁদের পূজা যাতে ঠিকমতো হয় সেদিকে নজর রেখো। ওই কাজে যেও না, ও কাজ ভাল নয়। মন দিয়ে কাজ কর, নাম করবে” ইত্যাদি। তাঁর সেই উপদেশ সারাজীবন পালন করার চেষ্টা করেছি এবং তাঁর আশীর্বাদে সাফল্য ও পেয়েছি জাতীয় শিক্ষকের মর্যাদায় ভূষিত হয়ে'। 

শিক্ষকতাই ছিল সতীশচন্দ্রের অন্যতম ধ্যানজ্ঞান। আর তাঁর বিদ্যালয়ই হয়ে উঠে আসল ঘরবাড়ি। বিদ্যালয়কে ভালোবাসার এবং ভালো রাখার কাজের স্বীকৃতিতেই ১৯৮২ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং তাঁকে জাতীয় শিক্ষকের পুরস্কার তুলে দেন। এখনও সেই শিক্ষাব্রতী মনটাকে ছেড়ে দেননি। এই বয়সে এসেও নিজেকে সবসময় শিক্ষাজগতের অন্দরমহলে সজাগভাবে রেখেছেন। 
কাগজ পড়ছেন সতীশচন্দ্র দাশ

সতীশচন্দ্র দাশ শিক্ষকতার পাশাপাশি নানা ধরনের কাজের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। অবসরের পর ২০০৯ পর্যন্ত পাঁশকুড়া ব্লক শিক্ষা সেলের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত জেলার সার্বিক সাক্ষরতা ও রোগ প্রতিষেধক অভিযানে জেলার সম্পদ কর্মী ছিলেন। সাক্ষরতা ও রোগ প্রতিষেধক অভিযানে জেলার সম্পাদকর্মী হিসাবে তিনি প্রশিক্ষণ দিতেন সরকারি ব্যবস্থাপনায়। ২০০২ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত পাঁশকুড়া ব্লক অ্যাকাডেমিক সুপারভাইজার ছিলেন। এই ব্লকের শিশুশিক্ষা কেন্দ্রসমূহের প্রশিক্ষক হিসাবে যথেষ্ট সমীহ আদায় করে নিয়েছেন তিনি। একসময়ে ব্লকভিত্তিক কৃষি ও শিল্প প্রদর্শনীর অন্যতম ব্যবস্থাপক ছিলেন। এছাড়াও পূর্ব মেদিনীপুর জেলার গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যদের প্রশিক্ষককের গুরুদায়িত্বও পালন করেছিলেন। এহেন মানুষটি বুঝেছেন, যথার্থ শিক্ষা দিতে শিক্ষা বিষয়ক নানা গুরুত্বপূর্ণ লেখা সকলের জানা উচিত। তাই তিনি প্রতিদিন প্রচুর সংবাদপত্রের ফিচার স্টোরিগুলি কাটিং করে, জেরক্স করে বাঁধিয়ে বিলি করেন বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে। 

পাঁশকুড়ার রঘুনাথবাড়ি গ্রামে বসবাস করেন। এই ৯৩ বছর বয়সেও তাঁর কাজের কোনো ফুরসৎ নেই। সবসময় নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন কাজের মধ্যে। নিয়মিত পেপার পড়েন, বই পড়েন, লেখালেখি করেন, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যান, বক্তব্য রাখেন। আর নিজের সামান্য পেনশনের টাকায় বিভিন্ন পত্র পত্রিকা থেকে শিক্ষা বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ, প্রবন্ধ সুন্দর করে পেপার কাটিং করে জেরক্স করে বাঁধিয়ে বিলি করেন বিভিন্ন স্কুলে স্কুলে গিয়ে। নিজেই গাড়ি ভাড়া করে চলে যান এগুলো পৌঁছে দিতে। শিক্ষক শিক্ষিকা ছাত্র ছাত্রী ছাড়াও বিভিন্ন ক্লাব, কলেজ, এনজিওতেও বিলি করেন তাঁর এই মহামূল্যবান সম্পদ। এজন্য কারও কাছে সামান্যতম অর্থও নেননা। 

