বাংলাদেশ ভ্রমণ
পর্ব ৮
রোশেনারা খান
সকালে উঠে স্নান সেরে রেডি হয়ে নিলাম। এখানে এক মা তাঁর কিশোরী কন্যাক নিয়ে হুমায়ুন সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসে ছিলেন। তরুণী মায়ের নাম পলাশ। আলাপ হল, ছবি তোলাও হল। হুমায়ুন সাহেব তাঁর একটি কবিতার বই আমার হাতে তুলে দিলেন। ওনার গন্তব্য এই পর্যন্তই।এই কয়েকদিন উনি যেভাবে আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন, তা ভোলার নয়। বিদেশে এরকম আন্তরিকতাপূর্ণ বন্ধু পাব ভাবিনি। কিছুটা ভারাক্রান্ত মনে ওনাকে বিদায় জানিয়ে টোটো ধরে আমরা বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চললাম। এই এগিয়ে চলার নামই জীবন।
বাসে সামনে পিছনে সিট নিয়ে সাকিলের সঙ্গে একটু ঝামেলা হল।কারণ সামনের দিকের চারটি সিটের দুটিতে সাকিল আর গৌতমবাবু বসেছেন, আর দুটিতে সেরিনা আর সাহদাতদা বসেছেন। আমাদের চারটি সিট ওঁদের পিছনের দুটি লাইন বাদ দিয়ে তার পরে। তাতেই বসতে হল, উপায় নেই। গরমে পেয়ারা শসা কিনে ভাগ করে খাওয়া হচ্ছে।দুপুরের দিকে কুষ্টিয়া পৌঁছালাম। সাকিলের এক বন্ধু আব্দুর রশিদ চৌধুরী, দৈনিক বাংলাদেশ বার্তার সম্পাদক আমাদের জন্য কুষ্টিয়ার পুরাতন বাসস্ট্যান্ডে রাতুল নামে একটি আবাসনে রুম বুক করে রেখেছিলেন।আমি দোতলায় রু্ম পেলাম,বাকি তিনটি রুম তিন তলায়। সরস্বতীদি আমার সঙ্গে রুম সেয়ার করতে চাইলে সাকিল আপত্তি জানালেন। বললেন, মায়াদির হাঁটুর সমস্যা। উনি দোতলায় রোশেনারাদির সঙ্গে থাকবেন।
থাকার ব্যবস্থা হওয়ার পর আমরা রোদ্দুর মাথায় নিয়ে রেস্টুরেন্টের খোঁজে বের হলাম। মাছভাত খাওয়া হল। উল্টো দিকে সামনেই একটা ভাল রেস্টুরেন্ট ছিল, তবু কেন এতদূরে আসা হল বুঝলাম না। ফিরে এসে ঘণ্টা দুই রেস্ট নিয়ে আবার রেডি হলাম বেরনোর জন্য।আমরা চললাম লালন ফকিরের সমাধি ও আখড়া দেখতে। পৌঁছে দেখলাম বাঁ দিকে মস্ত গেট, যার ভিতরে রয়েছে লালনের সমাধি। ডান দিকে একটা মস্ত মাঠ সামনের দুদিকে কিছু স্টল আছে, অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের মত। মাঠের এক কোণে মস্ত বড় লালন ফকিরের অবয়ব দেখতে পাচ্ছি।কাছে গিয়ে ছবি তুললাম সবাই, পাশে একটা ঝিলের মত রয়েছে।দু’পাশ অনেকটাই সবুজে ঢাকা। সাকিল নদী বললেও আমার তা মনে হলনা। আমরা এবার লালন ফকিরের সমাধি দেখার জন্য গেটের ভিতর প্রবেশ করলাম।কিছুটা হেঁটে ওনার সমাধি গৃহের সামনে দাঁড়ালাম। তার আগে পাশে থাকা মস্ত এক একতারার সঙ্গে ছবি তুলেছি। লালনের সমাধি গৃহের বাইরের অংশে বেশকিছু সমাধি রয়েছে। এখানে ছবি তোলা বারণ নেই। মূল গৃহে, যেখানে লালন ও তার পালিকা মায়ের সমাধির সঙ্গে আরও কয়েকটি সমাধি রয়েছে, সেখানে ছবি তোলা নিষেধ।তবে দেখতে কোনও বাধা নেই। পাশেই রয়েছে মিউজিয়াম, লালন একাডেমি ও আখড়া। সেখানে বাউল গান চলছে। সরস্বতীদি, সাকিল।,অঙ্কনা, ওরা বাউলকে ঘিরে বসে গলা মেলাতে শুরু করল। আমার খুব রাগ হল। আমি বেরিয়ে এসে স্টলগুলোতে টুকটাক জিনিস কিনলাম। সাকিল বেরিয়ে আসতে খুব বকা দিলাম। কারন আজই শেষ রাত। আমার ফোন কেনার তো সময়ই হল না, একজন কয়েকটা জিনিস নিয়ে যেতে বলেছে, সেটা আজ না হলে হবেই না। কারণ ঠিক হয়েছ কালই আমরা ব্যাক করব। থাক সে কথা, ওরাও টুকটাক জিনিস কেনায় মন দিল।সাকিল আর গৌতম বাবু কিছু জিনিস কিনলেন।
🍂
মার্কেটে এসে সাকিল বলল, ‘চল, কী কিনবে? আমাকে সেল ফোনের সোরুমে নিয়ে গেলে, আমি বললাম কাল ফিরে যাব। আজ ফোন কিনে কী হবে?আমার সর্দিগর্মিতে খুব ঠাণ্ডা লেগেছে, তাই একটা মেডিসিন সপে ঢুকলাম । সাকিলও ওষুধ কিনল। ওখানে ট্যালকম পাউডার দেখে দুটো নিলাম। এরপর গেলাম একটি শপিংমলে। এখানে কেনার কিচ্ছু ছিল না।একজোড়া মুক্তোর টাপ আর বডিসোপ নিলাম।সাকিল মধু কিনল।
