জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে/ ৪৭তম পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে  
৪৭তম পর্ব   
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী   

তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব               
 
           
এরপরে একটি বড় দরজা পেরিয়ে এলাম এখানকার মুখ্য মন্দিরে। বেটদ্বারকার মূল কৃষ্ণ মন্দিরের গঠন সাদামাটা। মন্দিরের গঠন একটি দোতলা বাড়ির মত। এই গৃহ আকারের মন্দিরে প্রবেশের জন্য রয়েছে বাইরের দিকে একটি মাত্র দরজা, এবং তিনদিকে উঁচু প্রাচীর। লোক পরম্পরায় জানা যায় ১৮৫ বৎসর পূর্বে কচ্ছের রাও এই মন্দিরটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। আমরা নাটমন্দিরে ধীর পায়ে এসে দাঁড়ালাম। নাটমন্দিরের ঠিক মাঝখানে কয়েকজন ভক্ত ভজন কীর্তন গানে ব্যস্ত। অনেকেই সেই অপূর্ব ভজন শুনতে দাঁড়িয়ে গেছেন। আমরাও সেই ভজন শুনতে শুনতেই নাটমন্দিরটি দর্শন করলাম। নাটমন্দিরের দুই ধারে পাশাপাশি তিনটি করে মন্দির। প্রতিটি মন্দিরে কারুকার্য মণ্ডিত রুপোর দরজাগুলি দেখার মত। গর্ভগৃহের সামনে কিছুটা জায়গা রেলিং দিয়ে ঘেরা যেখানে মেয়েরা দাঁড়িয়ে পুজো দেন। আমরা পুরুষেরা বাইরের থেকেই প্রণাম করলাম। মন্দিরের ভিতরে রাধারানী, রুক্মিণী, দ্বারকানাথ, সত্যভামা, জাম্ববতী, মাতা দেবকীর সঙ্গে বলরাম, প্রদ্যুম্ন, গরুড়দেবতা, অম্বিকা মাতা ও বেণীমাধবের মূর্তি রয়েছে। নাট মন্দিরের দেওয়ালে বেশ কিছু রঙিন ছবি টাঙ্গানো রয়েছে, যেমন মা যশোদার গাভীর বাঁট থেকে দুগ্ধদোহন, রাধাকৃষ্ণের রাসলীলা, শ্রীকৃষ্ণের গীতার ব্যাখ্যা প্রদান, অর্জুনের বিশ্বরূপ দর্শন প্রভৃতি। 

অতীতকালের সখা সুদামার প্রথা অনুসরণ করে আজও এখানের মন্দিরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে চাল অর্ঘ্যদান করা হয়। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস এখানে এসে শ্রীকৃষ্ণকে এক মুষ্টি তন্ডুল দান করলে বহু জন্মের প্রারম্ভ খন্ডন হয়ে যায়। পাঁচশত বৎসরের প্রাচীন এই গর্ভগৃহের আভিজাত্য তাকিয়ে দেখার মতন। রুপোয় মোড়া দরজার ভেতরে গর্ভগৃহের ঠিক মাঝখানে শ্বেতপাথরের বেদীর উপরে সোনার সিংহাসনে আসীন দ্বারকাধীশ রণছোড়জীর কষ্টিপাথরের অপরূপ দন্ডায়মান বিগ্রহ। সর্বাঙ্গ অলংকারে ভূষিত। চারি হস্তে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম, মস্তকে স্বর্ণমুকুট। দুচোখ ভরে দারকাধীশের সেই প্রাচীন বিগ্রহটি দর্শন করলাম। সেই সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিয়ে যাওয়া পূজার অর্ঘ্য পূজারীর হাতে দান করলাম। মন্দির ও প্রাসাদের কাঠের কারুকার্যগুলি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এখানকার পান্ডারা বলেন বেটদ্বারকার শ্রীদ্বারকাধীশের মূর্তি পাঁচ হাজার বৎসরের পুরাতন। এক্ষেত্রে যুক্তির থেকে বিশ্বাস বড়। তবে অনেক কাহিনী ও কিংবদন্তী এই ভূমির সাথে জড়িয়ে আছে। 

মন্দির থেকে বেরিয়ে আরো একটি দ্রষ্টব্য স্থান দেখার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সময় অভাবে যেতে পারলাম না। সেই বহু আকাঙ্খিত স্থানটি হলো হনুমান পুত্র মকরধ্বজের মন্দির এবং বিগ্রহ দর্শন করা। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে হনুমান তো চির ব্রহ্মচারী ছিলেন, তাহলে তাঁর আবার পুত্র কিভাবে হলো? তার উত্তরে বলা যায় হনুমান যখন লেজে আগুন দিয়ে সমগ্র লঙ্কা পুড়িয়ে ফেরার সময়ে সমুদ্রে ডুব দিয়েছিলেন তখন তাঁর ঘামের একটি ফোঁটা সমুদ্রগর্ভস্থ এক বিশাল মকরের মুখে পড়ে যায়। পরবর্তীতে পাতাললোকের বাসিন্দাদের হাতে সেই মকর ধরা পড়ে এবং তার পেট চিরে দেখা যায় পেটের ভিতর জীবন্ত এক শিশু হনুমানকে। সেই শিশু হনুমানের নাম মকরধ্বজ। পাতালের রাজা অহিরাবন সেই মকরধ্বজের বুদ্ধিমত্তা এবং শক্তি দেখে তাকে প্রাসাদের রক্ষক নিযুক্ত করেন। পরবর্তীকালে রাম ও লক্ষণকে বন্দী করে অহিরাবন যখন পাতালে নিয়ে যায় মা কালীর কাছে বলিদানের উদ্দেশ্যে, সেই সময় এই মকরধ্বজের সাহায্যে পবনপুত্র হনুমান রাম ও লক্ষণকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। রামচন্দ্র মকরধ্বজকে মুক্ত করে পাতালপুরীর রাজা করেন। কিন্তু সেই মন্দির এখান থেকে প্রায় দু কিলোমিটার দূরে দ্বীপের এক নির্জন প্রান্তে অবস্থিত হওয়ায় যাওয়া হোল না। 