এই বিলি করতে গিয়ে তাঁর পেনশনের অনেক টাকা বেরিয়ে যায়। কিন্তু তবুও তিনি অকপটে করেন। অর্থখরচের হিসেব নিকেশ কখনও করেননি। শুধুমাত্র সকলের কাছে তথ্যগুলো পৌঁছে দিতে তিনি এই পাগলামি করেই চলেছেন। এজন্য কারোর কাছে একটি টাকাও নেননা। এ পর্যন্ত প্রায় দুশোর বেশি সংস্থার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন পেপার কাটিং করা বান্ডিল বান্ডিল লেখা। কোনওটির নাম রেখেছেন 'শ্রমের মর্যাদা', কোনওটির বা 'অমৃতফল', 'অলৌকিক', 'ছেলেবেলা' ইত্যাদি। আসলে তিনি শিক্ষা পাগল। তাঁর পাগলামিতে উপকৃত হচ্ছে আপামর জনসাধারণ। 

তিনি তাঁর কাজের নিরিখে সাংসদ সতীশচন্দ্র সামন্ত, রজনীকান্ত প্রামাণিক, ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, উপেন্দ্রকিশোর সামন্ত রায়, মহন্ত অচ্যুতানুজ দাস, হরেকৃষ্ণ মাইতি প্রমুখদের কাছাকাছি এসেছেন। এঁদের কাছে শিখেছেন জীবনের চলার পথের অনেক মনিমুক্তো। শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে আজও ভাবনাচিন্তা করে চলেছেন সতীশচন্দ্র দাশ। এই চরম সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের কালেও তিনি শিশুদের প্রতি মা বাবাদের বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার কথা বলেন। আজও শিশুদের মানবিক মূল্যবোধের মাধ্যমে শিক্ষিত করে তোলার স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন দেখেন চরিত্রবান নাগরিক গড়ে তোলার। 
সস্ত্রীক সতীশচন্দ্র দাশ

জীবন সম্পর্কে তাঁর একান্ত উপলব্ধি -- 'শিক্ষক জীবন থেকে অবসরগ্রহণের পর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। আজ জীবন সন্ধ্যার একেবারে কাছে এসে দেশ ও সমাজের বাহ্যিক তথাকথিত অনেক উন্নতি যেমন দেখছি তেমনি দেখছি জগৎ ও জীবন সম্পর্কে আমাদের আজন্মলালিত মূল্যবোধ, সৌজন্য, সহবত, শৃঙ্খলা প্রভৃতির চরম অবনমন। যার পরিণতিতে অভাবনীয়, ঘৃণ্য, কুরুচিকর নানা ঘটনার সংঘটনে সমাজ জীবন দুর্বিষহ, অশান্তিতে অসহনীয়।'

দৈনন্দিন দিনচর্যা ও মহাপুরুষদের বাণীসংকলিত 'জীবনের আলো' নামে একটি সংকলনগ্রন্থ প্রকাশ করেছেন তিনি। এখানেই সতীশচন্দ্র দাশের মনের প্রশ্ন, 'সারা জীবনের শিক্ষকতায় যেসব মানবিক গুণের চর্চা করেছি, সেগুলির বর্তমান অবস্থা ভাবিয়ে তুলে আমাকে। মনে প্রশ্ন জাগে, শত শত মহামানবের অমৃতবাণী, ধর্মগ্রন্থের শাশ্বত আদর্শ সবই কি ধ্বংস হয়ে যাবে? বর্তমানের মদগর্বী তথাকথিত সভ্য মানুষ মানবসভ্যতাকে কি আবারও বন্যজীবনের পাশবিক পরিবেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে'?

🍂

Post a Comment

0 Comments