হোটেলে আমি সাকিল আগে ফিরলাম। মুখোমুখি সাকিলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আব্দুল রশিদ চৌধুরীর সঙ্গে। উনি দেখা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন।সাকিল ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। সাকিল ওনার জন্য একভাঁড় রসগোল্লা কিনে এনেছিলেন উনিও অনেক মিষ্টি এনেছিলেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়ে ভাল লাগল। কার্ড দিয়ে আমাকে যোগাযোগ রাখতে বললেন। উনি চলে যাওয়ার পর আমাদের বাকি সদস্যরা ফিরলেন। সবাই মিলে মিষ্টি খাওয়া হল। এখানেই বসে ঠিক হল, ১২ টার মধ্যে আমাদের রুম ছেড়ে দিতে হবে। তাই আমরা একেবারে রেডি হয়ে সিলাইদহ যাব। সেইমত আমরা টোটোতে চড়ে রওনা হলাম। প্রথমে ‘বিষাদ সিন্ধু’র লেখক মীর মোসাররফ হোসেনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত স্কুল ও লাইব্রেরি দেখার জন্য এলাম। এই জায়গাটিতেই ছিল মসারফ হোসেনের বসতবাড়ি। সংরক্ষণের কোনও উদ্যোগ না নেওয়ায় বেদখল হয়ে গিয়েছিল।যেখানে বাড়িটি ছিল, সেখান থেকে কিছু জায়গা উদ্ধার করে ১৯৭২ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়। আমরা এখন সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি.১৯৯২ সালে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৯৫ সালে এই মাঠের এক প্রান্তে মীর মসাররফ হোসেন উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। ওনার জন্ম ১৮৪৭ সালে ১৩ নভেম্বর। উনি কুষ্টিয়ার জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। যেখানে মাত্রাতিরিক্ত প্রাচুর্য থাকে সেখানে অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের সম্ভাবনা থাকে বেশি। মসাররফ হোসেনের পরিবারেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।শৈশব ও কৈশোর লেখকের খুব কষ্ট ও মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে কেটেছে।বাবার অবহেলায় মায়ের অকাল মৃত্যু ঘটে, সদ্য বিবাহিতা বোনের ও মৃত্যু হয়। এই সব মানসিক যন্ত্রণা তাঁকে কোথাও থিতু হতে দিচ্ছিল না। শেষে কলকাতায় বাবার বন্ধু জমিদার নাদের হোসেনের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা শুরু করেন।এখানে থাকাকালে নাদের হোসেনের বড় মেয়ে লতিফনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। মোশাররফ হোসেন কে জমিদার নাদের হোসেন চাকরির অফার দেন।দুজনের বিয়েও ঠিক হয়। ইতিমধ্যে অন্য এক জমিদার বাড়ি থেকে লতিফনের বিয়ের প্রস্তাব আসে। তাঁরা পিরের পরিবার ছিলেন। নাদের সাহেব উভয় সঙ্কটে পড়ে ঠিক করলেন,লতিফনের বিয়ে পিরের বাড়িতেই দেবেন।ছোট মেয়ে আজিজনের বিয়ে দেবেন মোশাররফের সঙ্গে।উনি বিয়ে করতে এসে বিয়ের পাত্রী বদলের বিষয়টি জানতে পারেন। প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েও মসাররফ ছোট মেয়েকেই বিয়ে করতে বাধ্য হন।না হলে চাকরিটা হাতছাড়া হয়ে যাবে যে। এই মুহূর্তে ওটারও যে খুব দরকার। তাই অনিচ্ছা স্বত্বেও নাদের হোসেনের ছোট মেয়েকে বিয়ে করতে বাধ্য হন এবং সারাজীবন অসুখী দাম্পত্য বহন করেন। আঘাত না পেলে প্রতিভার বিকাশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয় না।এটা আমরা রবীন্দ্রনাথ নজরুলের ক্ষেত্রে দেখেছি। যাইহোক মোশাররফ শুধু বিষাদ সিন্ধু রচনা করেননি তিনি একাধারে নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক,ই ত্যাদি। তিনিই প্রথম বাংলা রচনাকার বাঙালি সাহিত্যিক। তাঁকে বাঙ্গালি মুসলিম সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ বলা হয়।তিনি১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর পরলোক গমন করেন।
ক্রমশ
0 Comments