জ্বলদর্চি

স্বাধীনতা দিবস (১৫ই অগাস্ট)/দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে

স্বাধীনতা দিবস (১৫ই অগাস্ট)
দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে

'স্বাধীনতা' শব্দটার মধ্যেই যেন এক আবেগ জড়িয়ে আছে।
স্বাধীনতা হলো, একটি এমন বিশেষণ, যা একটি জাতি, দেশ বা রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে, একটি বিশেষ অবস্থান বোঝায়; যেখানে তাদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা ও আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব থাকবে। স্বাধীনতার বিপরীত হচ্ছে পরাধীনতা। তবে স্বাধীনতা কোনো অর্থেই যা খুশি তাই করা বোঝায় না।
আজ ১৫ই অগাস্ট, আমাদের তথা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবস।
স্বাধীনতা দিবস হলো,ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের একটি জাতীয় দিবস। ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট ভারত ব্রিটিশ রাজশক্তির শাসনকর্তৃত্ব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলো। সেই ঘটনাটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য, প্রতি বছর ১৫ই অগাস্ট তারিখটিতে ভারতে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট রাত বারোটা বাজতে যখন কয়েক মিনিট বাকি, তখন জহরলাল নেহেরু তাঁর বক্তৃতা শুরু করলেন এই লাইন দিয়ে: “At the stroke of the midnight hour, when the world sleeps, India will awake to life and freedom.”এরপর মধ্যরাতের ঘন্টা বেজে উঠলো, এবং ভারতের মাটিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। পরের দিন ১৫ই অগাস্ট সকালে গণপরিষদে রাষ্ট্রীয় যাত্রা শুরু হলো। তারপর সারা ভারতবর্ষে উত্তোলিত হলো জাতীয় পতাকা
১৫ই অগাস্ট ২০২৪ সাল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা দিবসের ৭৭তম বর্ষ। ২০০ বছর ধরে ইংরেজদের কাছে পরাধীন থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে  স্বাধীনতা লাভ করেছিলো।
আমাদের দেশের বহু মহান মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।  আজ তাঁদের জন্যই আমরা ভারতের স্বাধীন নাগরিক।
দেশের, যে বীর সন্তানদের জন্য আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে তাঁদের নাম গুনে শেষ করা যাবে না, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন, ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী বাঈ,নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, ভগত সিং, ক্ষুদিরাম, মাতঙ্গিনী হাজরা, মাস্টারদা সূর্য সেন, সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল, বাল গঙ্গাধর তিলক ও বাবা সাব আম্বেদকর প্রমুখ, এছাড়াও হাজারো হাজারো ভারত মায়ের বীর সন্তান সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে লড়াই করে ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে এসেছেন।
১৫ই অগাস্ট সকালে গণপরিষদে রাষ্ট্রীয় যাত্রা শুরু হলো। তারপর সারা ভারতবর্ষে উত্তোলিত হলো, জাতীয় পতাকা।আত্ম বলিদান দিয়েছে আরও কত নাম না জানা তরুণ তরুণী। এই শুভ দিনে তাঁদের প্রতি আমরা সকলে প্রণাম জানাই।

🍂

আসুন,ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের ইতিহাসের পটভূমি একটু জেনে নিই..

১৭ শতাব্দীর শুরু থেকেই, ইংরেজরা ভারতে আসতে শুরু করেছিলো। তখন ভারতে মোঘল শাসন চলছিলো। যদিও তারা বাণিজ্য করতে এসেছিলো, কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিলো,সম্পত্তি লুট করা। পলাশী এবং বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর ভারতে ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়। শুরু হয় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের নামে শোষণ। ভারতীয়দের শোষণ করে ইংরেজরা দিনে দিনে সমৃদ্ধশালী হতে থাকে। অত্যাচার ও অনাচার বেড়েই চলে। কোনো জায়গার উত্তরাধিকারী না থাকলে, সেই জায়গা ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে চলে যেত। এরপর মঙ্গল পান্ডের নেতৃত্বে সেই ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়। এই আন্দোলনে ব্যর্থ হলে মঙ্গল পান্ডেকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়।
১৮৮৫ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের জন্ম হয়, যা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের বহু শিক্ষিত যুবক “বন্দেমাতরম” ধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকেন। বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব শুরু হতে দেখে লর্ড কার্জন বাংলাকে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। খুব চালাকির সাথে ব্রিটিশ সরকার বাঙালীদের আলাদা করে দেয়। শুরু হয়, বঙ্গভঙ্গ  আন্দোলন। এই সময় বাংলা থেকে উঠে আসে ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, বিনয়, বাদল, দীনেশের মতো সাহসী বিপ্লবীরা, যারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়ে হাসিমুখে আত্ম বলিদান দেন।১৯১১ সালে বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব তীব্র হওয়ায় ইংরেজরা রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত করে। তবুও আন্দোলন থামেনি, বরং আরও তীব্র হতে থাকে। ব্রিটিশ বিরোধী জনমতকে দমাতে রাওলাট আইন পাস করা হয়, যার ফলে কাউকে কিছু না বলেই গ্রেফতার করা শুরু হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় সারা ভারতবর্ষে রাওলাট সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হয়। একসাথে চার জনকে দেখলেই গুলি করা হতো। ১৯১৯সালের ১৩ই এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে বহু মানুষ একত্রিত হয়, আর সেখানে ব্রিটিশ সরকার নির্বিচারে গুলি চালায়। দশ মিনিট ধরে নির্মম হত্যাকাণ্ড চলে, সেখানে প্রায় হাজার জন মানুষ মারা যান এবং সমপরিমাণ মানুষ আহত হন। এর প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশদের দেওয়া 'নাইট' উপাধি ত্যাগ করেন।