স্থানীয় লোকেদের বেশিরভাগই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত যাদের মূল পেশা মৎস্য শিকার। এখানে আমাদের প্রায় এক ঘন্টা সময় লেগেছিল সব কিছু দেখতে। ফেরার সময় পুনরায় যন্ত্রচালিত বোটে করে ওখা ফিরে এলাম। সেই সময় সমুদ্র থেকে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম ছটা আরবসাগরের জলকে রাঙিয়ে দিয়ে পশ্চিম দিগন্তে ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হচ্ছেন। সেই অপরূপ দৃশ্য সকলে ক্যামেরা ও মোবাইলে বন্দী করে রাখতে ব্যস্ত। আমরাও অস্তগামী সূর্যাস্তের রক্তিম আভার ফটো তুললাম। ওখাতে ফিরে এসে আর দেরী না করে আমাদের গাড়ী নিয়ে আমরা দ্বারকা অভিমুখে রওনা হলাম। 

🍂

গোমতী সেতুর কিছুটা আগেই বাঁদিকে শ্রীকৃষ্ণের পাটরানী রুক্মিণী দেবীর মন্দির। প্রবাদ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবনকালেই এই মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। অবশ্য বর্তমানের মন্দিরটি ১২০০ বৎসরের পুরাতন। পরবর্তীকালে সপ্তদশ শতাব্দীতে এই মন্দির সংস্কার ও পুনর্গঠিত হয়। দ্বারকাধীশ মন্দির থেকে দুই কিলোমিটার দূরত্বে এই মন্দির। সকাল ছটা থেকে রাত্রি সাড়ে নটা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে। একটি জিনিস অবাক করার মতন দ্বারকাতে শ্রীদ্বারকাধীশের মন্দিরে রুক্মিনী দেবীর কোন বিগ্রহ নেই। অথচ তিনি মা লক্ষ্মীর অংশসম্ভূতা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের থেকে রুক্মিনী দেবীর মন্দির পৃথক স্থানে অবস্থিত। গোমতীর যে তীরে শ্রীদ্বারকাধীশ মন্দির সেই তীরেও রুক্মিনী দেবীর কোন স্থান হয়নি। 

এ সম্বন্ধে পৌরাণিক কাহিনীটি হল একবার মহাতেজা উগ্র দুর্বাসা ঋষিকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রাসাদে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানিয়ে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ ও রুক্মিনীদেবী স্থির করলেন উগ্র ঋষিকে রথে চাপিয়ে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসবেন এবং অশ্বের পরিবর্তে সেই রথ তাঁরা দু'জনে টেনে নিয়ে যাবেন। পথিমধ্যে রুক্মিনী দেবীর জলপিপাসার জন্য শ্রীকৃষ্ণ পদাঘাতে গঙ্গাজল আনয়ন করে তাঁর পিপাসা নিবারণ করেন। রুক্মিণী দেবী নিজের জল পিপাসা নিবারণ করলেও তার পূর্বে ঋষি দূর্বাসাকে জল দান করেননি। এই ত্রুটির জন্য দুর্বাসা মুণি তাঁকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের সাথে তাঁর চিরকালীন বিচ্ছেদ ঘটবে। ঋষির অভিশাপের জন্যই মনে হয় শ্রীকৃষ্ণের মন্দির থেকে রুক্মিনী দেবীর মন্দির পৃথক স্থানে। মন্দিরের গঠনশৈলী অপূর্ব। মন্দিরের বাইরের দেওয়ালে বিভিন্ন দেবদেবী এবং হস্তীর বিভিন্ন ভঙ্গিমার সূক্ষ্ম কারুকার্যগুলি দর্শকদের আকৃষ্ট করে। গর্ভগৃহে শ্বেতপাথরের রুক্মিনী দেবীর দন্ডায়মান বিগ্রহের চারি হস্তে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম বিরাজিত। গর্ভগৃহে শ্রীদ্বারকাধীশ মন্দিরের তুলনায় দর্শনার্থীদের ভিড় খুব কম। এই মন্দিরে জলদান করা তীর্থযাত্রীদের অবশ্য কর্তব্য। আমরা এখানে এসে পৌঁছে ছিলাম সন্ধ্যে ৭টার সময়। সেই সময় আরতি শুরু হতে আমরা সম্পূর্ণ আরতি দর্শন করে ফিরলাম। মন্দির থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখতে পাচ্ছি শ্বেতপাথরের মন্দির বিদ্যুতালোকে অপরূপ রূপে সজ্জিত। কোজাগরী পূর্ণিমার দিনে এখানে বিশেষ পূজা ও উৎসব হয়। তাড়াতাড়ি করে হোটেলে ফিরলাম কারণ আমাদের আজকের সোমনাথ যাওয়ার ট্রেন রাত্রি ৮-৪৫-এ। হোটেলে ফিরে এসে ব্যাগ, স্যুটকেস নিয়ে ওই গাড়ীতে করেই আমরা স্টেশনে এসে পৌছালাম রাত্রি সাড়ে আটটায়। ট্রেন যথারীতি ৮-৪৫-এ এসে ৮-৫০-এ ছাড়ল। দ্বারকাধাম থেকে আমরা চললাম সোমনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শনে।                    
                                                   পরবর্তী অংশ ৪৮তম পর্বে

Post a Comment

0 Comments