জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৬৩ / সালেহা খাতুন

বন্ধ মিলের সামনে শ্রমিকদের অবস্থান

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৬৩ / সালেহা খাতুন 

জীবনটা যেন অমাবস্যা আর পূর্ণিমার মতোই পনেরো দিন আলো আর পনেরো দিন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে পাটশিল্প রুগ্ন শিল্পে পর্যবসিত। তার উপর কানোরিয়ার তো আরো দুরবস্থা। চার মাস চলে তো আটমাস বন্ধ থাকে। নব্বইয়ের দশক থেকেই নানান মুভমেন্ট সেখানে চলছে। প্রফুল্ল চক্রবর্তী এ মুভমেন্টে বিরানব্বইয়ের শেষের দিক থেকে বলা ভালো তিরানব্বই-চুরানব্বই থেকে সক্রিয় ভূমিকা নেন। কানোরিয়ার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে যে মিলটি খোলার থেকে বন্ধ থেকেছে বেশিদিন।

জীবনে যে তিনটি জুটমিলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটেছিল তাদের মধ্যে কানোরিয়া জুটমিলের অভিজ্ঞতা একেবারে অন্যরকম। ইলেকট্রিক বিল পুরোপুরি মেটাতে না পারায় সরকারিভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল সেখানে। ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হতো। নানান ধরনের মেশিন চালাতে প্রচুর বিদ্যুতের প্রয়োজন। ফলে কারখানা লকআউট হলে ভেতরটা পুরো অন্ধকারে আচ্ছন্ন। কোয়ার্টার এরিযাও তাই। কিছুদিন সচল থাকার পর যখন কারখানায় লকআউট হয়ে গেল, অনেকে কোয়ার্টার ছেড়ে চলে গেলেন। তবে রয়েও গেলেন অনেকে। দু’এক পুরুষ তাঁরা এখানেই কাটিয়ে ফেলেছেন।

বাসস্থানের সংকট যে কী সংকট সে তো হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। তাই অন্ধকার কানোরিয়াকেই অন্ধের যষ্ঠীর মতো আঁকড়ে থাকলাম। অন্যেরা জিনিসপত্র গুটিয়ে নিয়ে মিল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, আর আমরা বড়ো বড়ো বালতি, পঞ্চাশ লিটারের ওয়াটার রিজারভার আনুষঙ্গিক আরো বিভিন্ন জিনিস উলুবেড়িয়া বাজার থেকে কিনে মিলের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকছি। মনে আছে দু’হাজার সালের ঐ সময়েই নিজের জন্য একটি সবুজ রঙের কোরআন শরীফ ও রেহেলও কিনি।

বিদ্যুৎযুক্ত আধুনিক সভ্যতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি সাতানব্বই থেকে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। কেরোসিনের আলোয় এম. এ. ক্লাস পর্যন্ত তো পড়েছি। চৈতালীর ভাষায় আমাকে পার করার পরই আমার গ্রামে বলা ভালো আমার পাড়ায় ইলেকট্রিক এসে গেল। টেলিফোন যোগাযোগ এলো। ফলে বাড়িতেও আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার সব উপকরণ এসে গেছে। কিন্তু আমি আবার অন্ধকার জগতে প্রবেশ করলাম বন্ধ কানোরিয়ার বিদ্যুৎহীন দিনরাতে।

তিনতলা সিঁড়ি বেয়ে গঙ্গার জল বালতি করে টেনে টেনে তুলতাম রান্নাঘরে, বাথরুমে। কেননা তখন কল খুললেই আর জল মিলতো না। প্রায় একবছর গঙ্গাতেই স্নান করেছি, কাপড় কেচেছি। টানা একটা বছর বিভিন্ন রূপে দেখেছি গঙ্গাকে। স্রোতে ভেসে সাঁতারও দিয়েছি। বর্ষায় গঙ্গার ভয়ংকর রূপ। নামা যেতো না জলে। পাড় থেকেই জল ব্যবহার করতে হতো। এক আঁজলা জল তুলে দেখতাম জল নয় ছোট্ট ছোট্ট কাঁকড়ার বাচ্চায় হাত ভরে যেতো। তখন বালতির মুখে গামছা দিয়ে জল ছেঁকে নিতে হতো। পঞ্চাশ লিটারের ওয়াটার রিজারভারে জল ভরে উপর দিয়ে ফটকিরি বুলিয়ে নিলে পলি থিতিয়ে তলায় পড়ে গেলে সে জল সাংসারিক নানান প্রয়োজনীয় কাজে লাগানো হতো।  
🍂