হিন্দুস্তান রিপাবলিকান এসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা অস্ত্র কেনার জন্য ১৯২৫ সালে কাকরি নামে এক স্থানে ট্রেন থামিয়ে ইংরেজদের থেকে বহু টাকা পয়সা লুট করেন, যা কাকরি ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত। এরপর ১৯২৯ সালে কংগ্রেস পূর্ণ স্বাধীনতার সিদ্ধান্ত নেয়। ৩১শে ডিসেম্বর নেহেরু লাহোরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর ১৯৩০ সালের ২৬শে জানুয়ারি প্রথম স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার এটি মানেনি। এরপর কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দেন। এই আন্দোলনে সারা দেশবাসী মুক্তহস্তে যোগদান করেন এবং স্কুল-কলেজ অচল হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেস পার্টিকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং ১৯৩২ সালে গান্ধীজিকে বিনা কারণে গ্রেফতার করে। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৩ সালে গান্ধীজী জেল থেকে ছাড়া পান।
এরপর শুরু হয়, সত্যাগ্রহ আন্দোলন। এরপর ভারতবর্ষে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের আগমন ঘটে। তিনি বুঝেছিলেন, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন হবে এবং বহু রক্তের বলিদান দরকার হবে। এরপর তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে নেতাজি বন্দী হয়ে যান, কিন্তু চালাকির সাথে পালিয়ে জাপানে চলে যান। সেখানে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন, যা পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকারকে নাজেহাল করে তুলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর আজাদ হিন্দ বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে। তার লড়াকু মনোভাব আজও ভারতের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
১৯৪২ সালে গান্ধীজি ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু করেন এবং ৯ই আগস্ট তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু এই আন্দোলন থামেনি; আন্দোলনকারীরা মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করেন। ১৯৪৬ সালে মহম্মদ আলী জিন্নাহ আলাদা রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব রাখেন। তিনি চেয়েছিলেন, একটি মুসলিম দেশ, যার শাসক হবে একজন মুসলিম কিন্তু কংগ্রেসের বেশিরভাগ নেতাই এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেননি।  
১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কালে, একদিকে যেমন ব্রিটিশ অর্থব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়ে, অন্যদিকে ভারতবর্ষের অগণিত মানুষেরা স্বাধীনতা লাভের জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। সেই সময়ে ব্রিটিশ সরকার বুঝতে পারে যে, ভারতবর্ষের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকে সামাল দেওয়ার ক্ষমতা ব্রিটিশ সৈন্যদলের আর নেই। চতুর্দিক থেকে চাপের মধ্যে থেকে তারা সিদ্ধান্ত নেয়, ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানোর। তারা ঠিক করে ১৯৪৮ এর জুন মাসে ভারতীয়দের উপর শাসন ব্যবস্থা তুলে দেবে। কিন্তু চতুর্দিকে দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে ভারতের স্বাধীনতার সময়কে এগিয়ে নিয়ে আসে ১৯৪৭ সালের ১৫ই অগাস্ট   দিনটিতে ।
১৯৪৭ সালের ১৫ ই অগাস্ট দিল্লির লাল কেল্লায় ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। সেই থেকে ১৫ই অগাস্ট দিনটিকে ভারতবর্ষের "স্বাধীনতা দিবস" হিসেবে পালন করা হয়। জাতীয় সংগীত গেয়ে এবং পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দেশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়।
এই দিন স্কুল, কলেজ, যে কোন সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি অফিস এছাড়াও সাধারণ মানুষের বাড়িতে- বাড়িতে এমনকি মানুষের হাতে -হাতে 'তেরঙ্গা' দেখতে পাওয়া যায়। ভারতবর্ষের প্রায় সকল জায়গাতেই স্বাধীনতা দিবসটি মহোৎসব হিসেবে পালন করা হয়।
স্বাধীন ভারতের প্রতীক এই তেরঙ্গাটির(ভারতের জাতীয় পতাকা)একটি অর্থ আছে। স্বাধীনতা দিবস পালনের সঙ্গে সঙ্গে এই তেরঙ্গাটিও যেন আমাদের হৃদয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।
জাতীয় পতাকাতে গেরুয়া, সাদা ও সবুজ এই তিনটে রং এবং মধ্যে অশোক চক্র চিহ্নিত আছে।
গেরুয়া রং- যাকে ত্যাগের প্রতীক হিসেবে মানা হয়। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ত্যাগ ও বৈরাগ্য কে আমরা দেখতে পাই।
সাদা রং-যাকে সততা ও শান্তির প্রতীক মানা হয়।
সবুজ রং- যাকে শ্যামলীমা অর্থাৎ প্রাণের প্রতীক মানা হয়।
অশোক চক্র-অনুশাসন ও গতিশীলতার প্রতীক, যা কখনোই থেমে থাকে না।
গতবছরের স্বাধীনতা দিবসের থিমটি ছিলো- 'জাতি প্রথম সর্বদাই প্রথম'।
স্বাধীনতার দিনটিকে জানতে হলে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কথা আগে জানতে হবে এবং জানতে হবে ভারতের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথা।

এই পুণ্য লগ্নে আসুন আমরা শপথ গ্রহণ করি যে, আমাদের দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষার্থে নিজেদের প্রাণ ত্যাগ করতে সদা প্রস্তুত থাকব।

Post a Comment

0 Comments