প্রতিকূল পরিস্থিতিকে অনুকূল করার হাজার চেষ্টা একবার একেবারে ব্যর্থ হয়ে গেল। ভরা জোয়ারে নানান জিনিস ভেসে আসতো। একবার জেটিতে একটি মানুষের মৃতদেহ এসে আটকে গেলো। সালোয়ার কামিজ পরিহিত নারীদেহ। কাদামাটি মাখামাখি। চেনার উপায় নেই। দুর্গন্ধে টেকা দায়। সবাই ধূপধুনো জ্বালিয়ে সাময়িক প্রতিকারের ব্যবস্থা করলো। পুলিশে খবর দিয়ে সে যাত্রা রক্ষা পাওয়া গেল। কিন্তু মন ভারী হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল খুব ছোটোবেলায় আমার পাড়ার জুলুদাদার মৃতদেহ আমাদের শোবার ঘরের জানালার পাশের পুকুরে এমনই ভাবে ভেসে উঠেছিল। খুব সকালে। কাদামাখা তার শরীরটাকে চিনতে না পেরে পাড়ার লোকজনদের মধ্যে কেউ কেউ বলাবলি করছিলেন হিন্দুরা মনে হয় প্রতিমা ফেলে গেছেন। একজন সাহসী ব্যক্তি জলে নেমে জুলুদাদাকে শনাক্ত করেন। জুলুদাদার মৃগীরোগ ছিল। রাতে রাস্তা দিয়ে যেতে গিয়ে হয়তো ঐ সময়ই আক্রান্ত হয়ে পুকুরে পড়ে ডুবে যায়।
বাউড়িয়া-উলুবেড়িয়া রোডের ধারে

বন্ধ মিলে রাতের অন্ধকারে তিনতলা থেকে দেখতাম নৌকা করে মিলের জিনিসপত্তর, দামি দামি যন্ত্রাংশ কীভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে। একবার তো রাতে একটি কোয়ার্টার লক্ষ করে গুলি গোলাও চলে। শব্দে ঘুম ভেঙে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কাঁচের জানালা ভেদ করে যে কোনো মুহূর্তে তা আমাদের ঘরেও প্রবেশ করতে পারে। সালাউদ্দিন আমাকে নিয়ে তিনদিক খোলা কোয়ার্টারের সব থেকে নিরাপদ যে করিডর সেখানে চলে গেলেন। বললেন, "মাথা নীচু করে বসে পড়ো। বলা তো যায় না। কখন কী ঘটে যাবে!" আসলে আমরা সবাই বাঁচতে চাই। প্রাণের থেকে বড়ো আর কিছু নয়। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীকালের আর একটি ঘটনার কথা মনে এলো। তখন মেদিনীপুর কলেজে পড়াচ্ছি। কলেজ থেকে ফিরে দেখি আমার ছোট্ট মেয়েটা সোফার আড়ালে লুকিয়ে আছে। টিভিতে নন্দীগ্রামের গুলি চালানোর দৃশ্য দেখে ভয় পেয়েছে। আমাকেও লুকিয়ে পড়তে বললো কেননা না হলে গুলি লেগে যেতে পারে। ভয় ভয় ভয়। আর কতো ভয় আমরা পাবো?

কানোরিয়ার যে কোয়ার্টারে গুলি চলেছিল সে বিষয়ে সকালে নানান কানাঘুষো শোনা গেল। মোদ্দা কথা হলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটি অবাঙালি পরিবার ঐ কোয়ার্টারে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে ফেলেছে, তাদের বাস ওখান থেকে ওঠাতে হবে। মালিকের নির্দেশ এসেছে। আর পরিবারটিও বেশ জেদি, পাওনা টাকা না মেটালে তারা একচুলও নড়বে না।

মাসের পর মাস মিল বন্ধ। সংসার চলছে আংশিক সময়ের অধ্যাপনার পারিশ্রমিকে। যতটুকু আহার গ্রহণ করলে মোটামুটি বেঁচে থাকা যায় সেভাবেই চালাচ্ছি সংসার। অভিভাবকদের জানতে দিইনি। অতিথি আপ্যায়নে সে সময়ে কোনো ত্রুটিও রাখিনি। ফলে কারোর বোঝার উপায় নেই।সম্ভবত দু’হাজার সালের নভেম্বরে কলেজ সার্ভিস কমিশনের ইন্টারভিউ হলো। নীলাঞ্জনা,প্রসেনজিত চেনা সহপাঠীদের আরো অনেকে একই দিনে ইন্টারভিউ দিলাম। সেদিন আরো একবার ফর্ম ফিলআপ করতে হলো, ঠিক কোথায় অর্থাৎ কোন অঞ্চলের কলেজে অধ্যাপনার চাকরি হলে আমাদের সুবিধা হয়, সে বিষয় উল্লেখ করে। তখন আর চয়েস করা ! চাকরি হলেই হলো। লিখে দিলাম, এনি হয়ার ইন ওয়েস্টবেঙ্গল, একসেপ্ট নর্থ চব্বিশ পরগণা। বাঁদরামো আমারও কিছু কম ছিল নাকি!

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments